পথের পাঁচালী

তাহার মনে খুশির আবার একটা প্রবল ঢেউ আসিল। উৎসবের নৈকট্য, রানুর দিদিব বাসরে রাত জাগা ও গান শুনিবার আশা

খুশিতে তাহার ইচ্ছা হইল সে মাঠের এধাব হইতে ওধার পর্যন্ত ছুটিয়া বেড়ায়।

একবার সে হাত দুটা ছড়াইয়া ডানার মতো লম্বা করিয়া দিয়া খানিকটা ঘুরপাক খাইযা খানিকটা ছুটিয়া গেল। সে উড়িতে চায়!..শরীর তো হালকা জিনিস-হাত ছড়াইয়া ডানার মতো বাতাস কাটিতে কাটিতে যদি যাওয়া হইত!

শুধু শব্দ করিবার আনন্দে সে শূকনো ঝবাপাতার রাশির উপর ইচ্ছা করিয়া জোরে জোরে পা ফেলিয়া মাচু মচু শব্দ করিতে করিতে চলিল। পাতা ভাঙিয়া গিয়া শুকনা শুকনা ধূলা মিশানো, খানিকটা সোদা সোদা খানিকটা তিক্ত গন্ধে জায়গাটা ভরিয়া গেল।

সামনে একটু দূরে সোনাডাঙার মাঠের দিকে যাইবার কাঁচা সড়ক। একখানা গরুর গাড়ি ক্যাঁচু ক্যাঁচু শব্দে মাঠের পথের দিকে যাইতেছে। টাটকা কাটা কঞ্চির ঘেরা বাঁধিযা তাহার উপর কাঁথা ও ছেড়া লাল নকশাপাড় কাপড় ঘিরিয়া ছাই তৈয়ারি করিয়াছে। ছাঁই-এর মধ্যে কাহাদের একটা ছোট মেয়ে একঘেয়ে, একটানা ছেলেমানুষ ধরনে কাঁদিতে কাঁদিতে যাইতেছে-কোন গায়ের চাষাদের মেয়ে বোধ হয় বাপের বাড়ি হইতে শ্বশুরবাড়ি চলিয়াছে।

দুর্গা অবাক হইয়া একদৃষ্টি গাড়িখানার দিকে চাহিয়া রহিল।

বিয়ের পর মা, বাবা, অপু-সব ছাড়িয়া এই রকম কোথায় কতদূরে চলিয়া যাইতে হইবে হয়তো-যখন তখন সেখান হইতে তাহারা আসিতে দিবে কি? সে এতক্ষণ একথা ভাবিয়া দেখে নাই—এই বাগান, বাসকফুলের ঝাড়, রান্তী গাইটা, উঠানের কাঁঠালতলাটা যাহা সে এত ভালোবাসে, এই শূকনো পাতার গন্ধ, ঘাটের পথ এইসব ছাড়িয়া যাইতে হইবে চিরকালের জন্য! ছই-এর মধ্যের ছোট্ট মেয়েটা বোধ হয় সেই দুঃখেই কাঁদিতেছে।

কাঁচা সড়কটা ছাড়াইয়া আর একটা ছোট্ট পোড়ো মাঠ পার হইলেই নদী।

ওপারের জেলেরা কি মাছ ধরিতেছে? খয়রা? এপারে আসিলে দু’পয়সার মাছ কিনিয়া বাড়ি লইয়া যাইত। অপু খয়রা মাছ খাইতে বড় ভালোবাসে।

বাড়ি ফিরিয়া সন্ধ্যার পর সে অনেকক্ষণ ধরিয়া পুতুলের বাক্স গোছাইল। ঘরের মেঝেতে তাহার মা তেল পুরিতে গিয়া অনেকটা কেরোসিন তেল ফেলিয়া দিয়াছে, তাহার গন্ধ বাহির হইতেছে, হাওয়াটা যেন একটু গরম। পুতুল-গুছানো প্রায় শেষ হইয়াছে, অপু আসিয়া বলিল-তুই, বুঝি আমার বাক্স থেকে ছোট্ট আরশিখানা বের করে নিয়েচিস দিদি?

–হুঁ-আরশি তো আমার-আমিই তো আগে দেখতে পেয়েছিলাম, তক্তপোশের নিচে পড়েছিল। যাও, আমি আরশি আমার বাক্সে রাখবো। বেটা ছেলে আবার আরশি নিয়ে কি হবে?

