পথের পাঁচালী

হঠাৎ সে মাকে একটা খুব কড়া, খুব রূঢ়, খুব একটা প্ৰাণ-বিধানো কথা বলিতে চাহিল—এবং খানিকটা দাঁড়াইয়া বোধ হয় অন্য কিছু ভাবিয়া না পাইয়া আগের চেয়েও তীব্র নিখাদে বলিল-আমি আজ ভাত খাবো না যাও-কখখনো খাবো না–

তাহার মা বলিল-মা খাবি না খাবি যা-ভাত খেয়ে একেবারে রাজা করে দেবেন। কিনা? এদিকে তো রান্না নামাতে তার সয় না-না খাবি যা, দেখবো ক্ষিদে পেলে কে খেতে দ্যায়?

ব্যস! চক্ষের পলকে-সব আছে, আমি আছি তুমি আছ–সেই তাহার মা কাঁটালবীচি ধুইতেছে-কিন্তু অপু কোথায়? সে যেন কপূরের মতো উবিয়া গেল! কেবল ঠিক সেই সময়ে দুর্গা বাড়ি ঢুকিতে দরজার কাছে তাহাকে পাশ কাটাইয়া ঝড়ের বেগে বাহির হইয়া যাইতে দেখিয়া বিস্মিত সুরে ডাকিয়া বলিল-ও অপু, কোথায় যাচ্ছিস আমন করে, কি হয়েচে, ও অপু শোন–

তাহার মা বলিল-জানিনে আমি, যত সব অনাছিষ্ট কাণ্ড বাপু তোমাদের, হাড় মাস কালি হয়ে গেল।–কি এক পথের মাঝখানে টাঙিয়ে রেখেচে, আসচি, ছিড়ে গেল-তা এখন কি হবে? আমি কি ইচ্ছে করে ছিাঁড়চি? তাই ছেলের রাগ-আমি ভাত খাবো না-না খাস যা, ভাত খেয়ে সব একেবারে স্বগগে ঘণ্টা দেবে কিনা তোমরা?

মাতাপুত্রের এরূপ অভিমানের পালায় দুৰ্গাকেই মধ্যস্থ হইতে হয়-সে। অনেক ডাকাডাকির পরে বেলা দুইটার সময় ভাইকে খুঁজিয়া বাহির করিল। সে শুল্কমুখে উদাসীনয়নে ও-পাড়ার পথে রায়েদের বাগানে পড়ন্ত আমগাছের গুড়ির উপর বসিয়া ছিল।

বৈকালে যদি কেহ আপুদের বাড়ি আসিয়া তাহাকে দেখিত তবে সে কখনই মনে করিতে পারিত না যে, এ সেই অপু-যে আজ সকালে মায়ের উপর অভিমান করিয়া দেশত্যাগী হইয়াছিল। উঠানের এ-প্ৰস্ত হইতে ও-প্রাস্ত পর্যন্ত তার টাঙানো হইয়া গিয়াছে। অপু বিস্মযের সহিত চাহিয। চাহিয়া দেখিতেছিল, কিছুই বাকি নাই, ঠিক যেন একবারে সত্যিকার রেলরাস্তার তার।

সে সতুদের বাড়ি গিয়া বলিল-সতুদা, আমি টেলিগিরাপের তার টাঙিয়ে রেখেচি আমাদের বাড়িব উঠানে, চল রেল-রেল খেলা করি–আসবে?

–তার কে টাঙিয়ে দিল রে?

–আমি নিজে টাঙালাম। দিদি ছোটা এনে দিয়েছিল—

সতু বলিল-তুই খেলগে যা, আমি এখন যেতে পাববো না—

অপু মনে মনে বুঝিল, বড় ছেলেদের ড্রাকিযা দল বাঁধিয খেলার জোগাড় করা তাহাব কর্ম নয়। কে তাহার কথা শুনিবে? তবুও আর একবার সে সত্যুর কাছে গেল। নিরাশ মুখে রোয়াকের কোণটা ধরিয়া নিরুৎসাহভাবে বলিল-চল না। সত্যুদ, যাবে? তুমি আমি আর দিদি খেলবো এখন? পরে সে প্রলোভনজনক ভাবে বলিল-আমি টিকিটের জন্যে এতগুলো বাতাবি নেবুব পাতা তুলে এনে রেখেচি। সে হাত ফাক করিয়া পরিমাণ দেখাইল।-যাবে?

সতু আসিতে চাহিল না। অপু বাহিরে বড় মুখ-চোরা, সে আর কিছু না বলিয়া বাড়ি ফিরিয়া গেল। দুঃখে তাব চোখে প্রায় জল আসিতেছিল-এত করিয়া বলিতেও সতুদা শুনিল না!

