পথের পাঁচালী

সে যদি একজোড়া তাস পায় তবে, সে, মা ও দিদি খেলে। খাওয়া-দাওয়ার পর দুপুরবেলা তাদের বাড়ির বনের ধারের দিকের সেই জানালোটা.যেটার কবাটগুলোর মধ্যে কি পোকায় কাটিয়া সরিষার মতো গুঁড়া করিয়া দিয়াছে…নাড়া দিলে ঝুরঝুর করিয়া ঝরিয়া পড়ে, পুরানো কাঠের গুঁড়ার গন্ধ বার হয়—জানালার ধারের বন থেকে দুপুরের হাওয়ায় গন্ধভেদালি লতার কটু গন্ধ আসে, রোয়াকের কালমেঘের গাছের জঙ্গলে দিদির পরিচিত কাঁচপোকাটা একবার ওড়ে, আবার বসে, আবার ওড়ে আবার বসে-নির্জন দুপুরে তারা তিনজনে সেই জানালাটির ধারে মাদুর পাতিয়া বসিয়া আপন মনে তাস খেলিবে। কিসে কিসে বিস্তি হয় তাদের নাই-বা থাকিল জানা, তাদের খেলায় বিস্তি না দেখাইতে পারিলেও চলিবে- সেজন্য কেহ কহাকেও উঠাইয়া দিবে না, কোন অপমানের কথা বলিবে না, কোন হাসি-বিদ্যুপ করিবে না, যে যেরূপ পারে সেইরূপই খেলিবে। খেলা লইয়া কথা-নাই বা হইল বিন্তি দেখানো!

সন্ধার পরে বধূর ঘরে অপুর নিমন্ত্রণ ছিল। খাইতে বসিয়া খাবার জিনিসপত্র ও আয়োজনের ঘটা দেখিয়া সে অবাক হইয়া গেল। ছোট একখানা ফুলকাটা রেকবিতে আলাদা করিয়া নুন ও নেবু কেন? নুন নেবু তো মা পাতেই দেয়। প্রত্যেক তরকারির জন্যে খাবার আলাদা আলাদা বাটি!— তরকারিই বা কত! অত বড় গলদা চিংড়ির মাথাটা কি তাহার একার জন্য?

লুচি! লুচি। তাহার ও তাহার দিদির স্বপ্নকামনার পারে এক রূপকথার দেশের নীল-বেলা আবছায়া দেখা যায়.কত রাতে, দিনে, ওলের ডাটোচচ্চড়ি ও লাউ-হেঁচকি দিয়া ভাত খাইতে খাইতে, কত জল-খাবার-খাওয়া-শূন্য সকালে বিকালে, অন্যমনস্ক মন হঠাৎ লুব্ধ উদাস গতিতে ছুটিয়া চলে সেখানে-যেখানে গরম রোদে দুপুরবেলা তাহদের পাড়ার পাকা রাঁধুনী বীবু রায় গামছা কঁধে ঘুরিয়া বেড়ায়, সদ্য তৈয়ারি বড় উনুনের উপর বড় লোহার কড়াই-এ ঘি চাপানো থাকে, লুচিভাজার অপূর্ব সুধা-বুচি-ত্মাণ আসে, কত ছেলেমেয়ে ভালো কাপড়-জামা পরিয়া যাতায়াত করে, গাঙ্গুলি বাড়ির বড় নাটমন্দির ও জলপাই-তলা বিছাইয়া গ্ৰীষ্মের দিনে শতরঞ্চ পাতা হয়, একদিন মাত্র বছরে সে দেশের ঠিকানা খুঁজিয়া মেলে-সেই চৈত্র বৈশাখ মাসে রামনবমী দোলের দিনটাতাহাদের সেদিন নিমন্ত্রণ থাকে ওপাড়ার গাঙ্গুলি বাড়ি। কিন্তু আজ সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত ভাবে সে সুদিনের উদয় হইল কি করিয়া! খাইতে বসিয়া বার বার তাহার মনে হইতেছিল, আহা, তাহার দিদি। এ রকম খাইতে পায় নাই কখনও!

পরদিন সকালে আবার খেলা আরম্ভ হইল। অমলা আসিতেই অপু ছুটিয়া গিয়া তাহার হাত ধরিল-আমি আর অমলাদি একদিকে, আর তোমরা সব একদিকে–

খানিকটা খেলা হইবার পর অপুর মনে হইল অমলা তাহাকে দলে পাওয়ার অপেক্ষা বিশ্বকে দলে পাইতে বেশি ইচ্ছক। ইহার প্রকৃত কারণ অপু জানিত না-অপু একেবারে কাঁচা খেলুড়ে, তাহাকে দলে লওয়ার মানেই পরাজয়-বিশ্ব ডানপিটে ছেলে, তাহাকে দৌড়িয়া ধরা কি খেলায় হারানো সোজা নয়। একবার অমলা স্পষ্টই বিরক্তি প্রকাশ করিল। অপু প্ৰাণপণে চেষ্টা করিতে লাগিল যাহাতে সে জেতে, যাহাতে আমলা সন্তুষ্ট হয়-কিন্তু বিস্তর চেষ্টা সত্ত্বেও সে আবার হারিয়া গেল।

