পথের পাঁচালী

এই অপরাহুগুলির সঙ্গে আজন্মসাখী সুপরিচিত এই আনন্দভরা বহুরূপী বনটার সঙ্গে কত রহস্যময়, স্বপ্ন-দেশের বার্তা যে জড়ানো আছে! বাঁশঝাড়ের উপরকার ছায়া-ভরা আকাশটার দিকে চাহিয়া সে দেখিতে পায়, এক তরুণ বীরের উদারতার সুযোগ পাইয়া কে প্রাথী একজন তাহার অক্ষয় কবচ-কুণ্ডল মাগিয়া লইতে হাত পাতিয়াছে, পিটুলি-গোলা পান করিয়া কোথাকার এক ক্ষুদ্র দরিদ্র বালক খেলুড়েদের কাছে দুধ খেয়েছি, দুধ খেয়েছি বলিয়া উল্লাসে নৃত্য করে-ওই যে গ্লোড়ো ভিটার বেলতলাটা-ওইখানেই তো শরশয্যাশায়িত প্ৰবীণ বীর ভীষ্মদেবের মরণাহত ওষ্ঠে তীক্ষ্ণবাণে পৃথিবী ফুড়িয়া অৰ্জ্জুন ভোগবতীধারা সিঞ্চন করিয়াছিলেন। প্রথম যৌবনে সরযুতািটর কুসুমিত কাননে মৃগয়া করিতে গিয়া রাজা দশরথ মৃগভ্ৰমে যে জল আহরণগত দরিদ্র বালককে বধ করেন-সে ঘটিয়াছিল ওই রানুদিদিদের বাগানের বড় জাম গাছটার তলায় যে ডোবা-তাহারই ধারে।

তাহাদের বাড়ি একখানা বই আছে, পাতাগুলো সব হলদে, মলাটটার খানিকটা নাই, নাম লেখা আছে ‘বীরাঙ্গনা কাব্য’, কিন্তু লেখকের নাম জানে না, গোড়ার দিকের পাতাগুলি ছিঁড়িয়া গিয়াছে। বইখানা বড় ভালো লাগে।–তাহাতে সে পড়িয়াছে–

অদূরে দেখিানু হ্রদ, সে হ্রদের তীরে

রাজরথী একজন যান গড়াগড়ি

ভগ্নঊরু! দেখি উচ্চে উঠিনু কাঁদিয়া

এ কি কুস্বপন নাথ দেখাইলা মোরে!

কলুইচণ্ডী ব্ৰতের দিন মায়ের সঙ্গে গ্রামে উত্তর মাঠে যে পুরানো মজা পুকুরের ধারে সে বনভোজন করিতে যায়-কেউ জানে না-চারিধারে বনে ঘেরা সেই ছোট্ট পুকুরটাই মহাভারতের সেই দ্বৈপায়ন হ্রদ। ওই নির্জন মাঠের পুকুরটার মধ্যে সে ভগ্নউবু, অবমানিত বীর থাকে একা একা, কেউ দেখে না, কেউ খোঁজ করে না। উত্তর মাঠের কলাবেগুনের ক্ষেত হইতে কৃষাণেরা ফিরিয়া আসে, জনমানুষের চিহ্ন থাকে না কোনো দিকে-সোনাডাঙা মাঠের পারের অনাবিষ্কৃত, বসতিশূন্য, অজানা দেশে চন্দ্ৰহীন রাত্রির ঘন অন্ধকার ধীরে ধীরে বিস্তার লাভ করে, তখন হাজার হাজার বছরের পুরাতন মানব-বেদনা কখনও বা দরিদ্র পিতার প্রবঞ্চনা-মুগ্ধ অবোধ বালকের উল্লাসে, কখনও বা এক ভাগ্যহত, নিঃসঙ্গ অসহায় রাজপুত্রের ছবিতে তাহার প্রবর্ধমান, উৎসুক মনের সহানুভূতিতে জাগ্রত ও সার্থক হয়। ওই অজ্ঞাতনামা লেখকের বইখানা পড়িতে পড়িতে কতদিন যে তাহার চোখের পাতা ভিজিয়া আসিয়াছে!

তাহার বাবা বাড়ি নাই। বাড়ি থাকিলে তাহাকে এক মনে ঘরে বসিয়া দপ্তর খুলিয়া পড়িতে হয়। একেবারে বেলা শেষ হইয়া যায়। তবুও ছুটি হয় না। তাহার মন ব্যাকুল হইয়া ওঠে। আর কতক্ষণ বসিয়া বসিয়া শুভঙ্করীর আর্য মুখস্থ করিবে? আজ আর বুঝি সে খেলা করিবে না? বেলা বুঝি আর আছে? বাবার উপর ভারি রাগ হয়, অভিমান হয়।

হঠাৎ অপ্রত্যাশিত ভাবে ছুটি হইয়া যায়। বইদপ্তর কোনোরকমে ঝুপ করিয়া এক জায়গায় ফেলিয়া রাখিয়া ছায়াভরা উঠানে গিয়া খুশিতে সে নাচিতে থাকে।

