পথের পাঁচালী

বধূ এতক্ষণ ভালো করিয়া ছেলেটির মুখের দিকে চাহিয়া দেখে নাই-কাছের গোড়ায় দেখিয়া মনে হইল যে, এ এখনও ভারি ছেলেমানুষ, মুখের ভাব যেন পাঁচ বছরের ছেলের মতো কচি। এমন সুন্দর অবোধ চোখের ভাব সে আর কোনো ছেলের চোখে এ পর্যন্ত দেখে নাই-এমন রং, এমন গড়ন, এমন সুন্দর মুখ, এমন তুলি দিয়া আঁকা ডাগর ডাগর নিষ্পাপ চোখ-অচেনা ছেলেটির উপর বধূর বড় মমতা হইল।

অপু বসিয়া নানা গল্প করিল—বিশেষ করিয়া কল্যকার রেলপথের কথাটি। খানিকটা পরে বধূ মোহনভোগ তৈয়ারি করিয়া খাইতে দিল। একটা বাটিতে অনেকখানি মোহনভোগ, এত ঘি দেওয়া যে আঙুলে ঘিয়ে মাখামাখি হইয়া যায়। অপু একটুখানি মুখে তুলিয়া খাইয়া অবাক হইয়া গেলএমন অপূর্ব জিনিস আব সে কখনও খায় নাই তো!–মোহনভোগে কিসমিস দেওয়া কেন? কই তাহার মায়ের তৈরি মোহনভোগে তো কিসমিস থাকে না? বাড়িতে সে মা’র কাছে আবদার ধরে — মা, আজ আমাকে মোহনভোগ করে দিতে হবে! তাহার মা হাসিমুখে বলে-আচ্ছা ওবেলা তোকে করে দেবো-পরে সে শুধু সুজি জলে সিদ্ধ করিয়া একটু গুড় মিশাইয়া পুলটিসের মতো একটা দ্রব্য তৈয়ারি করিয়া কঁসার সরপুরিয়া থালাতে আদর করিয়া ছেলেকে খাইতে দেয়। অপু তাহাই খুশির সহিত এতদিন খাইয়া আসিয়াছে, মোহনভোগ যে এরূপ হয় তাহা সে জনিত না। আজ কিন্তু তাহাব মনে হইল এ মোহনভোগে আর মাযের তৈয়ারি মোহনভোগে আকাশ-পাতাল তফাত!, সঙ্গে সঙ্গে মায়ের উপর করুণায় ও সহানুভূতিতে তাহার মন ভরিয়া উঠিল। হয়তো তাহার মাও জানে না যে, এ রকমের মোহনভোগ হয়!—সে যেন আবছায়া ভাবে বুঝিল, তাহার মা গরিব, তাহারা গরিবতাই তাহাদেব বাড়ি ভালো খাওয়া-দাওয়া হয় না।

একদিন পাড়ার এক ব্ৰাহ্মণ প্রতিবেশীর বাড়ি অপুর নিমন্ত্রণ হইল। দুপুর বেলা সে-বাড়ির একটি মেয়ে আসিয়া অপুকে ডাকিয়া লইয়া গেল। ওদের রান্নাঘরের দাওয়ায় যত্ন করিয়া পিড়ি পাতিয়া জল ছিটাইয়া অপুকে খাবার জায়গা করিয়া দিল। যে মেয়েটি অপুকে ডাকিতে আসিয়াছিল, নাম তার অমলা, বেশ টকটকে ফরসা রং, বড় বড় চোখ, বেশ মুখখানি, বয়স তার দিদির মতো। আমলার মা কাছে বসিয়া তাহাকে খাওয়াইলেন, নিজের হাতের তৈয়ারি চন্দ্রপুলি পাতে দিলেন। খাওয়ার পরে আমলা তাহাকে সঙ্গে করিয়া বাড়ি দিয়া গেল। সেদিন বৈকালে খেলিতে খেলিতে অপুর পায়ের আঙুল হঠাৎ বাগানের বেড়ার দুই বাঁশের ফাঁকে পড়িয়া আটকাইয়া গেল। টাট্‌কা-চেরা নতুন বাঁশের বেড়া, আঙুল কাটিয়া রক্তারক্তি হইল, অমলা ছুটিয়া আসিয়া পা-খানা বাঁশের ফাঁক হইতে বাহির না করিলে গোটা আঙুলটাই কাটা পড়িত। সে চলিতে পাবিতেছিল না, আমলা তাহাকে কোলে করিয়া গোলার পাশ হইতে পাথরকুচির পাতা তুলিয়া বাটিয়া আঙুলে বাঁধিয়া দিল। পাছে বাবার বকুনি খাইতে হয়, এই ভয়ে অপু একথা কাহারও কাছে প্রকাশ করিল না।

