পথের পাঁচালী

রায় মহাশয় বাড়ির মধ্যে চলিয়া গেলে দীনু ভট্টচায্যি বলিলেন-হ্যাগো বৌ, তমরেজ ক’দিন হল—কই তা তো–

-বুধবারের দিন বাবা ঠাকুর, হাট থে। ভাঙন মাছ আনলে, পেয়াজ দিয়ে রাঁধলাম-ভাত দেলাম-সহজ মানুষ ভালো খেলে দিব্যি-খেয়ে বললে মোর শীত করচে, কাঁথা চাপা দিয়ে দাও, দেলাম-ওমা সইতে তারা উঠতি না উঠতি মানুষ দেখি আর সাড়াশব্দ দেয় না, দুপুর হাতি না হতি মৈারে পথে বসিয়ে-মোর খোকারে পথে বসিয়ে-চোখের জলে তাহার গলা আটকাইয়া গেল; মিনতির সুরে বলিল-আপনারা এটু বলেন-বলে গোলার চাবিড়া দিইয়ে দ্যান, সংসারে বড় কষ্ট হয়েচে-কর্জ কি মুই বাকি রাখবো।–ঝে করে হোক–

এই সময়ে নবাগত জ্ঞাতিপুত্রটি আসিয়া পড়াতে কথাবার্তা বন্ধ হইল। দীনু বলিলেন-এসো হে নীরেন বাবাজী, মাঠের দিকে বেড়াতে গিযেছিলে বুঝি? এই তোমার বাপ-ঠাকুরদার দেশ বুঝলে হে, কি রকম দেখলে বল?

নীরেন একটু হাসিল। তাহার বয়স একুশ-বাইশের বেশি নয়, বেশ বলিষ্ঠ গড়ন, সুপুরুষ। কলিকাতার কলেজে আইন পড়ে, অত্যন্ত মৌনী প্রকৃতির মানুষ-দেখিবার জন্য পিতা কর্তৃক প্রেবিত হইলেও কাজকর্ম সে কিছুই দেখে না বোঝেও না, দিনরাত নভেল পড়িয়া ও বন্দুক ষ্টুড়িয়া কাটায়। সঙ্গে একটি বন্দুক আনিয়াছে, শিকারের ঝোঁক খুব।

নীরেন উপরে নিজের ঘরে ঢুকিতে গিয়া দেখিল, গোকুলের স্ত্রী ঘরের মেজেতে বসিয়া পড়িয়া মেজ হইতে কি খুঁটিয়া খুঁটিয়া তুলিতেছে। দোরের কাছে যাইতেই তাহার নজর পড়োল, তাহার দামি বিলাতী আলোটা মেজেতে বসানো; উহার কাচের ড়ুমটা ভাঙিয়া চুরমার হইয়াছে, সাবা মেজেতে কাঁচ ছড়ানো। দোরের কাছে জুতাব শব্দ পাইয়া গোকুলেৰ স্ত্রী চমকাইয়া পিছন ফিরিয়া চাহিল, সে আঁচল পাতিয়া মেজে হইতে কাঁচের টুকরাগুলি খুটিয়া খুটিযা তুলিতেছিল,-ভাবে মনে হয় প্রতিদিনেব মতো ঘর পরিষ্কার করিতে আসিয়া আলোটি জুলিতে গিয়াছিল, কি কবিয়া ভাঙিযা ফেলিয়াছে এবং আলোর মালিক আসিবার পূর্বেই নিজেই অপবাধের চিহ্নগুলি তাড়াতাড়ি সরাইযা ফেলিবার চেষ্টায় ছিল, হঠাৎ বামাল ধরা পড়িয়া অত্যন্ত অপ্রতিভ হইল। ক্ষতিকারিণীব লজ্জাব ভারটা লঘু করিয়া দিবার জন্যই নীরেন হাসিযা বলিয়া উঠিল–এই যে বৌদি, আলোটা ভেঙে বসে আছেন বুঝি? এই দেখুন ধরা পড়ে গেলেন, জানেন তো আইন পড়ি। আচ্ছা এখন একটু চা কবে নিয়ে আসুন তো বৌদি, চাটু করে, দেখি কেমন কাজের লোক। দাঁড়ান আলোটা জেলে নিই, ভাগ্যিাস বাক্সে আর একটা ড়ুম আছে।

গোকুলের স্ত্রী। সলজ্জ সুরে বলিল, দেশলাই আনবো ঠাকুরপো?

নীরেন কৌতুকের সুরে বলিল-দেশলাই আনেন নি। তবে আলো পেড়ে কি করছিলেন শুনি?

বধূ এবার হাসিয়া ফেলিল, নিম্নসুরে বলিল-বুল পড়ে রয়েচে, ভাবলুম একটু মুছে দিই, তা যেমন কঁচটা নামাতে গেলাম, কি জানি ও সব ইংরিজি কলের আলো-কথা শেষ না কবিয়াই সে পুনরায় সলজ হাসিয়া নিচে পলাইল!