অপূর্ব অদ্ভুত বৈকাল ট্রা.নিবিড় ছায়ােভরা গাছপালার ধারে খেলাঘর.গুলঞ্চলতার তার টাঙানো… খেজুর ডালের বাঁপ…বনের দিক থেকে ঠাণ্ড ঠাণ্ডা গন্ধ বাহির হয়.রাঙা রোদটুকু জেঠমহাশয়দের পোড়ো ভিটায় বাতাবিলেবু গাছের মাথায় চিক্‌ চিক করে…চকচকে বাদামী রঙ-এর ডানাওয়ালা তেড়ো পাখি বনকলামি ঝোপে উড়িয়া আসিয়া বসে…তাজা মাটির গন্ধ…ছেলেমানুষের জগৎ ভরপুর আনন্দে উছলিয়া ওঠে, কাহাকে সে কি করিয়া বুঝাইবে সে কি আনন্দ!

সন্ধ্যার পর সর্বজয়া ভাত চড়াইয়াছিল। অপু দাওয়ায় মাদুর পাতিয়া বসিয়া আছে। খুব অন্ধকার, একটানা বিবি পোকা ডাকিতেছে।

অপু জিজ্ঞাসা করিল-পুজোর আর কদিন আছে, মা?

দুৰ্গা বঁটি পাতিয়া তরকারি কাটিতেছিল। বলিল, আর বাইশ দিন আছে, না মা?

সে হিসাব ঠিক করিয়াছে। তাহার বাবা বাড়ি আসিবে, অপুর, মায়ের, তাহার জন্য পুতুল, কাপড়, আলতা।

আজকাল সে বড় হইয়াছে বলিয়া তাহার মা অন্য পাড়ায় গিয়া নিমন্ত্রণ খাইতে দেয় না। লুচি খাইতে কেমন তাহা সে প্রায় ভুলিয়া গিয়াছে। ফুটুফুটে কোজাগরী পূর্ণিমার জ্যোৎস্না-ভরা রাত্রে বাঁশবনের আলোছায়ায় জাল-বুনানি পথ বাহিয়া সে আগে আগে পাড়ায় পাড়ায় বেড়াইয়া লক্ষ্মীপূজার খই-মুড়ি ভাজা আঁচল ভরিয়া লইয়া আসিত। বাড়িতে বাড়িতে শাঁখ বাজে, পথে লুচিভাজার গন্ধ বাহির হয়, হয়তো পাড়ার কেউ পূজার শীতলের নৈবেদ্য একখানা তাহাদের বাড়িতে পাঠাইয়া দেয়। সেও অনেক খই-মুড়ি আনিত, তাহার মা দুইদিন ধরিয়া তাহাদের জলপান খাইতে দিত, নিজেও খাইত। সেবার সেজ ঠাকরুন বলিয়াছিল-ভদ্র লোকের মেয়ে আবার চাষা লোকের মতো বাড়ি-বাড়ি ঘুরে খই-মুড়ি নিয়ে বেড়াবে কি? ওসব দেখতে খারাপ.ওরকম আর পাঠিয়ে না। বৌমা-সেই হইতে সে আর যায় না।

দুৰ্গা বলিল-তাস খেলবে?

–তা। যা, ও ঘর থেকে তাসটা নিয়ে আয়, একটু খেলি—

দুৰ্গা বিপন্নমুখে অপুর দিকে চাহিল।

অপু হাসিয়া বলিল-চল আমি দাঁড়াচ্চি—

তাহাদের মা বলিল-আহ্যাঁ-হা, মেয়ের ভয় দেখে আর বাঁচিনে, সারাদিন বলে হেঁটি-মাটি ওপর করে বেড়াবার সময় ভয় থাকে না, আর রাত্ৰিতে এঘর থেকে ওঘর যেতে একেবারে সব আড়ষ্ট;…

শিষ্যবাড়ি হইতে অপুর আনা সেই তাসজোড়াটা। তাস খেলায় তিনজনেরই কৃতিত্ব সমান। অপু এখনও সব রং চেনে না-মাঝে মাঝে হাতের তাস বিপক্ষদলের খেলোয়াড় মাকে দেখাইয়া বলে, এটা কি রং, বুইতন? দ্যাখো না মা–

দুর্গার মন আজ খুব খুশি আছে। রাত্রিতে রান্না প্রায়ই হয় না, ওবেলার বাসি ভাত তবকারি থাকে। আজ ভাত চড়িয়াছে, তরকারি রান্না হইবে, ইহাতে তাহার মহা আনন্দ। আজ যেন একটা উৎসবের দিন। অপু বলিল-তাস খেলতে খেলতে সেই গল্পটা বলে না। মা, সেই শ্যামলঙ্কার গল্পটা?

