পথের পাঁচালী

উভয়ের উচ্ছসিত প্রশংসা-বাক্যে সর্বজয়ার বুক গর্বে ও তৃপ্তিতে ভরিয়া উঠিল। তবুও কি আর উপযুক্ত উপকরণ সে পাইয়াছে? লোকের বাড়িতে ভোজে রাঁধিতে ডাকে সেজঠাকরুনকে, ডাকুক না দেখি একবার তাহাকে, রান্না কাহাকে বলে সেজঠাকরুনকে সে-হ্যাঁ।

সর্বজয়া বলিল-অপুর হাতে জল ঢেলে দে দুগগা, ও কি ছেলেব কাণ্ড? ওই রাস্তার মাঝখানে মুখ ধোয়? রোজই রাত্ৰে তুমি ওই পথের উপর–

কিন্তু অপু আর এক পাও নড়িতে চাহে না, সম্মুখের সেই ভাঙা পাচিলের ফাক, অন্ধকার বাঁশবন, ঝোপ-জঙ্গলের অন্ধকার ঝিঙের বিচির মতো কালো। পোড়ো ভিটেবাড়ি…আরও অজানা কত কি বিভীষিকা! সে বুঝিতে পারে না যেখানে প্ৰাণ লইয়া টানাটানি সেখানে পথের উপর আঁচানোটাই কি এত বেশি; তাহার পরে সকলে গিয়া ঘুমাইয়া পড়ে। রাত্রি গভীর হয়, ছাতিম ফুলের উগ্র সুবাসে হেমন্তের আঁচ-লাগা শিশিরাদ্র নৈশ বায়ু ভরিয়া যায়। মধ্যরাত্রে বেণুবনশীর্ষে কৃষ্ণপক্ষের চাঁদের স্নান জ্যোৎস্না উঠিয়া শিশিরসিক্ত গাছপালায়, ডালে-পাতায় চিকচিক্‌ করে। আলো-আঁধারের অপরূপ মায়ায় বনপ্রাস্ত ঘুমন্ত পরীর দেশের মতো। রহস্য-ভরা। শন শন করিয়া হঠাৎ হয়তো এক ঝলক হাওয়া সৌদালির ডাল দুলাইয়া, তেলাকুচা ঝোপের মাথা কঁপাইয়া বহিয়া যায়।

এক-একদিন এই সময়ে অপুর ঘুম ভাঙিয়া যাইত।

সেই দেবী যেন আসিয়াছেন, সেই গ্রামের বিস্মৃত অধিষ্ঠাত্রী দেবী বিশালাক্ষী।

পুলিনশালিনী ইছামতীর ডালিমের রোয়ার মতো স্বচ্ছ জলের ধারে, কুচা শ্যাওলা ভরা। ঠাণ্ডা কাদায় কতদিন আগে যাহাদের চরণ-চিহ্ন লুপ্ত হইয়া গিয়াছে, তীরের প্রাচীন সপ্তপর্ণটাও হয়তো যাদের দেখে নাই, পুরানো কালের অধিষ্ঠাত্রী দেবীর মন্দিরে তারাই এক সময়ে ফুল-ফল-নৈবেদ্যে পূজা দিত, আজকালকার লোকেরা কে তাঁহাকে জানে?

তিনি কিন্তু এ গ্রামকে এখনও ভোলেন নাই।

গ্রাম নিযুতি হইয়া গেলে অনেক রাত্রে, তিনি বনে বনে ফুল ফুটাইয়া বেড়ান, বিহঙ্গ-শিশুদের দেখাশুনা করেন, জ্যোৎস্না-রাত্রের শেষ প্রহরে ছোট্ট ছোট্ট মৌমাছিদের চাকগুলি বুনো-ভাওরা, নাটুকান, পুয়ো ফুলের মিষ্ট মধুতে ভরাইয়া দেন।

তিনি জানেন কোন ঝোপের কোণে বাসক ফুলের মাথা লুকাইয়া আছে, নিভৃত বনের মধ্যে ছাতিম ফুলের দল কোথায় গাছের ছায়ায় শূইয়া,ইছামতীর কোন বাঁকে সবুজ শ্যাওলার ফাঁকে ফাঁকে নীল-পাপড়ি কলমিফুলের দল ভিড় পাকাইয়া তুলিতেছে, কঁটা গাছের ডালপালার মধ্যে ছোট্ট খড়ের বাসায় টুনটুনি পাখির ছেলেমেয়েরা কোথায় ঘুম ভাঙিয়া উঠিল।

তার রূপের স্নিগ্ধ আলোয় বন যেন ভরিয়া গিয়াছে। নীরবতায়, জ্যোৎস্নায়, সুগন্ধে, অস্পষ্ট আলো-আঁধারের মায়ায় রাত্রির অপরূপ শ্ৰী।

দিনের আলো ফুটিবার আগেই কিন্তু বনলক্ষ্মী কোথায় মিলাইয়া যান, স্বরূপ চক্ৰবতীর পর তাহাকে কেহ কোনোদিন দেখে নাই।