সে রাত্রে শূইয়া অপু শুধু অমলারই স্বপ্ন দেখিল। সে অমলার কোলে বেড়াইতেছে, আমলার কাছে বসিয়া আছে, আমলার সঙ্গে খেলা করিতেছে, আমলা তাহার পায়ের আঙুলে পটি বাঁধিয়া দিতেছে, সে ও অমলা রেলরাস্তায় দুটাছুটি করিয়া বেড়াইতেছে-অমলার হাসি ভরা চোখমুখ ঘুমের ঘোরে। সারারাত নিজের কাছে কাছে। ভোরে সে শুধু খুঁজতে লাগিল অমলা কখন আসে। আরও সব ছেলেমেয়েরা আসিল, খেলা আরম্ভ হইয়া গেল, ক্ৰমে বেশ বেলা হইল-কিন্তু অমলার দেখা নাই। বাড়ির ভিতর হইতে বধূ খাবার খাইবার জন্য ডাকিয়া পাঠাইল-রোজ সকালে বিকালে বধূ নিজের হাতে খাবার তৈয়ারি করিয়া তাহাকে খাওয়াইত-খাওয়া শেষ করিয়া আসিবার সময় সে বধূকে জিজ্ঞাসা করিল-সকালে কি অমলাদিদি এসেছিল? না, সে আসে নাই। ক্ৰমে আরও বেলা হওয়াতে খেলা ভাঙিয়া গেল। তাহার বাবা তাহাকে স্নান করিবার জন্য ডাকিল। তবুও কোথায় অমলা? অভিমানে তাহার মন ছাপাইয়া উঠিল, বেশ, নাই বা আসিল? আমলার সহিত তাহার জন্মের তো আড়ি—আর যদি সে কখনও তাহার সহিত কথা কয়! বৈকালেও খেলা আরম্ভ হইল, আর সকলেই আসিল-অমলা নাই। পাঁচ ছয়টি ছেলেমেয়ে খেলিতে আসিলেও অপুর মনে হইল, কাহার সহিত সে খেলিবে? কেহই উপযুক্ত খেলার সাখী বলিয়া মনে হইল না। উৎসাহহীন ভাবে সে খানিকক্ষণ খেলা করিল, তবুও আমলার দেখা নাই।

পরদিন সকালে আমলা আসিল। অপু কোনো কথা বলিল না। অমলা যেখানে বসে, সে তাহার ত্ৰিসীমানায় ঘেষে না, অথচ মাঝে মাঝে আড়াচোখে চাহিয়া দেখে, সে যে রাগ করিয়া এরূপ করিতেছে, আমলা তাহা বুঝিয়াছে কিনা। আমলা সত্যই প্রথমটা বুঝিতে পারে নাই, পরে যখন সে বুঝিল যে, কিছু একটা হইয়াছে নিশ্চয়, তখন সে কাছে গিয়া জিজ্ঞাসা করিল–কি খোকা, কথা বলচো না কেন?… কি হয়েচে?

