পথের পাঁচালী

অপু যে বাঁকা-কঞ্চি হাতে এরকম করিয়া বেড়ায়, এ কথা কেউ না শুনিতে পারে অপুর সেদিকে অত্যন্ত চেষ্টা। এরূপ অবস্থায় লোকে তাহাকে আপনমনে বকিতে দেখিলে পাগল ভাবিবে বা অন্য কিছু মনে করিবে, এই আশঙ্কায় সে পারতপক্ষে জন-সমাগমপূর্ণ স্থানে অথবা যেদিকে কেহ হঠাৎ আসিয়া পড়িতে পারে, সে সব দিকে না গিয়া নদীর ধারে-নির্জন বাঁশবনেব পথেনিজেদের বাড়ির পিছনে তেঁতুল-তলায় ঘোরে। এ অবস্থায় তাহকে কেহ না দেখে, সেদিকে তাহার অত্যন্ত সতর্ক দৃষ্টি! কাচিৎ যদি কেহ আসিয়া পড়ে, তখনই সে জিভ কাটিয়া হাতের কঞ্চিখানা ফেলিয়া দেয়-পাছে কেহ কিছু মনে করে—এজন্য তাহারা ভারি লজ্জা।

কেবল জানে তাহার দিদি। দিদি তাহাকে এ অবস্থায় দু’একবার দেখিয়া ফেলিয়াছিল, কাজেই দিদির কাছে আর লুকাইয়া কি হইবে? তাই সে বাঁকা-কঞ্চির কথা দিদিকে স্পষ্টই জিজ্ঞাসা করিল। অন্য লোক হইলে, লজ্জায় অপু কখনই এ কথার উল্লেখ করিতে পারিত না, যদিও কেহই জানে না অপুর সহিত বাঁকা-কঞ্চির কি রহস্যময় সম্পর্ক, তবুও অপুর মনে হয়। সকলেই সেকথা জানে, বলিলেই সকলে তাহাকে পাগল বলিয়া ঠাট্টা করিবে। কে বুঝিবে-একখানা বাঁকা-কঞ্চি হাতে পাইলে, সে না খাইয়া-দাইয়া নদীর ধারে কি কোনো জনহীন বনের পথে কি অপূর্ব আনন্দেই সারাদিন একা একা কাটাইয়া দিতে পারে!…

দিদিকে অনুরোধ করিয়াছিল-মাকে যেন এসব বলিসনে দিদি!…দুর্গা বলে নাই!

সে জানে, অপু একটা পাগল! ভারি মমতা হয় ওর ওপর, ছোট বোকা আদুরে ভাইটা—এসব মাকে বলিয়া কি হইবে?…

মধুসংক্ৰাস্তির ব্রতের পূর্বদিন সর্বজয়া ছেলেকে বলিল-কাল তোদের মাস্টার মশায়কে নেমস্তন্ন করে আসিস–বলিস দুপুর-বেলা এখানে খেতে।

মোটা চালের ভাত, পেঁপের ডালনা, ড়ুমুরের সুক্তনি, থোড়ের ঘণ্ট, চিংড়ি মাছের ঝোল, কলার বড়া ও পায়েস।

দুৰ্গাকে তাহার মা পরিবেশন-কার্যে নিযুক্ত করিয়াছে। নিতান্ত আনাড়ি-ভয়ে ভয়ে এমন সন্তৰ্পণ সে ডালের বাটি নিমন্ত্রিতের সম্মুথে রাখিয়া দিল–যেন তাহার ভয় হইতেছে এখনই কেহ বকিয়া উঠিবে। অত মোটা চালের ভাত নীরোনের খাওয়া অভ্যাস নাই; এত কম তৈলঘূতেব বান্না তরকারি কি করিয়া লোকে খায় তাহা সে জানে না। পায়েস পানসে-জলমিশানো দুধের তৈরি, একবার মুখে দিয়াই পাযোস-ভোজনের উৎসাহ তাহার অর্ধেক কমিয়া গেল। অপু মহা খুশি ও উৎসাহসহকারে খাইতেছিল; এত সুখাদ্য তাঁহাদের বাড়িতে দু’একদিন মাত্র হইয়াছে।–আজ তাহার স্মরণীয় উৎসবের দিন!—আপনি আর একটু পায়েস নিন মাস্টার মশায়।. নিজে সে এটা-ওটা বার বার দিদির কাছে চাহিয়া লইতেছিল।

বাড়ি ফিরিলে গোকুলের বউ হাসিমুখে বলিল-দুগগাকে পছন্দ হয়। ঠাকুরপো? দিব্যি দেখতে শুনতে! আহা! গরিবের ঘরের মেয়ে, বাপের পয়সা নেই। কার হাতে যে পড়বে?–সারা জীবন পড়ে পড়ে ভুগবে। তা তুমি ওকে বিয়ে করো না কেন ঠাকুরপো, তোমাদেরই পালটি ঘর-মেয়েও দিব্যি; ভাইবোনের দুজনেরই কেমন বেশ পুতুল-পুতুল গড়ন!…

জরিপের তাঁবু হইতে ফিরিতে গিয়া নীরেন সেদিন গ্রামের পিছনের আমবাগানের পথ ধরিয়াছিল। একটা বনে-ঘেরা সবু পথ বাহিয়া আসিতে আসিতে দেখিল বাগানের ভিতর হইতে একটি মেয়ে সম্মুখের পথের উপরে আসিয়া উঠিতেছে, সে চিনিল।–অপুর বোন দুৰ্গা। জিজ্ঞাসা করিল–কি খুকি, তোমাদের বাগান বুঝি এইটে?

