পথের পাঁচালী

পরক্ষণেই কিন্তু অত্যধিক ভয়ে তাহার একরূপ মৰীয়া সাহস জোগাইল, একটা অস্পষ্ট আর্তরব করিয়া প্রাণভয়ে দিশাহারা অবস্থায় সে সম্মুখের ভাট, শেওড়া, রাংচিতার জঙ্গল ভাঙিয়া ডিঙাইয়া সন্ধ্যার আসন্ন অন্ধকারে যেদিকে দুই চোখ যায় ছুটিল-নীলুও ছুটিল তাহার পিছনে পিছনে।…

ইহাদের ভয়ের কারণ কি বুঝিতে না পারিয়া বুড়ি ভাবিল-মুই মাত্তিও যাইনি, ধত্তিও যাইনি-কঁচা ছেলে, কি জানি মোরে দেখে কেন ভয় পালে সন্দেবোলা? খোকাডা কাদের?

অপু যখন বাড়ি আসিল, তখন সন্ধা উত্তীর্ণ হইয়া গিয়াছে। সর্বজয়া সবে উনুন ধরাইয়া তালের বড়া ভাজিবার আয়োজন করিতেছে, দুর্গা নিকটে বসিয়া তাল চাচিয়া রস বাহির করিতেছে-ছেলেকে দেখিয়া বলিল-কোথায় ছিলি বল দিকি? সেই বেরিয়েচো বিকেলবেলা, কিছুই তো আজ খাবার খেলিনে-খিদেতেষ্টা পায় না?

মায়ের নিকট বলিবার জিনিস অপুর মনে স্তুপাকার হইয়া সকলেই একসঙ্গে বাহিরে আসিবার জন্য এরূপভাবে চেষ্টা পাইতেছিল যে, পরস্পরের ঠেলা ঠেলিতে পরস্পরের নির্গমপথ এককালীন বুদ্ধ হইয়া গিয়া অপুকে একেবারে নির্বক করিয়া দিল। সে শুধু বলিল-আমি কি কাপড় ছাড়বো মা? আমার এখানা ওবেলার কাপড়–

পরে সে বিস্ময়ের সহিত দেখিল যে, মা তাহাকে চালভাজা দিবার কোনো আগ্রহই না দেখাইয়া তালের রসটা ঘন না পাতলা হইয়াছে, তাহাই অত্যন্ত মনোযোগের সহিত পরীক্ষা করিতেছে। পরীক্ষা শেষ হইয়া গেলে দুৰ্গাকে বলিল-দু-চারখানা ভেজে দেখি, না হয়, বড় তক্তপোশের নিচেটায় চালের গুড়ো আছে, আর দুটো নিয়ে আসিস এখন-পরে ছেলের দিকে চাহিয়া বলিল-দাঁড়া অপু, তোকে গরম গরম ভেজে দিচ্ছি।

অপু বলিল-কেন মা, চাল-ছোলা ভাজা কই?

–তা চাল ভাজা তুই খেলি কই? এতবার ডাকলাম, তুই বেরিয়ে চলে গেলি -ঠাণ্ডা হয়ে গেল, দুৰ্গা খেয়ে ফেল্পে, তা এই বড় তো হয়ে গেল বলে। ভাজবো আর দেবো–

অপু সেই বৈকালবেলা হইতে মনের মধ্যে যে তাসেব ঘর নির্মাণ করিতেছিল, এক ফুযে কে তাহা একেবারে ভূমিসাৎ করিয়া দিল। এই তাহার মা তাহাকে ভালোবাসে! সে বৈকালবেলা বাটীব বাহিরে যাওয়ার পর হইতে অনবরত ভাবিতেছে-মা না জানি কত দুঃখই করিতেছে তাহার জন্য! অপু আমার এখনও কেন যে এলো না, তার জন্যে এত করে ঘাট থেকে এসে ভাঁজলাম, আহা সে দুটো খেলে না-হা, দায় পড়িযছে, তাহার জন্য ভাবিয়া তো মায়েব ঘুম নাই-মা দিব্যি সেগুলি দিদিকে খাওয়াইয়া দিয়া নিশ্চিন্ত হইয়া বসিয়া আছে–সে-ই শুধু এতক্ষণ মিছামিছি ভাবিয়া মরিতেছিল।

দুর্গা বলিল-মা শিগগির শিগগির ভেজে নাও। বড় মেঘ করে আসচে, বিষ্টি এলে আর ভাজা হবে না,-ঘরে যে জল পড়ে!—সেদিনকার মতো হবে কিন্তু–

দেখিতে দেখিতে চারিধার ঘিরিয়া ঘনাইয়া-আসা মেঘের ছায়ায় বাশবনেৰ মাথা কালো হইয়া উঠিল। খুব মেঘ জমিয়া আকাশ অন্ধকার হইয়াছে, অথচ বৃষ্টি এখনও নামে নাই-এসময় মনে এক প্রকার আনন্দ ও কৌতুহল হয়—না জানি কি ভয়ঙ্কর বৃষ্টিই আসিতেছে, পৃথিবী বুঝি ভাসাইয়া লইয়া যাইবে-অথচ বৃষ্টি হয় প্রতিবারই, পৃথিবী কোনোবারেই ভাসায় না, তবুও এ মোহটুকু ঘোচে না! দুৰ্গার মন সেই অজানার আনন্দে ভরিয়া উঠিল, সে মাঝে মাঝে দাওয়ার ধারে আসিয়া নিচু চালের ছাঁচ হইতে মুখ বাড়াইয়া মেঘান্ধকার আকাশের দিকে চাহিয়া দেখিতেছিল।