সে-বার দল গঠন করিবার সময় অমলা ঝুঁকিল বিশুর দিকে।

অপুর চোখে জল ভরিয়া আসিল। খেলা তাহার কাছে হঠাৎ বড় বিস্বাদ মনে হইল-অমলা বিশুর দিকে ফিরিয়া সব কথা বলিতেছে, হাসিখুশি সবই তাহার সঙ্গে। খানিকটা পরে বিশু কি কাজে বাড়ি যাইতে চাহিলে অমলা তাহাকে বার বার বলিল যে, সে যেন আবার আসে। অপুর মনে অত্যন্ত ঈর্ষ হইল, সারা সকালটা একেবারে ফাঁকা হইয়া গেল! পরে সে মনে মনে ভাবিল-বিশৃণু খেলা ছেড়ে চলে যাচ্ছে-গেলে খেলার খেলুড়ে কমে যাবে, তাই অমলাদি ওইরকম বলচে, আমি গেলে আমাকেও বলবে, ওর চেয়েও বেশি বলবে। হঠাৎ সে চলিয়া যাইবার ভান করিয়া বলিল-বেলা হয়ে যাচ্ছে, আমি যাই, নাইবো।

অমলা কোনো কথা বলিল না, কেবল কামারদের ছেলে নাড়ুগোপাল বলিল-আবার ওবেলা এসো ভাই!

অপু খানিক দূর গিয়া একবার পিছনে চাহিল।–তাহাকে বাদ দিয়া কাহারও কোনো ক্ষতি হয় নাই, পুরাদমে খেলা চলিতেছে, অমলা মহা উৎসাহে খুঁটির কাছে বুড়ি হইয়া দাঁড়াইয়াছে—তাহার। দিকে ফিরিয়াও চাহিতেছে না।

অপু আহত হইয়া অভিমানে বাড়ি আসিয়া পৌঁছিল, কাহারও সঙ্গে কোনো কথা বলিল না। ভারি তো অমলাদি। না চাহিল তাহাকে-তাতেই বা কি?..

দুই দিন পরে হরিহর ছেলে লইয়া বাড়ি আসিল।

এই মোটে কয়দিন, এরই মধ্যে সর্বজয়া ছেলেকে না দেখিয়া আর থাকিতে পারিতেছিল না।

দুৰ্গার খেলা কয়দিন হইতে ভালোরকম জমে নাই, অপুর বিদেশ-যাত্রার দিনকতক আগে দেশী কুমড়ার শূকনো খোলার নীেকা লইয়া ঝগড়া হওয়াতে দুজনের মুখ দেখাদেখি বন্ধ হইয়া গিয়াছিলএখন আরও অনেক কুমড়ার খোলা জমিয়াছে, দুর্গা কিন্তু আর সেগুলি জলে ভাসাঁইতে ঝায় নাকেন মিছিমিছি এ নিয়ে ঝগড়া করে তার কান ম’লে দিলাম? আসুক সে ফিরে, আর কক্ষনো তাব সঙ্গে ঝগড়া নয়, সব খোলা সেই নিয়ে নিক।

বাড়ি আসিয়া অপু দিন পনেরো ধরিয়া নিজের অদ্ভুত ভ্ৰমণকাহিনী বলিয়া বেড়াইক্ষে লাগিল। কত আশ্চর্য জিনিস সে দেখিয়াছে এই কয়দিনে! রেলের রাস্তা, যেখান দিয়া সত্যিকারের রেলগাড়ি যায়! মাটির আতা, পেঁপে, শস্য-অবিকল যেন সত্যিকার ফল। সেই পুতুলটা, যেটার পেট টিপিলে। মৃগীরোগীর মতো হাত-পা ছুড়িয়া হঠাৎ খঞ্জনী বাজাইতে শুরু করে! অমলাদি। কতদূর যে সে গিয়াছিল, কত পদ্মফুলে ভরা বিল, কত অচেনা নতুন গা পার হইয়া কত মাঠের উপরকার নির্জন পথ বাহিয়া, সেই যে কোন গাঁয়ে পথের ধারের কামার-দোকানে বাবা তাহাকে জল খাওয়াইতে লইয়া গেলে, তাহারা তাহাকে বাড়ির মধ্যে ডাকিয়া লইয়া গিয়া যত্ন করিয়া পিঁড়ি পাতিয়া বসাইয়া দুধ, চিড়ে, বাতাসা খাইতে দিয়াছিল! কোনটা ফেলিয়া সে কোনটার গল্প করে!