নীরেন। দশ বারো দিন আসিয়াছে বটে, সম্পর্কে বৌদিদি হইলেও গোকুলের স্ত্রীর সঙ্গে তাহার বিশেষ আলাপ হয় নাই। কঁচ ভাঙার সন্ধ্যা হইতে কিন্তু উভয়ের মধ্যে নূতন পরিচযেব সংকোচটা কাটিয়া গেল। নীরেন অবস্থাপন্ন পিতাব পুত্র, তাহার উপর বাংলাদেশের পাড়াগাঁয়ে এই প্রথম আসা, নিঃসঙ্গ আনন্দহীন প্রবাসে দিনগুলি কাটিতে চাহিতেছিল না। সমবয়সি বৌদির সহিত পবিচাযের পথটা সহজ হইয়া যাওয়ার পর হইতে সকাল-সন্ধ্যায় চা-পানের সময়টি সহজ আদান-প্রদানের মাধুর্যে আনন্দপূর্ণ হইয়া উঠিল!…

দুপুরে সেদিন দুৰ্গা বেড়াইতে আসিল। রান্নাঘরের দুয়ারে উঁকি মারিয়া বলিল-কি রাধচো ও খুড়িমা?

বধূ বলিল-আয় মা আয়, একটু কাজ করে দিবি? একা আর পেরে উঠুচিনে।…

দুৰ্গা মাঝে মাঝে যখনই আসে, খুড়িমার কার্যে সাহায্য করে। সে মাছ কুটিতে কুটিতে বলিল-হ্যাঁ খুড়িমা, এ কাঁকড়া কোথায় পেলো? এ কাঁকড়া তো খায় না।

-কেন খাবে না রে, দূর। বিধু জেলেনি বলে গেল এ কাঁকড়া সবাই খায়।

-হ্যাঁ  খুড়িমা, ওমা সেকি, তুমি কিনলে?

-কিনালামই তো, ওই অতগুলো পাঁচ পয়সায় দিয়েচে বিধু।

দুৰ্গা কিছু বলিল না। মনে মনে ভাবিল-খুড়িমার আর সব ভালো, কেবল একটু বোকা! এ কাঁকড়া আবার পয়সা দিয়ে কেনেই বা কে, খায়ই বা কে? ভালোমানুষ পেয়ে বিধু ঠকিয়ে নিয়েচে। সঙ্গে সঙ্গে এই সরলা খুড়িমাটির উপর তাহার স্নেহ নিবিড়তার হইয়া উঠিল।

সেদিন নাকি গোকুল-কাক খুড়িমার মাথায় খড়মের বাড়ি মারিয়াছিল—স্বৰ্ণ গোয়ালিনী তাহাদের বাড়ি গল্প করে। সে-ও সেদিন নদীর ঘাটে স্নান করিতে গিয়েছিল। খুড়িমা স্নান করিতে আসিয়া মাথা ড়ুবাইয়া স্নান করিল না, পাছে জ্বালা করে। সেদিন দুঃখে তাহার বুক ফাটিয়া যাইতেছিল; কিন্তু কিছু বলে নাই পাছে খুড়িমা অপ্রতিভ হয়—এক ঘাট লোকের সামনে লজ্জা পায়। তবুও রায়-জেঠি জিজ্ঞাসা করিয়াছিলেন।–বৌমা, নইলে না?..

খুড়িমা হাসিয়া উত্তর দিল-নাবো না। আজ আর দিদিমা, শরীরটা ভালো নেই।…

খুড়িমা ভাবিয়াছিল। তাহার মার খাওয়ার কথা বুঝি কেহ জানে না। কিন্তু খুড়িমা ঘাট হইতে উঠিয়া গেলেই রায়-জেঠি বলিল-দেখেচো বেঁটাকে কি রকম মেরেচে গোকুলো, মাথার চুলে রক্ত একেবারে আঠা হয়ে এটি আছে!..রায়-জেঠির ভারি অন্যায়। জানো তো বাপু, তবে আবার জিজ্ঞেস করাই বা কেন, আর সকলকে বলাই বা কেন?

মাছ ধুইয়া রাখিয়া চলিয়া যাইবার সময় দুৰ্গা ভয়ে ভয়ে বলিল—খুড়িমা, তোমাদের চিড়ের ধান আছে? মা বলছিল। অপু চিড়ে খেতে চেয়েছে, তা আমাদের তো এবার ধান কেনা হয়নি।.

গোকুলের বুক চুপি চুপি বলিল-আসিস এখন দুপুরের পর l.দালানের দিকে ইশারায় দেখাইয়া কহিল-ঘুমুল আসিস!

দুৰ্গা জিজ্ঞাসা করিল-খুড়িমা, তোমাদের বাড়ি কে এসেছে, আমি একদিনও দেখিনি কিন্তু।

—ঠাকুরপোকে দেখিসনি? এখন নেই কোথায় বেরিয়েচে, বিকেলবেলা আসিস, দেখা হবে এখন .তারপর গোকুলের বউ হাসিয়া বলিল—তোর সঙ্গে ঠাকুরপোর বিয়ে হলে কিন্তু দিব্যি মানায়।

দুৰ্গা লজ্জায় রাঙা হইয়া বলিল-দূর!