সর্বজয়া খানকতক বড়া ভাজিয়া বলিল–এই বাটিটা করে ওকে দে তো দুগগা।-ওরা খিদে পেয়েচে, বিকেল থেকে কিছু তো খায় নি! এই শেষ কথাই কাল হইল-এতক্ষণ অপু যা হয় এক রকম ছিল। কিন্তু মায়ের শেষের দিকের আদরের সুরে তাহার অভিমানের বাঁধি একেবারে ভাঙিয়া পড়িল, সে বড়াসুদ্ধ বাটিটা উঠানে স্টুড়িয়া দিয়া বলিল-আমি খাবো না তো বড়া, কখখনো খাবো না—যাও–

সর্বজয়া ছেলের কাণ্ড দেখিয়া অবাক হইয়া রহিল। গরিবের ঘরকন্না, কত কষ্টে যে কি জোগাড় করিতে হয় সে-ই জানে। আর হতভাগা ছেলেটা কিনা। দু-দুবার সেই কত কষ্টে সংগৃহীত মুখের জিনিস নষ্ট করিল! ক্ষোভে, রাগে সে ছেলের দিকে চাহিয়া বলিল–তোমার আজ হয়েছে কি! তোমার অদৃষ্ট আজ ছাই লেখা আছে, খেয়ো এখন তাই গরম গরম–

এবার অপুর পালা। এ রকম কথা মা’র মুখে সে কখনও শোনে নাই। কোথায় সে চাহিতেছে, মা দুটো আদরের কথা বলিয়া সাত্ত্বনা করিবে, না সন্ধ্যাবেলা এমন নিষ্ঠুর কথা! সে দাঁড়াইয়া উঠিয়া বলিল, আচ্ছা মা, আমি চালভাজা খাইনি তাতে আমার মনে কষ্ট হয় না? আমি বিকেল থেকে ভাবছিনে বুঝি? আমি-আমি কখখনো তোমার বাড়ি আর আসচিনে-আমি ছাই খাবো, কেন আমি ছাই খাবো? আর দিদি বুঝি সব ভালো ভালো জিনিস খাবে? আমি আসবো না তোমার বাড়ি, কখখনো আসবো না–

পরে সে আতুরী বুড়ির বাড়ি হইতে এইমাত্র যেরূপ অন্ধকার, কঁটাবন, আমবন না মানিয়া ছুটিয়াছিল এখনও রাগে আত্মহারা হইয়া দাওয়া হইতে নামিয়া বাহিরের উঠানের দিকে ঠিক সেইরূপ মরীয়ার মতো ছুটিল। ভাই-এর অভিমান-ভরা দৃষ্টি, ফুলা ঠোঁট ও কথা বলিবার ধরন দুর্গার নিকট এরূপ হাস্যকর ঠেকিল যে, সে হাসিয়া প্ৰায় গড়াইয়া পড়িল।–হি-হি-অপুটা-একেবারে পাগল মা, কেমন বল্লে-পরে ভাই-এর কথা বলিবার উক্তির নকল করিয়া বলিল-আমি চালভাজা খাইনি-হি-হি-তাতে বুঝি আমার কষ্ট হয় না? বোকা একেবারে যা-ও অপু, শুনে যা, ও অপু-উ-উ–

অপু ছুটিয়া পাচিলের পাশের পথ দিয়া পিছনের বাঁশবাগানের দিকে ছুটিল। আকাশে মেঘ তখনও থমকিয়া আছে, বাশবনের তলাটা ঝোপেঝাড়ে নির্জন বৰ্ষসিন্ধ্যায় ঘুটঘুটে অন্ধকার। সহজ অবস্থায় এরূপ স্থানে এ-সময় এক আসিবার কল্পনাই সে করিতে পারিত না কোনদিনও। কিন্তু বর্তমানে চারিধারের নির্জনতা ও অন্ধকার, বাঁশঝাড়ের মধ্যে কিসের খড়মড় শব্দ, অদূরে সলতেখাগী আমগাছে ভূতের প্রবাদ প্রভৃতি সম্পূর্ণ বিস্মৃত হইয়া দাঁড়াইয়া দাঁড়াইয়া ভাবিতে লাগিল—আমি কখখনো বাড়ি যাবো না তো!—এ জন্মে আর বাড়ি যাবো না–