রেলরাস্তার গল্প শুনিয়া তাহার দিদি মুগ্ধ হইয়া যায়, বার বার জিজ্ঞাসা করে-কত বড় নোয়াগুনো দেখলি অপু? তার টাঙানো বুঝি? খুব লম্বা? রেলগাড়ি দেখতে পেলি? গেল?

না-রেলগাড়ি অপু দেখে নাই। ওইটাই কেবল বাদ পড়িয়াছে—সে শুধু বাবার দোষে। মোটে ঘণ্টা চার-পাঁচ রেলরাস্তার ধারে চুপ করিয়া বসিয়া থাকিলেই রেলগাড়ি দেখা যাইত-কিন্তু বাবাকে সে কিছুতেই বুঝাইয়া উঠিতে পারে নাই।

বেলা হইয়া যাওয়াতে ব্যস্ত অবস্থায় সর্বজযা তাড়াতাড়ি অন্যমনস্কভাবে সদর দরজা দিয়া ঢুকিয়া উঠানে পা দিতেই কি যেন একটা সরু দড়ির মতো বুকে আটকাইল ও সঙ্গে সঙ্গে কি যেন একটা পটাং করিয়া ছিঁড়িয়া যাইবার শব্দ হইল এবং দুদিক হইতে দুটা কি, উঠানে ঢিলা হইয়া পড়িয়া গেল। সমস্ত কার্যটি চক্ষের নিমেষে হইয়া গেল, কিছু ভালো করিয়া দেখিবার কি বুঝিবার পূর্বেই।

অল্পখানিক পরেই অপু বাড়ি আসিল। দরজা পার হইয়া উঠানে পা দিতেই সে থমকাইয়া দাঁড়াইয়া গেল—নিজের চক্ষুকে বিশ্বাস করিতে পারিল না-এ কি! বা রে, আমার টেলিগিরাপের তার ছিঁড়লে কে?

ক্ষতির আকস্মিকতায্য ও বিপুলতায় প্রথমটা সে কিছু ঠাহর করিতে পারিল না। পরে একটু সামলাইয়া লইয়া চাহিযা দেখিল উঠানের মাটিতে ভিজা পায্যের দাগ এখনও মিলায় নাই। তাহাব মনের ভিতর হইতে কে ডাকিয়া বলিল—ম ছাড়া আর কেউ নয়। ককখনো আর কেউ নয়, ঠিক মা! বাড়ি ঢুকিযা সে দেখিল মা বসিয়া বসিযা বেশ নিশ্চিন্ত মনে কাঁঠালবীচি ধুইতেছে। সে হঠাৎ দাঁড়াইয়া পড়িল এবং যাত্রা দলের অভিমনুর মতো ভঙ্গিতে সামনেব দিকে ঝুঁকিয়া বাঁশির সপ্তমের মতো রিনারিনে তীব্র মিষ্টসুবে কহিল-আচ্ছা মা, আমি কষ্ট করে ছোটাগুলো বুঝি বন বাগান ঘেঁটে নিয়ে আসি নি?

সর্বজয়া পিছনে চাহিয়া বিস্মিতভাবে বলিল–কি নিয়ে এসেচিস? কি হয়েচে—

আমার বুঝি কষ্ট হয় না? কীটায় আমার হাতপা ছড়ে যায় নি বুঝি?

–কি বলে পাগলের মতো? হযেচে কি?

—কি হয়েচে! আমি এত কষ্ট করে টেলিগিরাপের তার টাঙালাম আর ছিড়ে দেওয়া হয়েচে না?

—তুমি যত উদঘুট্টি কাণ্ড ছাড়া তো এক দণ্ড থাকো না বাপু!-পথের মাঝখানে কি টাঙানো রয়েচে-কি জানি টেলিগিরিাপ কি কি-গিরাপ, আসচি তাড়াতাড়ি ছিড়ে গেল।–তা এখন কি করবো বলো–

পরে সে পুনরায় নিজ কাজে মন দিল।

উঃ! কি ভীষণ হৃদয়হীনতা! আগে আগে সে ভাবিত বটে যে, তাহার মা তাহাকে ভালোবাসে। অবশ্য যদিও তাহার সে ভ্রান্ত ধারণা অনেকদিন ঘুচিয়া গিয়াছে—তবুও মাকে এতটা নিষ্ঠুর পাষাণীরূপে। কখনও স্বপ্নেও কল্পনা করে নাই। কাল সারাদিন কোথায় নীলমণি জেঠার ভিটা, কোথায় পালিতদের বড় আমবাগান, কোথায় প্রসন্ন গুরুমহাশয়ের বাঁশবন-ভয়ানক ভয়ানক জঙ্গলে একা ঘুরিয়া বহু কষ্ট উঁচু ডাল হইতে দোলানো গুলঞ্চলত কত কষ্টে জোগাড় করিয়া সে আনিল, এখুনি রোল-রেল খেলা হইবে, সব ঠিকঠাক, আর কি না…

175 Shares