দুর্গা পিছন ফিরিয়া চাহিয়া দেখিয়া লজ্জিত হইল, কিছু বলিল না।

পরে সে পথের পাশে দাঁড়াইয়া নীরেনকে পথ ছাড়িয়া দিতে গেল। নীরেন বলিল-না না খুকি, তুমি চল আগে আগে। তোমার সঙ্গে দেখা হয়ে ভালেই হল। ওইদিকে একটা পুকুরের ধারে গিয়ে পড়েছিলাম, তারপর পথ খুজে হয়রান। যে বন তোমাদের দেশে!

দুর্গা যাইতে যাইতে হঠাৎ থামিয়া ঘাড় বাঁকাইয়া নীরেনের মুখের দিকে চাহিবার চেষ্টা করিল। সঙ্গে সঙ্গে তাহার কাপড়ের ভিতর হইতে কিসের ফল গোটাকতক পথের উপর পড়িয়া গেল।

নীরেন বলিল-কি যেন পড়ে গেল খুকি! কিসের ফল ওগুলো?

দুর্গা নিচু হইয়া কুড়াইতে কুড়াইতে সংকুচিতভাবে বলিল-ও কিছু না, মেটে আলু।

–মেটে আলু? খেতে ভালো লাগে বুঝি? কি করে খায়?

এ প্রশ্ন দুৰ্গার কাছে অত্যন্ত কৌতুহলজনক ঠেকিল। একটি পাঁচ বছরের ছেলে যা জানে, চশমাপরা একজন বিজ্ঞ ব্যক্তি তাহা জানে না! সে বলিল -এ ফল তো খায না, এ তো তেতো।

–তবে তুমি যে—

দুৰ্গা সলজ্জসুরে বলিল-আমি নিয়ে যাচ্ছি। এমনি-খেলবার জন্যে।… একথা তাহার মনে ছিল যে, এই চশমা-পরা ছেলেটির সঙ্গেই সেদিন খুড়িমা ঠাট্টাচ্ছলে তাহার বিবাহের কথা তুলিয়াছিল। তাহারা ভারি কৌতুহল হইতেছিল, ছেলেটিকে সে ভালো করিয়া দেখে। কিন্তু মধুসংক্ৰাস্তির ব্রতের দিনেও তাহা সে পাবে নাই, আজও পারিল না।

—অপুকে বোলো কাল সকালে যেন বই নিয়ে যায়–বলবে তো?

দুর্গা চলিতে চলিতে সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়িল। আর একটু গিয়া পাশেব একটা পথ দেখাইয়া বলিল–এই পথ দিয়ে গেলে আপনাব খুব সোজা হবে।

নীরেন বলিল-আচ্ছা, আমি চিনে যাবো এখন, তোমাকে একটু এগিয়ে দিই। তুমি একলা যেতে পারবে?

দুৰ্গা আঙুল দিযা দেখাইযা কহিল—ওই তো আমাদেব বাড়ি একটু এগিযে গিয়েই, আমি তো-এইটুকু একলা যাবো এখন। আপনি আর

দুৰ্গাকে ইহার আগে নীরেন কখনও ভালো করিয়া দেখে নাই,- চোখ দুটির অমন সুন্দর ভাব কেবল দেখিয়াছে ইহারই ভাই অপুব মধ্যে। যেন পল্লীপ্রান্তের নিভৃত চুত-বকুল-বীথির প্রগাঢ় শ্যামস্নিগ্ধতা ডাগর চোখ দুটির মধ্যে অর্ধসুপ্ত রহিয়াছে। প্রভাত এখনও হয় নাই, রাত্রিশেষের অলস অন্ধকার এখনও জড়াইয়া আছে। তবে তাহা প্ৰভাতের কথা স্মরণ করাইয়া দেয় বটে, -ক’ত সুপ্ত আঁখির জাগরণ, কত কুমারীর ঘাটে যাওয়া, ঘরে ঘরে কত নবীন জাগরণের অমৃত উৎসবজানালায় জানালায় ধূপগন্ধ।

