পথের পাঁচালী

কুকুম-মতো সকল কোজ সারিতে বেলা একেবারে পড়িয়া গেল। নদীতে সে যখন পুনরায় স্নান করিতে গেল, তখন রৌদ্রে, ক্ষুধাতৃষ্ণায় ও পরিশ্রমে তাহার মুখ শুকাইয়া ছোট হইয়া গিয়াছে!

ঘাটে বৈকালের ছায়া খুব ঘন, ওপারে বড় শিমুল গাছটায় রোদ চিক চিক করিতেছে। নদীর বঁকে একখানা পাল-তোলা নৌক দাঁড় বাহিয়া বঁক ঘুরিয়া যাইতেছে। হালের কাছে একজন লোক দাঁড়াইয়া কাপড় শূকাইতেছে, কাপড়টা ছাড়িয়া দিয়াছে, বাতাসে নিশানের মতো উড়িতেছে, মাঝনদীতে একটা বড় কচ্ছপ মুখ তুলিয়া নিঃশ্বাস লইয়া আবার ড়ুবিয়া গেল-সো-ও-ও-ও-ভুস!

নদীর জলের কেমন একটা ঠাণ্ড ঠাণ্ডা সুন্দর গন্ধ আসে, ছোট্ট নদী; ওপারের চরে একটা পানকৌড়ি মাছ-ধরা বাঁশের দোয়াড়ির উপর বসিয়া আছে।

এই সময় প্রতিদিন তাহার শৈশবের কথা মনে পড়ে

পানকৌড়ি পানকৌড়ি, ডাঙায় ওঠোসে…

গোকুলের বউ খানিকক্ষণ পানকৌড়িটার দিকে চাহিয়া রহিল। মায়ের মুখ মনে পড়ে। সংসারে আর কেহ নাই যে, মুখের দিকে চায়। মায়ের কি মরিবার বয়স হইয়াছিল? গরিব পিতৃকুলে কেবল এক গাঁজাখের ভাই আছে, সে কোথায় কখন থাকে-তার ঠিকানা নাই। গত বৎসর পূজার সময় এখানে আসিয়া চার দিন ছিল। সে লুকাইয়া লুকাইয়া ভাইকে নিজের বাক্স হইতে যাহা সামান্য কিছু পুজি-সিকিটা দুয়ানিটা বাহির করিয়া দিত। পরে একদিন সে হঠাৎ এখান হইতে উধাও হয়। চলিয়া গেলে প্রকাশ পাইল যে, এক কাবুলি আলোয়ান-বিক্রেতার নিকট একখানি আলোয়ান ধারে কিনিয়া তাহার খাতায় ভগ্নীপতির নাম লিখাইয়া দিয়াছে। তাহা লইয়া অনেক হৈ চৈ হইল। পিতৃকুলের অনেক সমালোচনা, অনেক অপমান! ভাইটির সেই হইতে আর কোন সন্ধান নাই।

নিঃসহায় ছন্নছাড়া ভাইটার জন্য সন্ধ্যাবেলা কাজের ফাঁকে মনটা সু-দু করে। নির্জন মাঠের পথের দিকে চাহিয়া মনে হয়, গৃহহারা পথিক ভাইটা হয়তো দূরের কোন জনহীন আঁধার মেঠা-পথ বাহিয়া একা কোথায় চলিয়াছে, রাত্রে মাথা গুজিবার স্থান নাই, মুখের দিকে চাহিবার কোনো মানুষ নাই।…

বুকের মধ্যে উদ্বেল হইয়া উঠে, চোখের জলে ছায়াভিরা নদীর জল, মাঠ, ঘাট, ওপরের শিমুল গাছটা, বাঁকের মোড়ে বড় নৌকাখানা-সব ঝাপসা হইয়া আসে।

অষ্টাদশ পরিচ্ছেদ

অপু সেদিন জেলেপাড়ায় কড়ি খেলিতে গিয়াছিল। বেলা দুইটা বা আড়াইটার কম নয়, রৌদ্র অত্যন্ত প্রখর। প্রথমে সে তিনকড়ি জেলের বাড়ি গেল। তিনকড়ির ছেলে বঙ্কা পেয়ারাতলায় বাখারি চাচিতেছিল, অপু বলিল–এই কড়ি খেলবি?