অপু অতশত বোঝে না, সে অভিমানে ঠোঁট ফুলাইয়া বলিল-কি হয়েচে বইকি! তা কিছু কি আর হয়েচে? কাল আসিনি কেন?

অমলা অবাক হইয়া বলিল-আসিনি, তাই কি?–সেইজন্যে রাগ করেচ?

অপু ঘাড় নাড়াইয়া জানাইল, ঠিক তাই। অমলা খিলখিল করিয়া হাসিয়া অপুকে হাত ধরিয়া লইয়া চলিল বাড়ির ভিতর। সেখানে বধূ সব শুনিয়া প্রথমটা হাসিয়া খুন হইল, পাবে মুখে হাসি টিপিয়া বলিল-তা হলে অমলা, তোমার আর এখন বাড়ি যাওয়ার জো নেই তো দেখচি-কি আর করবে, খোকা যখন তোমাকে ছাড়তে পারে না, তখন এখানেই থেকে যাও।–আর না হয়–

বধূর কথার ভঙ্গিতে অমলা কি জানি কি একটা ঠাওরাইয়া লজ্জিত প্রতিবাদের সুরে বলিলআচ্ছা যাও বৌদি-ও-রকম করলে কিন্তু কক্ষনো আর তোমাদের বাড়ি–

খানিকক্ষণ পরে অপু অমলার সঙ্গে তাঁহাদের বাড়ি গেল। আমলা তাহাদের আলমারি খুলিয়া কাঁচের। বড় মেম-পুতুল, মোমের পাখি, গাছ, আরও কত-কি দেখাইল। কালীগঞ্জের স্নানযাত্রার মেলা হইতে সে-সব নাকি কেনা, অপু জিজ্ঞাসা করিয়া জানিল। নতুন নতুন খেলার জিনিস—একটা রবারের বাঁদর, সেটা তুমি যেদিকে যাও, তোমার দিকে চাহিয়া চোখ পিটুপিট্‌ করিবে—একটা কিসের পুতুল, সেটার পেট টিপিলে দুহাতে মৃগীরোগীব মতো হঠাৎ হাত পা ছুড়িয়া খঞ্জনী বাজাইতে থাকে-সকলের চেয়ে আশ্চর্যের জিনিস হইতেছে একটা টিনের ঘোড়া, রানুদির কোকা তাহাদের বাড়ির দালানের ঘড়িতে যেমন দম দেয়, ওইরকম দম দিয়া ছাড়িয়া দিলে সেটা খড়খড় করিয়া মেঝের উপর চলিতে থাকে-অনেক দূর যায়—ঠিক যেন একেবারে সত্যিকারের ঘোড়া। সেইটা দেখিয়া অপু অবাক হইয়া গেল। হাতে তুলিয়া বিস্ময়ের সহিত উলটাইয়া-পালটাইয়া দেখিয়া আমলার দিকে চাহিয়া বলিল-এ কি রকম ঘোড়া, বেশ তো! এ কোথা থেকে কেনা, এর দাম কত?

তাহার পর আমলা তাহাকে একটা সিঁদুরের কৌটা খুলিয়া দেখাইল-সেটার মধ্যে রাঙা রংএর একখানা ছোট রাংতার মতো কি। অপু বলিল-ওটা কি? রাংতা?

অমলা হাসিয়া বলিল-রাংতা হবে কেন?–সোনার পাত দেখনি অপু?