সপ্তদশ পরিচ্ছেদ

গ্রামের অন্নদা রায় মহাশয় সম্প্রতি বড় বিপদে পড়িয়াছেন।

গ্রামের জরিপ আসাতে উত্তর মাঠে তাঁবু পড়িয়াছে। জরিপের বড় কর্মচারী মাঠের মধ্যে নদীর ধারে অফিস খুলিয়াছেন, ছোটখাটো আমলাও সঙ্গে আসিয়াছে বিস্তর। গ্রামের সকল ভদ্রলোকই কিছু জমিজমার মালিক; পিতৃপুরুষের অর্জিত এই সব সম্পত্তির নিরাপদ কূলে জীবনতরণীর লগি কষিয়া পুঁতিয়ে জড় পদার্থের ন্যায় উদ্যমহীন, গতিহীন নিষ্ক্রিয় অবস্থায় দিনগুলি একরূপ বেশই কাটিতেছিল। কিন্তু এবার সকলেই একটু বিপদগ্ৰস্ত হইয়া পড়িয়াছেন। রাম হয়তো শ্যামের জমি নির্বিবাদে নিজের বলিয়া ভোগ করিয়া আসিতেছে, যদু দশ বিঘার খাজনায় বারো বিঘা নিরুপদ্রবে দখল করিতেছে, এতদিন যাহা পূৰ্ণ শান্তিতে নিম্পন্ন হইতেছিল, এইবার সেই সকলের মধ্যে গোলমাল পৌঁছিল। বিপদ একরূপ সর্বজনীন হইলেও অন্নদা রায়ের বিপদ একটু অন্য ধরনের বা একটু বেশি গুরুতর। তাঁহার এক জ্ঞাতিভ্রাতা বহুদিন যাবৎ পশ্চিমপ্রবাসী। এতদিন তিনি উক্ত প্ৰবাসী জ্ঞাতির আম-কঁঠালের বাগান ও জমি নির্বিয়ে ভোগ করিতেছিলেন এবং সম্পূর্ণ ভরসা ছিল জরিপের সময় পারিয়া উঠিলে সবই, অন্ততপক্ষে কতকাংশ নিজের বলিয়া লিখাইয়া লইবেন, কিন্তু কি জানি গ্রামের কে উক্ত প্ৰবাসী জ্ঞাতিকে কি পত্ৰ লিখিয়াছে।–ফলে অদ্য দিন দশেক হইল জ্ঞাতিভ্রাতার জ্যেষ্ঠপুত্রটি জরীপের সময় বিষয়সম্পত্তি দেখাশোনা করিতে আসিয়াছে। মুখের গ্রাস তো গেলই, তাহা ছাড়া বিপদ আরও আছে। ওই আত্মীয়ের অংশের ঘরগুলিই বাড়ির মধ্যে ভালো, রায় মহাশয় গত বিশ বৎসর সেগুলি নিজে দখল করিয়া আসিতেছেম, সেগুলি ছাড়িয়া দিতে হইয়াছে।–জ্ঞাতিপুত্রটি শৌখিন ধরনের কলেজের ছেলে, একখানিতে শোয়, একখানিতে পড়াশুনা করে উপরের ঘরখানি হইতে লোহার সিন্দুক, বন্ধকী মাল, কাগজপত্ৰাদি সরাইয়া ফেলিতে হইয়াছে। নিচের যে ঘরে পালিত-পাড়া হইতে সস্তাদরে কেনা কড়িবারগা রক্ষিত ছিল, সে ঘরও শীঘ্ৰ ছাড়িয়া দিতে হইবে।

বৈকালবেলা। অন্নদা রায়ের চণ্ডীমণ্ডপে পাড়ার কয়েকটি লোক আসিয়াছেন- এই সময়েই পাশা খেলার মজলিশ বসে। কিন্তু অদ্য এখনও কাজ মেটে নাই। অন্নদা রায় একে একে সমাগত খাতকপত্র বিদায় করিতেছিলেন।

উঠানের রোয়াকের ঠিক নিচেই একটি অল্পবয়সি কৃষক-বধূ একটা ছোট ছেলে সঙ্গে লইয়া অনেকক্ষণ হইতে ঘোমটা দিয়া বসিয়া ছিল, সে এইবার তাহার পালা আসিয়াছে ভাবিয়া উঠিয়া দাঁড়াইল। রায় মহাশয় মাথা সামনে একটু নিচু করিয়া চশমার উপর হইতে তাহার দিকে চাহিয়া বলিলেন-কে? তোর আবার কি?