দুৰ্গা খানিকক্ষণ দাঁড়াইয়া কেমন যেন উসখুসি করিতে লাগিল। নীরেনের মনে হইল সে কি বলিবে মনে করিতে পারিতেছে না। সে বলিল-না খুকি, তোমাকে আর একটু এগিয়ে দিই? চল, তোমাদের বাড়ির সামনে দিয়েই যাই।

দুর্গা ইতস্তত করিতে লাগিল, পরে একটু মুখ টিপিয়া হাসিল। নীরেনের মনে হইল এবার সে কথা বলিবে। পরীক্ষণে কিন্তু দুৰ্গা ঘাড় নাড়িয়া তাহার সহিত যাইতে হইবে না জানাইয়া দিয়া, বাড়ির পথ ধরিয়া চলিয়া গেল।

 

দুপুর বেলা। ছাদে কাপড় তুলিতে আসিয়া গোকুলের বউ নীরেনের ঘরের দুয়ারে উঁকি দিয়া দেখিল। গরমে নীরেন বিছানায় শুইয়া খানিকটা এপাশ-ওপাশ করিবার পর, নিদ্রার আশায় জলাঞ্জলি দিয়া, মেজেতে মাদুর পাতিয়া বাড়িতে পত্র লিখিতেছিল।

গোকুলের বউ হাসিয়া বলিল-ঘুমোও নি যে ঠাকুরপো? আমি ভাবলাম ঠাকুরপো ঘুমিয়ে পড়েচে বুঝি, আজ মোচার ঘণ্ট যে বড় খেলে না-পাতেই রেখে এলে, সেদিন তো সব খেয়েছিলে?

–আসুন বৌদি। মোচার ঘণ্টা খাবো কি? বাঙালে কাণ্ড সব; যে ঝাল তাতে খেতে বসে কি চোখে দেখতে পাই-কোনটা ঘণ্ট, কোনটা কি?

গোকুলের বউ ঘরের দুয়ারের গবরাট মাথাটা হেলাইয়া ঠেস দিয়া অভ্যস্তভাবে মুখের নিচু দিকটা আঁচল দিয়া চাপিয়া দাঁড়াইল।

-ইস, ঠাকুরপো, বড় শহুরে চাল দিচ্ছ যে! ওইটুকু ঝাল আর তোমাদের সেখানে কেউ খায় क्रा-न्म?

–মাপ করবেন বৌদি, এতে যদি “ওইটুকু’ হয়, তবে আপনাদের বেশিটা একবার খেয়ে না। দেখে আমি এখান থেকে যাচ্ছি নে! যা থাকে কপালে-যাহা বাহান্ন তাহা তিপ্লান্না! দিন একদিন চক্ষুলজার মায়া কাটিয়ে যত খুশি লঙ্কা।

-ওমা আমার কি হবে! চক্ষুলজার ভয়েই শিল-নোড়ার পাঠ তুলে দিয়ে চুপ করে বসে আছি নাকি ঠাকুরপো? শোনো কথা ঠাকুরপোর-বলে কিনা যাহা বাহান্ন…হাসির চোটে তাহার চোখে জল আসিয়া পড়িল। খানিকটা পরে সামলাইয়া লইয়া বলিল-আচ্ছা তোমাদের সেখানে গরম কেমন ঠাকুরপো?

—সেখানে, কোথায়? কলকাতায় না। পশ্চিমে? পশ্চিমের গরম কি রকম সে এখান থেকে কি বুঝতে পারবেন! সে বাংলাদেশে থেকে বোঝা যাবে না। বোশেখ মাসের দিকে রাত্রে কি কেউ ঘরের মধ্যে শূতে পারে? ছাদে বিকেলে জল ধরে ছাদ ঠাণ্ডা করে রেখে তাইতে রাত্রে শূতে হয়।

-আচ্ছা, তোমরা যেখানে থাকো এথান থেকে কতদূর?

—এখান থেকে রেলে প্রায় দু’দিনের রাস্তা। আজ সকালের গাড়িতে মাঝেরপাড়া স্টেশনে চড়লে কাল দুপুর-রাত্রে পৌছানো যায়।

–আচ্ছা ঠাকুরপো, শুনিচি নাকি গয়াকাশীর দিকে পাহাড় কেটে রেল নিয়ে গিয়েচে-সত্যি?

–সত্যি। অনেক বড় বড় পাহাড়, ওপরে জঙ্গল—তার ভেতর দিয়ে যখন রেলগাড়ি যায়। — একেবারে অন্ধকার, কিছু দেখা যায় না, গাড়ির মধ্যে আলো জ্বলে দিতে হয়।

গোকুলের বউ উৎসুকভাবে বলিল-আচ্ছা, ভেঙে পড়ে না?

–ভেঙে পড়বে কেন বৌদি? বড় বড় এঞ্জিনিয়ারে সুড়ঙ্গ তৈরি করেচে, কত টাকা খরচ করেচে, ভাঙলেই হল! এ কি আপনাদের রায়পাড়ার ঘাটের ধাপ যে দু’বেলা ভাঙচে?

175 Shares