খেলিবার ইচ্ছা থাকিলেও বঙ্কা বলিল, তাহাকে এখনই নৌকায় যাইতে হইবে, খেলা করিতে গেলে বাবা বকিবে! সেখান হইতে সে গেল রামচরণ জেলের বাড়ি।

রামচরণ দাওয়ায় বসিয়া তামাক খাইতেছিল; অপু বলিল-হৃদয় বাড়ি আছে?

রামচরণ বলিল-হৃদয়কে কেন ঠাকুরী? কড়ি খেলা বুঝি? এখন যাও, হৃদে বাড়ি নেই।

ঠিক-দুপুর বেলায় ঘুরিয়া অপুর মুখ রাঙা হইয়া গেল। আরও কয়েক স্থানে বিফলমনোরথ হইয়া ঘুরিতে ঘুরিতে বাবুরাম পাড়ুইয়ের বাড়ির নিকটবতী তেঁতুলতলার কাছে আসিয়া তার মুখ আনন্দে উজ্জ্বল হইয়া উঠিল। তেঁতুলতলায় কড়ি খেলার আডডা খুব জমিয়াছে। সকলেই জেলেপাড়ার ছেলে কেবল ব্ৰাহ্মণপাড়ার ছেলের মধ্যে আছে। পটু। অপুর সঙ্গে পটুর তেমন আলাপ নাই, কারণ পটুর যে পাড়ায় বাড়ি, অপুদের বাড়ি হইতে তাহা অনেক দূর। অপুর চেয়ে বয়সে পঢ়ি কিছু ছোট; অপুর মনে আছে, প্রথম যেদিন সে প্রসন্ন গুরুমশায়ের পাঠশালায় ভর্তি হইতে যায়, সেদিন এই ছেলেটিকেই সে শান্তভাবে বসিয়া তালপাতা মুখে পুরিয়া চিবাইতে দেখিয়াছিল।…অপু তাহার কাছে গিয়া বলিল-কটা কড়ি?… পটু কড়ির গেজে বাহির করিয়া দেখাইল। রাঙা সুতার বুনানি ছোট্ট গেজেটি-তাহার অত্যন্ত শখের জিনিস। বলিল, সতেরোটা এনেছি।–সাতটা সোনাগেটে; হেরে গেলে আরও আনবো।… পরে সে গেজেটা দেখাইয়া হাসিমুখে কহিল-কেমন দেখচিস? গেজেটায় একপণ কড়ি ধরে।

খেলা আরম্ভ হইল। প্রথমটা পটু হারিতেছিল, পরে জিতিতে শুরু করিল। কয়েকদিন মাত্র আগে পটু আবিষ্কার করিয়াছে যে, কড়ি-খেলায় তাহার হাতের লক্ষ্য অব্যর্থ হইয়া উঠিয়াছে; সেইজন্যই সে দিগ্বিজয়ের উচ্চাশায় প্রলুব্ধ হইয়া। এতদূর আসিয়াছিল। খেলার নিয়মানুসারে পটু উপর হইতে টুক করিয়া বড় কড়ি দিয়া তাক ঠিক করিয়া মারিতেই যেমন একটা কড়ি বৌ করিয়া ঘুরিতে ঘুরিতে ঘর হইতে বাহির হইয়া যায় আমনি পটুর মুখ অসীম আহ্বাদে উজ্জ্বল হইয়া উঠে। পরে সে জিতিয়া পাওয়া কড়িগুলি তুলিয়া গেজের মধ্যে পুরিয়া লোভে ও আনন্দে বার বার গেজেটির দিকে চাহিয়া দেখে, সেটা ভর্তি হইতে আর কত বাকি!

কয়েকজন জেলের ছেলে কি পরামর্শ করিল। একজন পটুকে বলিল-আর এক হাত তফাত থেকে তোমায় মারতে হবে ঠাকুর, তোমার হাতে টিপ বেশি!