অপু সোনার পাত দেখে নাই। সোনার রং কি অত রাঙা? সোনার পাতখানা নাড়িয়া চড়িয়া ভালো করিয়া দেখিতে লাগিল। অমলার সহিত বাড়ি ফিরিতে ফিরিতে সে ভাবিল—আহ্বা, দিদিটার ও-সব খেলনা কিছুই নেই-মরে কেবল শূকনো নাটাফল আর রীড়ার বিচি কুড়িয়ে, আর শুধু পরের পুতুল চুরি করে মার খায়!..তাহার দিদির বয়সি অন্য কোনো মেয়ের খেলনার ঐশ্বৰ্য কৃত বেশি, তাহা সে এ পর্যন্ত কোনো দিন দেখে নাই, আজ তুলনা করিয়া দেখিবার সুযোগ পাইয়া দিদির প্রতি অত্যন্ত করুণায় তাহার মনটা যেন গলিয়া গেল। তাহার পয়সা থাকিলে সে দিদিকে একটা কলের ঘোড়া কিনিয়া দিত-আর একটা রবারের বাঁেদর…তুমি যেদিকে যাও, তোমার দিকে চাহিয়া সেটা চোখ পিট্‌পিট্‌ করে…

বধূর কাছে একজোড়া পুরানো তাস ছিল, ঠিক একজোড়া বলা চলে না, সেটা নানা জোড়া তাসের পরিত্যক্ত কাগজগুলি এক জায়গায় জড়ো করা আছে মাত্র-অপু সেগুলি লইয়া মধ্যে মধ্যে নাড়ে চাড়ে। রানুদির বাড়িতে মাঝে মাঝে দুপুরবেলা তাসের আডিডা বাসিত, সে বসিয়া বসিয়া খেলা দেখিত। টেক্কা, গোলাম, সাহেব, বিবি-কাগজ ধরা লইয়া মারামারি হয়।–বেশী খেলা! সে তাস খেলিতে জানে না, তাহার মা দিদি কেহই জানে না। এক-এক দিন তাহার মা তাস খেলিতে যায়, তাহার মাকে লইয়া কেহ বসিতে চায় না, সকলে বলে, ও কিছু খেলা জানে না; এক এক দিন তাহার মা তাস খেলিতে বসে, এমন ভাব দেখায় যেন সে খুব পাকা খেলোয়াড়-খানিকক্ষণ পরেই কিন্তু ধরা পড়ে। কেউ বলে, ও বৌ, একি? এখানে টেক্কা মেরে বসলে যে! দেখলে না ও-হাতে রংয়ের গোলাম কাঁটুলে?–তোমার চোখের সামনে যে? তাহার মা তাড়াতাড়ি অজ্ঞতা ঢাকিতে যায়, হাসিয়া বলে, তাই তো! বড় তো ভুল হয়ে গেছে, ও ঠাকুরঝি, মোটেই তো মনে নেই। পরে সে আবার খেলিতে থাকে, মুখ টিপিয়া হাসে, এর ওর দিকে চায়, এমন ভাবটা দেখায় যে তাহার কাছে সকলের হাতের তাসের খবরই আছে, এবার একটা কিছু না করিয়া সে ছাড়িবে না-কিন্তু খানিকটা পরে একজন অবাক হইয়া বলিয়া উঠে-একি বৌমা, দেখি? ওমা আমার কি হবে! তোমার হাতে যে, এমন বিস্তি ছিল, দেখাওনি?–তাহার মা মুখ টিপিয়া হাসিয়া বিজ্ঞের ভাব করিয়া বলে,–আছে, আছে, ওর মধ্যে একটা কথা আছে! ইচ্ছে করেই দেখাই নি। সে আসলে বিন্তি কিসে হয় সব জানে না।–তাহার খেলুড়ে রাগ করিয়া বলে-ওর মধ্যে আবার কথাটা কি শুনি? এমন হাতটা নষ্ট কল্লে? দাও তুমি তাস সেজবৌকে, দাও, তোমার আর খেলতে হবে না-ঢ়ের হয়েছে। তাহার মা অপমান ঢাকিতে গিয়া আবার হাসে-যেন কিছুই হয় নাই, সবই ঠাট্টা, উহারা ঠাট্টা করিয়া বলিতেছে, সেও সেই ভাবেই লইতেছে।…

175 Shares