গোকুলের বউ আবার হাসিয়া বলিল-কেন রে, দূর কেন? কেন, আমাদের মেয়ে কি খারাপ? দেখি?…সে দুর্গার চিবুকে হাত দিয়া মুখখানা একটু উঁচু করিয়া তুলিয়া ধরিয়া বলিল-দ্যাখ তো এমন দুগগা প্রতিমার মতো সুন্দর মুখখানি? হলই বা বাপের পয়সা নেই?

দুৰ্গা ঝাঁকুনি দিয়া নিজেকে ছাড়াইয়া লইয়া কহিলা-যাও, খুড়িমা যেন কি…পরে সে একপ্রকার ছুটিয়াই খিড়কি দোর দিয়া বাহির হইয়া গেল। যাইতে যাইতে সে ভাবিল-খুড়িমার আর সব ভালো, কেবল একটু বোকা, নইলে দ্যাখো না…? দূর!

দুৰ্গা চলিয়া যাইতে না যাইতে স্বৰ্ণ গোয়ালিনী দুধ দুহিতে আসিল। বধূ ঘর হইতে বলিল— ও সন্ন, আমার হাত জোড়া, বাছুরটা ওই বাইরের উঠোনে পিটুলি-গাছে বাধা আছে–নিয়ে আয়, আর রোয়াকে ঘটিটা মাজা আছে দ্যাখ।

সখী ঠাকরুনের এতক্ষণে পুজাহিক সমাপ্ত হইল। তিনি বাহিরে আসিয়া উত্তর দিকে স্থানীয় কালীমন্দিরের উদ্দেশে মুখ ফিরাইয়া প্ৰণাম করিতে করিতে টানিয়া টানিয়া আবৃত্তির সুরে বলিতে লাগিলেন-দোহাই মা সিদ্ধেশ্বরী, দিন দিয়ো মা, ভাবসমুদুর পার কোরো মা-মা রক্ষেকালী, রক্ষে কোরো, মা-গো!

গোকুলের বউ রান্নাঘর হইতে ডাকিয়া বলিল-ও পিিসমা, নারকোলের নাড়ু রেখে দিইচি, দুটো খেয়ে জল খান।

হঠাৎ সখী ঠাকরুন রোয়াক হইতে ডাক দিলেন-বৌমা, দেখে যাও তো এদিকে।

স্বর শুনিয়া গোকুলের বউ-এর প্রাণ উড়িয়া গেল। সখী ঠাকরুনকে সে যমের মতো ভয় করে। মায়া-দয়া বিতরণ সম্বন্ধে ভগবান সখী ঠাকরুনের প্রতি কোনো পক্ষপাতিত্ব দেখান নাই-একথা নিঃসন্দেহে বলা চলে। রোয়াকের কোণে জড়ো-করা মাজা বাসনগুলির উপর ঝুঁকিয়া পড়িয়া, আঙুল দিয়া দেখাইয়া কহিলেন-দ্যাখো তো চক্ষু দিয়ে, দেখতে পাচ্ছে? একেবারে স্পষ্ট জলের দাগ দেখলে তো? এইখান থেকে সন্ন ঘটি তুলে নিয়ে গিয়েচে, তারপর সেই শূদূরের ছোঁয়া এঁটো বাসন আবার হেঁসেলে নিয়ে সাত-রাজ্যি জাজানো হয়েচে! হাঃ! জাতজন্মো একেবারে গেল!

সখী ঠাকরুন হতাশভাবে রোয়াকে বসিয়া পড়িলেন। যেন উপযুক্ত পুত্রের মৃত্যু-সংবাদ পাইলে ইহার চেয়ে বেশি হতাশ হইতে পারিতেন না।

—হাঘরে হাড়হাবাতে ঘরের মেয়ে আনলেই অমনি হয়, ভদ্রলোকের রীত শিখবেই বা কোথা থেকে-জানবেই বা কোথা থেকে? বাসন মজলি তো দেখলি নে এটো গেল কি রৈল? তিনপহার বেলা হয়েচে, ভাবলাম একটু জল মুখে দিই! শূন্দুরের এটো, এখখনি নেয়ে মরতে হোতভাগ্যিস ঘটিটা ছুইনি।

গোকুলের বউ বিষণ্ণমুখে দাঁড়াইয়া ভাবিতেছিল-কেন মত্তে সন্ন পোড়ারমুখীকে ঘটি তুলে নিতে বল্লাম, নিজে দিলেই হত।

সখী ঠাকরুন মুখ খিচাইয়া বলিলেন–ধিঙ্গি হয়ে দাঁড়িয়ে রৈলে যে? যাও হ্যাঁড়ি কুড়ি ফেলে দাও গিয়ে। বাসন-কোসন মেজে আনো ফের। রান্নাঘরে গোবর দিয়ে নেয়ে এসো। যত লক্ষ্মীছাড়া ঘরের মেয়ে জুটে সংসারটাকে ছারখারে দিলে।.সখী ঠাকরুন রাগে গরগর করিতে করিতে ঘরে ঢুকিলেন, বাহিরের খররৌদ্র তাঁহার সহ্য হইতেছিল না।

175 Shares