পটু বলিল-বা রে, তা কেন, টিপ বেশি থাকাটা দোষ বুঝি? তোমরাও জেতো না, আমি তো কাউকে বারণ করিনি।

পরে সে চারদিকে চাহিয়া দেখিল, জেলের ছেলেরা সব একদিকে হইয়াছে। পটু ভাবিল-এত বেশি কড়ি আমি কোনদিন জিতি নি; আজ আর খেলচি নে-খেল্লে কি আর এই কড়ি বাড়ি নিয়ে যেতে পারবো? আবার একহাত বাধা বেশি! সব হেরে যাব!..হঠাৎ সে কড়ির ছোট্ট থলিটি হাতে লইয়া বলিল-আমি এক হাত বেশি নিয়ে খেলবো না, আমি বাড়ি যাচ্ছি।… পরে জেলের ছেলেদের ভাবভঙ্গি ও চোখের নিষ্ঠুর দৃষ্টি দেখিয়া সে নিজের অজ্ঞাতসারে নিজের কড়ির থলিটি শক্ত মুঠায় চাপিয়া রাখিল।

একজন আগইয়া আসিয়া বলিল—তা হবে না ঠাকুর, কড়ি জিতে পালাবে বুঝি?.সঙ্গে সঙ্গে সে হঠাৎ পিটুর থলিসুন্ধ হাতটা চাপিয়া ধরিল। পটু ছাড়াইয়া লইতে গেল, কিন্তু জোরে পরিল না; বিষণ্ণমুখে বলিল-বা-রে, ছেড়ে দাও না। আমার হাত-পিছন হইতে কে একজন তাহাকে ঠেলা মারিল; সে পড়িয়া গেল বটে, কিন্তু কড়ির থলি ছাড়িল না। সে বুঝিয়াছে এইটিই কাড়িবার জন্য ইহাদের চেষ্টা!! পড়িয়া গিয়া সে প্রাণপণে থলিটা পেটের কাছে চাপিয়া রাখিতে গেল; কিন্তু একে সে ছেলেমানুষ, তাহাতে গায়ের জোরও কম, জেলেপাড়ার বলিষ্ঠ ও তাহার চেয়ে বয়সে বড় ছেলেদের সঙ্গে কতক্ষণ যুঝিতে পরিবে! হাত হইতে কড়ির থলিটি অনেকক্ষণ কোন ধারে ছিটকাইয়া পড়িয়াছিল-কড়িগুলি চারিধারে ছত্রাকার হইয়া গেল।

অপু প্রথমটা পটুর দুর্দশায় একটু খুশি না হইয়াছিল তাহা নহে, কারণ সে-ও অনেক কড়ি হারিয়াছে। কিন্তু পটুকে পড়িয়া যাইতে দেখিয়া, বিশেষ করিয়া তাহাকে অসহায় ভাবে পড়িয়া মার খাইতে দেখিয়া তাহার বুকের মধ্যে কেমন করিয়া উঠিল, সে ভিড় ঠেলিয়া আগাইয়া গিয়া বলিলছেলেমানুষ। ওকে তোমরা মারচ কেন? বা রে, ছেড়ে দাও-ছাড়ো! পরে সে পটুকে মাটি হইতে উঠাইতে গেল, কিন্তু পিছন হইতে কাহার হাতেব ঘুষি খাইয়া খানিকক্ষণ সে চোখে কিছু দেখিতে পাইল না; তারপর ঠেলা ঠেলিতে সে-ও মাটিতে পড়িয়া গেল।

অপুকেও সেদিন বেদম প্রহার খাইতে হইত নিশ্চয়ই, কারণ তাহার মেয়েলী ধরনের হাতেপায়ে কোন জোর ছিল না, কিন্তু ঠিক সেই সময়ে নীরেন এই পথে আসিয়া পড়াতে বিপক্ষদল সরিয়া পড়িল। পটুর লাগিয়াছিল খুব বেশি; নীরেন তাহাকে মাটি হইতে উঠাইয়া গায়ের ধূলা ঝাড়িয়া দিল। একটু সামলাইয়া লইয়াই সে চারিদিকে চাহিয়া দেখিতে লাগিল-ছড়ানো কড়িগুলার দু’একটি ছাড়া বাকিগুলি অদৃশ্য, প্রায় কড়ির থলিটি পর্যন্ত। পরে সে অপুর কাছে সরিয়া আসিয়া জিজ্ঞাসা করিল– অপুদা, তোমার বেশি লাগে নি তো?