কৃষক-বন্ধুটি আঁচলের খুঁট খুলিতে খুলিতে নিম্নকণ্ঠে বলিল-মুই কিছু টাকার জোগাড়া করিচি অনেক কষ্টে, মোর টাকাডা নেন.আর গোলার চাবিটা খুলে দ্যান, বড় কষ্ট যাচ্ছে মনিব ঠাকুর, সে আর কি বলবো।–

অন্নদা রায়ের মুখ প্ৰসন্ন হইল, বলিলেন-হরি, নেও তো ওর টাকাটা গুনে। খাতাখানায় দেখো তারিখটা, সুদটা আর একবার হিসেব করে দেখো–

কৃষক-বধূ আঁচলের খুঁট হইতে টাকা বাহির করিয়া হরিহরের সম্মুখে রোয়াকের ধারে রাখিয়া দিল। হরিহর গুনিয়া বলিল-পাঁচ টকা?

রায় মহাশয় বলিলেন-আচ্ছা-জমা করে নাও-তারপর আর টাকা কই?

-ওই এখন ন্যান, তারপর দেবো-মুই গতির খাটিয়ে-শোধ করে তোলবো, এখন ওই নিয়ে মোর গোলার চাবিড়া খুলে দ্যান, মোর মাতোরে দুটো খেইয়ে তো আগে বঁচাই, তার পর ঘরদোর ফুটো হয়ে গিয়েছে, সে না হয়-।

এমন নিরুদ্বেগে কথা বলিতেছিল যেন গোলার চাবি তাহার করতলগত হইয়া গিয়াছে। রায় মহাশয়কে চিনিতে তাহার বিলম্ব ছিল।

রায় মহাশয় কথা শেষ করিতে না দিয়াই বলিলেন-ওঃ, ভারি যে দেখছি মাগীর আবদার, চল্লিশ টাকার কাছাকাছি সুদে আসলে বাকি-পাঁচ টাকা এনিচি, নিয়ে গোলা খুলে দ্যান, ছোট লোকের কাণ্ডই আলাদা।—যা এখন দুপুরবেলা দিক করিস নে—

কৃষক-বধূ চণ্ডীমণ্ডপের অন্য কাহারও অপরিচিত নহে, দীনু ভট্টচায্যি চোখে ভালো দেখিতেন না, বলিলেন-কে ও অন্নদা?

-ওই ও-পাড়ার তমরেজের বৌ-দিন চারেক হোল তমরেজ না মারা গিয়েচে? সুদে আসলে চল্লিশ টাকা বাকি, তাই মরবার দিনই বিকেল থেকে গোলায় চাবি দিয়ে রেখেচি, এখন গোলা খুলিয়ে দ্যান-হেন করুন-তেন করুন–

পায়ের তলা হইতে মাটি সরিয়া গেলেও তমুরেজের বৌ অত চমকিয়া উঠিত না-সে ব্যাপার এখন অনেকটা বুঝিল, আগাইয়া আসিয়া বলিল-ওকথা বলবেন না। মনিব ঠাকুর, মোর খোকার একটা বুপোর নিমফল ছেল, ও বছর গড়িয়ে দিইছিল! তাই ভোঁদা সেকরার দোকানে বিক্রি কল্পে পাঁচটা টাকা দেলে–ছেলেমানুষের জিনিস ব্যাচবার ইচ্ছে ছেল না, তা কি করি, এখন দুটো খেইয়ে বঁচি, ভাবলাম এর পর দিন দেন মালিক তো মোর বাছারে মুই আবার নিমফল গড়িয়ে দেবো! তা দেন মনিব ঠাকুর চাবিডা গিয়ে–

–যা যা-এখন যা-এ সব টাকাকড়ির কাণ্ড কি নাকে কঁদিলেই মেটো? তা মেটে না। সে তুই কি বুঝবি, থাকতো তোর সোয়ামী তো বুঝতে, যা এখন দিক্‌ করিস নি-ওই পাঁচ টাকা তোর নামে জমা রৈল-বাকি টাকা নিয়ে আয় তারপর দেখা যাবে।

অন্নদা রায় চশমা খুলিয়া খাপের মধ্যে পুরিতে পুরিতে উঠিয়া পড়িলেন ও বাড়ির ভিতরে চলিয়া যাইবার উদ্যোগ করিলেন। তমরেজের বৌ আকুল সুরে বলিয়া উঠিল-কনে যান ও মনিব ঠাকুর, মোর খোকার একটা উপায় করে যান, ওরে মুই খাওয়াবো কি, এক পয়সার মুড়ি কিনে দেবার যে পয়সা নেই।–মোর গোলা না খুলে দ্যান, মোর টাকা কড়া মোরে ফেরত দ্যান–

রায় মহাশয় মুখ খিচাইয়া বলিলেন—যা যা সন্দে বেলা মাগী ফ্যাচু ফ্যাচু করিস নে-এক মুঠো টাকা জলে যাচ্চে তার সঙ্গে খোঁজ নেই, গোলা খুলে দাও, টাকা ফেরত দাও-গোলায় আছে কি তোরা? জোর শালি চারেক ধান, তাতে টাকা শোধ যাবে? ও পাঁচ টাকাও উশুল রয়ে রৈল, আমার টাকা দেখবো না! ওঁর ছেলে কি খাবে বলে দাও-ছেলে কি খাবে তা আমি কি জানি? যা, পরিস তো নালিশ করে খোলাগে যা–

175 Shares