অভিমানের প্রথম বেগটা কাটিয়া গেলে তাহার একটু গা ছমছম কবিতে লাগিল—ভয়ে ভয়ে সে একবার দূরের সলতে-খাগী আমগাছটার দিকে চাহিয়া দেখিল। তাহার মনে হইল—এখন যদি একটা ভুতে আমায় তুলে একবারে মগডালে নিয়ে যায় তো বেশ হয়-মা খুঁজে খুঁজে কেঁদে মরেভাবে, কেন সন্দেবোলা ছাই খাও বল্লাম, তাই তো খোকা আমার রাগ করে কোথায় অন্ধকারে মেঘ মাথায় বেরিয়ে চলে গেল, আর ফিরে এলো না। ভূতের হাতে সে মরিয়া গেলে মা’র কি রকম কষ্ট হইবে তাহা সে খানিকক্ষণ প্রতিহিংসার আনন্দে উপভোগ করিল। পরে সেখান হইতে সে গিয়া পাচিলের পাশের পথে দাঁড়াইল। তাহার ভয় ভয় করিতেছিল-সম্মুখের বাঁশঝাড়ে একটা যেন অস্পষ্ট শব্দ হইল, অপু একবার ভয়ে ভয়ে চোখ উঁচু করিয়া চাহিয়া দেখিল। তাহার মা ও দিদি রানুদের বাড়ির দিকে ডাকিতেছে-ও অপু-উ-উ! বাঁশঝাড়ে আবার যেন একটা শব্দ হইল। সে মনে মনে বড় অস্বস্তি বোধ করিতে লাগিল। কিন্তু মুশকিল। এই যে, তাহাকে খোেশামোদ না করিলে সে নিজেই এত রাগের মাথায় বাড়ি গিয়া ঢুকিবে, সত্য সত্য এতটা আত্মসম্মানজ্ঞানশূন্য সে নয়। নিশ্চয়ই। এবার তাহার দিদি রানুদের বাড়ির খিড়কি দিয়া বাহির হইয়া আসিতেছে যেন। সে ছুটিয়া দরজার সামনে পাচিলের কোণটাতে দাঁড়াইল। হঠাৎ আসিতে আসিতে পাচিলের পাশে চোখ পড়িতেই দুর্গা চেঁচাইয়া বলিয়া উঠিল, ওই দাঁড়িয়ে রয়েছে মা! …এই দ্যাখো পাচিলের পাশে। পরে সে ছুটিয়া গিয়া ভাইয়ের হাত ধরিল। (ছুটিবার আবশ্যকতা ছিল না।)-ওরে দুষ্ট, এখানে চুপটি করে দাঁড়িয়ে থাকা হয়েচে, আর আমি আর মা সমস্ত জায়গা খুঁজে বেড়াচ্চি, এই দ্যাখে।

দুজনে মিলিয়া তাহাকে বাড়ির মধ্যে ধরিয়া লইয়া গেল।

ষষ্ঠদশ পরিচ্ছেদ

এবার বাড়ি হইতে যাইবার সময় হরিহর ছেলেকে সঙ্গে করিয়া লইয়া চলিল। বলিল-বাড়ি থেকে কিছু খেতে পায় না, তবুও বাইরে বেবুলে দুধটা, ঘিটা-ওর শরীরটা সারবে এখন।

অপু জন্মিয়া অবধি কোথাও কখনও যায় নাই। এ গাঁয়েরই বকুলতলা, গোঁসাইবাগান, চালতোতলা, নদীর ধার-বড়জোর নবাবগঞ্জ যাইবার পাকা সড়ক-এই পর্যন্ত তাহার দৌড়। মাঝে মাঝে বৈশাখ কি জ্যৈষ্ঠ মাসে খুব গরম পড়লে তাহার মা বৈকালে নদীর ঘাটে দাঁড়াইয়া থাকিত। নদীর ওপারের খড়ের মাঠে বাবলা গাছে গাছে হলুদ রং-এর ফুল ফুটিয়া থাকিত, গরু, চরিত, মোটা গুলঞ্চলতা-দুলানো শিমুল গাছটাকে দেখিলে মনে হইত যেন কতকালের পুরাতন গাছটা। রাখালেরা নদীর ধারে গরুকে জল খাওয়াইতে আসিত, ছোট্ট একখানা জেলেডিঙি বাহিয়া তাহাদের গায়ের অঙ্কুর মাঝি মাছ ধরিবার দোয়াড়ি পাতিতে যাইত, মাঠের মাঝে মাঝে ঝাড় ঝাড় সৌদালি ফুল বৈকালের ঝিরঝির বাতাসে দুলিতে থাকিত-ঠিক সেই সময়ে হঠাৎ এক-একদিন ওপারের সবুজ খড়ের জমির শেষে নীল আকাশটা যেখানে আসিয়া দূর গ্রামের সবুজ বনরেখার উপর ঝুকিয়া পড়িয়াছে, সেদিকে চাহিয়া দেখিতেই তাহার মনটা যেন কেমন হইয়া যাইত-সে সব প্রকাশ করিয়া বুঝাইয়া বলিতে জনিত না। শুধু তাহার দিদি ঘাট হইতে উঠিলে সে বলিত-দিদি দিদি, দ্যাখা দ্যাখ ওইদিকে-পরে সে মাঠের শেষের দিকে আঙুল দিয়া দেখাইয়া বলিত-ওই যে? ওই গাছটার পিছনে? কেমন অনেক দূর, না?

175 Shares