পরদিন সকালে সে ও তাহার দিদি দুজনে মিলিয়াইট দিয়া একটা বড় দোকানঘর বাঁধিয়া জিনিসপত্রের জোগাড়ে বাহির হইল। দুৰ্গা বনজঙ্গলে উৎপন্ন দ্রব্যের সন্ধান বেশি রাখে-দুজনে মিলিয়া নোনাপাতার পান, মোট আলু, ফলের আলু, রাধালতা ফুলের মাছ, তেলাকুচির পটল, চিচ্চিড়ের বরবটি, মাটির ঢেলার সৈন্ধব লবণ-আরও কত কি সংগ্ৰহ করিয়া আসিয়া দোকান সাজাইতে বড় বেলা করিয়া ফেলিল। অপু বলিল-চিনি কিসের করবি রে দিদি?

দুৰ্গা বলিল-বাঁশতলার পথে সেই টিবিটায় ভালো বালি আছে-মা চাল-ভাজা ভাজাবার জন্যে আনে! সেই বালি চল আনি গো-সাদা চক চক করচে-ঠিক একেবারে চিনি–

বাঁশবনে চিনি খুঁজিতে খুঁজতে তাহারা পথের ধারের বনের মধ্যে ঢুকিল। খুব উঁচু একটা বন, চটকা গাছের আগাড়ালে একটা বড় লতার ঘন সবুজ আড়ালে, টুকটুকে রাঙা, বড় বড় সুগোল কি ফল দুলিতেছে। অপু ও দুৰ্গা দুজনেই দেখিয়া অবাক হইয়া গেল। অনেক চেষ্টায় গোটা কয়েক ফল নিচের দিকে লতার খানিকটা অংশ ছিঁড়য়া তলায় পড়িতেই মহা আনন্দে দুজনে একসঙ্গে ছুটিয়া গিয়া সেগুলিকে মাটি হইতে তুলিয়া লইল।

পাকা ফল মোটে তিনটি। প্ৰধানত বিপণি-সজ্জার উদ্দেশ্যেই তাহা দোকানে এরূপ ভাবে রক্ষিত হইল যে, খরিদার আসিলে প্রথমেই যেন নজরে পড়ে। পুরাদমে বেচাকেনা আরম্ভ হইয়া গেল। দুৰ্গা নিজেই পান কিনিয়া দোকানের পান প্ৰায় ফুরাইয়া ফেলিল। খেলা খানিকটা অগ্রসর হইয়াছে এমন সময় সদর দরজা দিয়া সতুকে ঢুকিতে দেখিয়া অপু মহা আনন্দে তাহাকে আগাইয়া আনিতে দৌড়িয়া গেল—ও সত্যুদা, দ্যাখো না কি রকম দোকান হয়েচে, কেমন ফল দ্যাখো। আমি আর দিদি পেড়ে আনলাম-কি ফল বলো দিকি? জানো?

সতু বলিল-ও তো মাকাল ফল-আমাদের বাগানে ক-ত ছিল!

সতু আসিতে অপু যেন কৃতাৰ্থ হইয়া গেল। সত্যুদা তাহাদের বাড়িতে তো বড় একটা আসে না-তা ছাড়া সত্যুদা বড় ছেলেদের দলের চাই। সে আসাতে খেলার ছেলেমানুষিটুকু যেন ঘুচিয়া গেল।|

অনেকক্ষণ পুরা মরসুমে খেলা চলাবার পর দুৰ্গা বলিল-ভাই আমাকে দুমণ চাল দাও, খুব সবু, কাল আমার পুতুলের বিয়ের পাকা দেখা, অনেক লোক খাবে—-

সতু বলিল-আমাদের বুঝি নেমন্তন্ন, না?

দুৰ্গা মাথা দুলাইয়া বলিল-না বই কি! তোমরা তো হলে কনে-যাত্রী-কাল সকালে এসে নকুতো করে নিয়ে যাবো—সতুদা, রানুকে বলবে আজ রাত্তিরে যেন একটু চন্দন বেটে রাখে। কাল সকালে নিয়ে আসব–

দুৰ্গার কথা ভালো কবিয়া শেষ হয় নাই এমন সময় সন্তু দোকানে বিক্রয়ার্থ রক্ষিত পণ্যেৰ মধ্য হইতে কি-একটা তুলিয়া লইয়া হঠাৎ দৌড় দিয়া দরজার দিকে ছুটিল-সঙ্গে সঙ্গে অপুও, ওরে দিদি রে-নিয়ে গেল রে—বলিয়া তাহার রিনারিনে তীব্র মিষ্ট গলায় চিৎকার করিতে করিতে তাহার পিছনে পিছনে ছুটিল।

বিস্মিত দুৰ্গা ভালো করিয়া ব্যাপাবটা কি বুঝিবার আগেই সন্তু ও অপু দৌড়াইয়া দরজার বাহির হইয়া চলিয়া গেল! সঙ্গে সঙ্গে খেলাঘরের দিকে চোখ পড়িতেই দুৰ্গা দেখিল, সেই পাকা মাকাল ফল তিনটির একটিও নাই!..