—বা রে, তোমার আরশি বই কি? ও-পাড়ার খুড়িমাদের বাড়ি থেকে মা তো কি বের্তেীতে আরশি এনেছিল, আমি তো আগেই মা’র কাছ থেকে চেয়ে নিয়েছিলাম। না দিদি, দাও

কথা শেষ করিয়াই সে দিদির পুতুলের বাক্সের কাছে বসিয়া পড়িয়া তাহার মধ্যে আরশি খুঁজিতে লাগিল।

দুৰ্গা ভাইয়ের গালে এক চড় লাগাইয়া দিয়া বলিল-দুন্টু কোথাকার-আমি পুতুল গুছিয়ে রাখচি আর উনি হাণ্ডুল-পাণ্ডুল করছেন- যা আমার বাক্সে হাত দিতে হবে না তোমায়-দোবো না আমি আরশি।

কিন্তু কথা শেষ না হইতেই অপু ঝাপাইয়া তাহার ঘাড়ের উপর পড়িয়া তাহার বৃক্ষ চুলের গোছা ধরিয়া টানিয়া আঁচড়াইয়া কামড়াইয়া তাহাকে অস্থির করিয়া তুলিল। কান্না আটকানো গলায় বলিতে লাগিল-কেন তুমি আমাকে মারবে? আমার লাগে না বুঝি?–দাও আমায়া-মাকে বোলে দেবো-লক্ষ্মীর চুপড়ি থেকে আলতা চুরি কোরেচ–

আলতা চুরির কথায় দুর্গা ক্ষেপিয়া গেল। ভাই-এর কান ধরিয়া তাহাকে কঁকুনি দিয়া উপরি উপরি পটাপট কয়েকটা চড় দিতে দিতে বলিল-আলতা নিইচি?-আমি আলতা নিইচি, লক্ষ্মীছাড়া দুষ্ট বাঁদর! আর তুমি যে লক্ষ্মীর চুপড়ির থেকে কড়িগুলো খুলে লুকিয়ে রেখেচ, মাকে বলে দেবো না?

চিৎকার, কান্না ও মারামারির শব্দ শুনিয়া সর্বজয়া ছুটিয়া আসিল।

ততক্ষণে দুর্গা অপুর কান ধরিয়া তাহাকে মাটিতে প্রায় শোয়াইয়া ফেলিয়াছে।–অপুও প্রাণপণে দুর্গার চুলের গোছা মুঠি পাকাইয়া টানিয়া এরূপ ধরিয়া আছে, যে দুর্গার মাথা তুলিবার ক্ষমতা নাই।

অপুর লাগিয়াছিল বেশি। সে কাঁদিতে কাঁদিতে বলিল-দ্যাখো না মা, আমার আরশিখানা বাক্স থেকে বের করে নিজের বাক্সে রেখে দিয়েচে-দিচ্ছে না-এমন চড় মেরেচে। গালে–

দুৰ্গা প্রতিবাদ করিয়া বলিল-না মা, দ্যাখো না আমার পুতুলের বাক্স গোছাচ্ছি, ও এসে সেগুলো সব–

সর্বজয়া আসিয়া মেয়ের পিঠের উপর দুম দুম করিয়া সজোরে কয়েকটি কিল বসাইয়া দিয়া বলিল-ধাড়ি মেয়ে-কেন তুই ওর গায়ে হাত দিবি যখন তখন?-ওতে আর তোতে অনেক তফাৎ জনিস?—আরশি-আরশি তোমার কোন পিণ্ডিতে লাগবে শুনি? কথায় কথায় উনি যান ওকে তেড়ে মারতে। মরণ আর কি! পুতুলের বাক্স-রোসো–

কথা শেষ না করিয়াই সে মেয়ের গুছানো পুতুলের বাক্স উঠাইয়া একটান মারিয়া বাহির উঠানে ছুঁড়িয়া ফেলিয়া দিল।

-ধাড়ি মেয়ের কোনো কাজ নেই, কেবল খাওয়া আর পাড়ায় পাড়ায় টো টো করে বেড়ানো-আর কেবল পুতুলের বাক্স আর পুতুলের বাক্স! ও সব টেনে এক্ষুনি বাঁশবাগানে ফেলে দিয়ে আসচি। দিচ্চি তোমার খেলা ঘুচিয়ে একেবারে–

দুৰ্গার মুখ দিয়া কথা বাহির হইল না। পুতুলের বাক্স তাহার প্রাণ, দিনের মধ্যে দশবার সে পুতুলের বাক্স গোছায়া-পুতুল, রাংতা, ছোপানো কাপড়, আলতা, কত কষ্টের সংগ্ৰহ করা নাটফল, টিনমোড়া আরশিখানা, পাখির বাসা-সব অন্ধকার উঠানের মধ্যে কোথায় কি ছড়াইয়া পড়িল। মা যে তাহার পুতুলের বাক্স এরূপ নির্মমভাবে ফেলিয়া দিতে পারে, একথা কখনও সে ভাবিতে পারিত না! কত কষ্টে কত জায়গা হইতে জোগাড় করা কত জিনিস উহার মধ্যে!