হঠাৎ সে মায়ের কোলে মাথা রাখিয়া শূইয়া পড়ে। মায়ের গায়ে হাত বুলাইতে বুলাইতে আবদারের সুরে বলে—সেই ছড়াটা বলে না। মা, সেই–শ্যামলঙ্কা বাটনা বাটে মাটিতে লুটায় কেশ।

দুৰ্গা বলে-খেলার সময় ছড়া বললে খেলা কি করে হবে অপু? ওঠ—

সর্বজয়া বলিল-দুগগা, পাতালকোঁড় আজ কোথায় পেলি রে? –সেই যে গোঁসাইদের বড় বাগানটা আছে? সেই রাষ্ট্ৰী গাই খুঁজতে একবার তুই আবি আমি, অপু? সেখানে অনেক ফুটেছিল, কেউ টের পায়নি, মা, খুব বন কি না? তা হলে লোকে তুলে নিয়ে যেত–

অপু বলিল-সেখানে গিইছিলি? উঃ, সে যে বড় বন রে দিদি! ‘

সর্বজয়া সস্নেহে বার বার ছেলের দিকে চাহিয়া দেখিতেছিল। সেদিনকার সেই অপু -আয় চাঁদ আয় চাদ, খোকনের কপালে টি-ই-ই-ই দিয়ে যা—বলিলে বার বার কলের পুতুলের মতো চাদের মতো কপালখনি অঙ্গুলিবদ্ধ হস্তের দিকে ঝুকাইয়া দিত, সে কি না। আজ তাস খেলিতে বসিয়াছে! তাহার কাছে দৃশ্যটা বড় অভিনব ঠেকে। অপু খেলিতে না পারিলে বা আশা করিয়া কোনো পিটু জিতিতে না পারিলে কিংবা অপুর হাতে খারাপ তাসগুলো গিয়া নিজের হাতে ভালো তাস আসিলে, বিপক্ষদলের খেলোয়াড় হইয়াও তাহার মনে কষ্ট হইতেছিল।

দুৰ্গা বলিল-আজ কি হয়েছে জানো মা—

অপু বলিল-যাঃ, তা হলে তোর সঙ্গে আড়ি করবো, বলে দ্যাখ-

–করগে যা আড়ি-শোনো মা, ও পোস্তদানার নাম জানে না, আজ রাজীদের বাড়ি পোস্তদানা রদুরে দিয়েচে, ও বল্পে, কি রাজীদি? রাজী বল্পে, যষ্টিমধু, খেয়ে দ্যাখ-ও খেয়ে এলো মা সেখানে দাঁড়িয়ে, বুঝতে পাল্পে না যে পোস্ত-এমন বোকা-না মা?

অপু মুখে বলিল বটে কিন্তু দিদির সহিত সে আড়ি করিবে না। সেই যে যেদিন তাহাঙ্ক পাকা মাকাল ফলগুলো সত্যুদা লইয়া পলাইয়াছিল, সেদিন তাহার দিদি সারাদিন বন বাগান খুঁজিয়া সন্ধ্যার সময় কোথা হইতে আঁচলে। বাঁধিয়া একরাশ মাকাল ফল আনিয়া তাহার সম্মুখে খুলিয়া দেখাইয়া বলিয়াছিল–কেমন হল এখন? বড় যে কাঁদছিলি সকালবেলা? সে সন্ধ্যায় কিসে সে বেশি আনন্দ পাইয়াছিল—মাকাল ফলগুলো হইতে কি দিদির মুখের, বিশেষ করিয়া তাহার ডাগর চোখের মমতা ভরা স্নিগ্ধ হাসি হইতে-তাহা সে জানে না।

-ছক্কার খেলা অপু বুঝে সুজে খেলিস?-দুর্গা মহাখুশির সহিত তাস কুড়াইয়া সাজাইতে লাগিল।

–কি ফুলের গন্ধ বেরুচ্চে, না দিদি?

তাহাদের মা বলিল, তাহদের জেঠামশায়দের ভিটার পিছনে ছাতিমগাছ আছে, সেই ফুলের গন্ধ। অপু ও দুর্গা দুজনেই আগ্রহের সুরে জিজ্ঞাসা করিল-হ্যাঁ মা, ওই ছাতিমতলায় একবার বাঘ এসেছিল বলেছিলে না? কিন্তু তাহার মা তাড়াতাড়ি তাস ফেলিয়া উঠিয়া বলিল-ওই যাঃ ভাত পুড়ে গেল, ধরাগন্ধ বেরিয়েছে-ভাতটা নামিয়ে দাঁড়া বলচি–

খাইতে বসিয়া দুৰ্গা বলিল-পাতালকোঁড়ের তরকারিটা কি সুন্দর খেতে হয়েচে মা!

তাহার মুখ স্বগীয় তৃপ্তিতে ভরিয়া উঠিল।

সঙ্গে সঙ্গে অপুও বলিল-বাঃ খেতে ঠিক মাংসের মতো, না দিদি? পাতালকোঁড় এক জায়গায় কত ফুটে আছে মা, আমি ভাবি ব্যাঙের ছাতা, তাই তুলি নে—

175 Shares