দুৰ্গা একছুটে দরজার কাছে আসিয়া দেখিল, সন্তু গাবতলার পথে আগে আগে ও অপু তাহা হইতে অল্প নিকটে পিছু পিছু ছুটিতেছে। সত্যুর বয়স অপুর চেয়ে তিন চার বৎসরের বেশি, তাহা ছাড়া সে অপুর মতো ওরকম ছিপছিপে মেয়েলি গড়নের ছেলে নয়।–বেশ জোরালো হাত-পা- ওয়ালা ও শক্ত-তাহার সহিত ছুটিয়া অপুর পারিবার কথা নহে-তবুও যে সে ধরি-ধরি করিয়া তুলিয়াছে, তাহার একমাত্র কারণ এই যে সন্তু ছুটিতেছে। পরের দ্রব্য আত্মসাৎ করিয়া এবং অপু ছুটিতেছে প্ৰাণের দায়ে।

হঠাৎ দুৰ্গা দেখিল যে সন্তু ছুটিতে ছুটিতে পথে একবারটি যেন নিচু হইয়া পিছনে ফিরিয়া চাহিল—সঙ্গে সঙ্গে অপুও হঠাৎ দাঁড়াইয়া পড়িল-সন্তু ততক্ষণ ছুটিয়া দৃষ্টির বাহির হইয়া চালতেতলার পথে গিয়া পড়িয়াছে।

দুর্গা ততক্ষণে দৌড়িয়া গিয়া অপুর কাছে পৌঁছিল। অপু একদম চোখ বুজিয়া একটু সামনের দিকে নিচু হইয়া বুকিয়া দুই হাতে চোখ রাগড়াইতেছে-দুৰ্গা বলিল-কি হয়েছে রে অপু?

অপু ভালো করিয়া চোখ না চাহিয়াই যন্ত্রণার সুরে দু’হাত দিয়া চোখ রগড়াইতে রাগড়াইতে বলিল-সতুদা চোখে ধুলো ছুড়ে মেরেচে। দিদি-চোখে কিছু দেখতে পাচ্ছি না রে—

দুৰ্গা তাড়াতাড়ি অপুর হাত নামাইয়া বলিল-সরসর দেখি-ওরকম করে চোখ রাগড়াস নে, দেখি?–

অপু তখনই দু’হাত আবার চোখে উঠাইয়া আকুল সুরে বলিল-উষ্ণু ও দিদি-চোখের মধ্যে কেমন হচ্ছে-আমার চোখ কানা হয়ে গিয়েচে দিদি–

–দেখি দেখি ওরকম করে চোখে হাত দিসনে-সর-পরে সে কাপড়ে ফু পাড়িয়া চোখে ভাপ দিতে লাগিল। কিছু পরে অপু একটু একটু চোখ মেলিয়া চাহিতে লাগিল-দুর্গা তাহার চোখের পাতা তুলিয়া অনেকবার ফু দিয়া বলিল-এখন বেশ দেখতে পাচ্ছিস?–আচ্ছা তুই বাড়ি যা..আমি ওদের বাড়ি গিয়ে ওর মাকে আর ঠাকমাকে সব বলে দিয়ে আসচি-রানুকেও বলবো-আচ্ছা দুষ্ট ছেলে তো-তুই যা আমি আসছি। এখখনি—

রানুদের খিড়কি দরজা পর্যন্ত অগ্রসর হইয়া দুর্গা কিন্তু আর যাইতে সাহস করিল না। সেজঠাকুবুনকে সে ভয় করে। খানিকক্ষণ খিড়কির কাছে দাঁড়াইয়া ইতস্তত করিয়া সে বাড়ি ফিরিল। সদর দরজা দিয়া ঢুকিয়া সে দেখিল অপু দরজার বাম ধারের কবাটখানি একটুখানি সামনে ঠেলিয়া দিয়া তাহারই আড়ালে দাঁড়াইয়া নিঃশব্দে কাঁদিতেছে। সে ছিচৰ্কাদুনে ছেলে নয়, বড় কিছুতেই সে কখনও কঁদে না-রাগ করে, অভিমান করে বটে, কিন্তু কঁদে না। দুৰ্গা বুঝিল আজ তাহার অত্যন্ত দুঃখ হইয়াছে, অত সাধের ফলগুলি গেল…তাহা ছাড়া আবার চোখে ধূলা দিয়া এরূপ অপমান করিল! অপুর কান্না সে সহ্য করিতে পারে না।–তাহার বুকের মধ্যে কেমন যেন করে।

সে গিয়া ভাইয়ের হাত ধরিল-সান্ত্বনার সুরে বলিল-কাঁদিস নে অপু-আয় তোকে আমার সেই কড়িগুলো সব দিচ্চি-আয়-চোখে কি আর ব্যথা বাড়চে?…দেখি, কাপড়খানা বুঝি ছিড়ে ফেলেচিস?

175 Shares