এতদূরে ঠিক দুপুরবেলা জেলের ছেলেদের দলে মিশিয়া কড়ি খেলিতে আসিবার জন্য নীরেন দুজনকেই বকিল। সময় কাটাইবার জন্য নীরেন পাড়ার ছেলেদের লইয়া অন্নদা রায়ের চণ্ডীমণ্ডপে পাঠশালা খুলিয়াছিল, সেখানে গিয়া কাল হইতে পড়িবার জন্য দুজনকেই বার বার বলিল। পটু চলিতে চলিতে শুধুই ভাবিতেছিল–কেমন সুন্দর কড়ির গেজেটা আমার, সেদিন অত করে ছিবাসেব কাছে চেয়ে নিলাম-গেল!! আমি যদি কড়ি জিতে আর না খেলি তা ওদের কি? সে তো আমার ইচ্ছে!…

বাড়ি ঢুকিয়াই অপু দুৰ্গাকে বলিল-দিদি, শিউলিতলায় গুড়ির কাছে আমি একটা বাঁকা কঞ্চি রেখে গিাইছি, আর তুই বুঝি সেটাকে ভেঙে দুখণ্ড করে রেখেচিস?

দুৰ্গা সেখানাকে ভাঙিয়াছিল ঠিকই। —আহা, ভাবি তো একখানা বাঁকা-কঞ্চি! তোর যত পাগলামি—বাঁশ-বাগানে খুঁজলে কঞ্চি আর মিলবে না বুঝি। কঞ্চির ভারি অমিল কিনা!

অপু লজ্জিত মুখে বলিল-অমিল না তো কি? তুই এনে দে দিকি ওইরকম একখানা কঞ্চি! আমি কত খুঁজেপেতে নিয়ে আসবো, আর তুই সব ভেঙেচুবে রাখবি।–বেশ তো!

তার চোখে জল আসিয়া গেল।

দুৰ্গা বলিল-দেবো এখন এনে যত চাস, কান্না কিসের?

বাঁকা-কঞ্চি অপুর জীবনে এক অদ্ভুত জিনিস! একখানা শুকনো, হালকা, গোড়ার দিক মোটা, আগার দিক সরু বাঁকা-কঞ্চি হাতে করিলেই অপুর মন পুলকে শিহরিয়া ওঠে, মনে অদ্ভুত সরু কল্পনা জাগে। একখানা বাঁকা-কঞ্চি হাতে করিয়া একদিন সে সারা সকাল কি বৈকাল আপনমনে বাঁশবনের পথে কি নদীর ধারে বেড়াইয়া বেড়ায়; কখনও রাজপুত্র, কখনও তামাকের দোকানী, কখনও ভ্ৰমণকারী, কখনও বা সেনাপতি, কখনও মহাভারতের অর্জন-কল্পনা করে ও আপনমনে বিড় বিড় করিয়া কাল্পনিক ঘটনা যাহা ওই অবস্থায় তাহার জীবনে ঘটিলে তাহার আনন্দ হইত, সেই সব ঘটনা বলিয়া যায়। কঞ্চি যত মনের মতো হালকা হইবে ও পরিমাণমতো বাঁকা হইবে, তাহার আনন্দ ও কল্পনা ততই পরিপূর্ণতা লাভ করে; কিন্তু সে রকম কঞ্চি সংগ্ৰহ করা যে কত শক্ত অপু ত্যাহা বোঝে। কত খুঁজিয়া তবে একখানা মেলে।

175 Shares