কোনো কথা বলিতে সাহস না করিয়া সে কেমন অবাক হইয়া রহিল।

অপুর কাছেও বোধ হয় শাস্তিটা কিন্তু বেশি কঠোর বলিয়াই ঠেকিল। সে আর কোনো কথা না বলিয়া চুপচাপ গিয়া শুইয়া পড়িল।

রাত্রি অনেক হইয়াছে, মেজেতে কেরোসিন তেলের গন্ধ বাহির হইতেছে, ঘরের মধ্যে বাঁশবাগানের মশা বিন বিনা করিতেছে। খানিকক্ষণ বসিয়া বসিয়া দুর্গা গিয়া চুপ করিয়া শুইয়া পড়িল।

ভাঙা জানোলা দিয়া ফাগুন জ্যোৎস্নার আলো বিছানায় পড়িয়াছে, পোড়ো ভিটার দিক হইতে ভুর ভুর করিয়া লেবু ফুলের গন্ধ আসিতেছে।

একবার তাহার মনে হইল উঠিয়া গিয়া পুতুলের বাক্সট ও ছড়ানো জিনিসগুলা তুলিয়া আনে-কাল সকালে কি আর পাওয়া যাইবে? কত কষ্টের জিনিসগুলা! কিন্তু সাহস পাইল না। আনিতে গেলে মা যদি আবার মারে?

অনেকক্ষণ কাটিয়া গেল। হঠাৎ সে গায়ের উপর কাহার হাত অনুভব করিল। অপু ভয়ে ভায়ে ডাকিল-দিদি? দুৰ্গা কোনো জবাব দিবার পূর্বেই অপু বালিশে মুখ গুজিয়া হাউ হাউ কবিয়া কঁদিয়া উঠিল-আমি আর করবো না-আমার ওপর রাগ করিসনে দিদি-তোর পায়ে পড়ি। কান্নাব আবেগে তাহার গলা আটকাইয়া যাইতে লাগিল।

দুৰ্গা প্রথমটা বিস্মিত হইল-পরে সে উঠিয়া বসিয়া ভাইয়ের কান্না থামাইবার চেষ্টা করিতে লাগিল-কাঁদিসনে, চুপ চুপ, মা শুনতে পেলে আবার আমায় বকবে, চুপ, কঁদতে নেই-আচ্ছা! আমি রাগ করবো না, কেঁদে না ছিঃ-চুপ–

তাহার ভয় হইতেছিল অপুর কান্না শুনিলে মা আবাব হয়তো তাহাকেই মারিাবে।

অনেক করিয়া সে ভাইয়ের কান্না থামাইল। পরে শুইয়া শুইয়া তাহাকে নানান গল্প, বিশেষত রানুর দিদির বিয়ের গল্প বলিতে লাগিল। একথা-ওকথাব পর অপু দিদিব গায়ে হাত দিয়া চুপি চুপি বলিল-একটা কথা বলবো দিদি?–তোর সঙ্গে মাস্টার মশায়ের বিয়ে হবে। —

দুৰ্গার লজ্জা হইল, সঙ্গে সঙ্গে তাহার অত্যন্ত কৌতূহলও হইল; কিন্তু ছোট ভাই-এর কাছে এ সম্বন্ধে কোনো কথাবার্তা বলিতে তাহার সংকোচ হওয়াতে সে চুপ করিয়া রহিল।

অপু আবার বলিল—খুড়িমা বলছিল রানুর মায়ের কাছে আজ বিকালে। মাস্টার মশায়ের নাকি অমত নেই–

কৌতুহলের আবেগে চুপ করিয়া থাকা অসম্ভব হইয়া উঠিল। সে তাচ্ছিল্যের সুরে বলিল— হ্যাঁ বলছিল-যাঃ-তোর সব যেমন কথা–

অপু প্রায় বিছানায় উঠিয়া বসিল,—সত্যি বলচি দিদি, তোর গা ছুঁয়ে বলচি। আমি সেখানে দাঁড়িয়ে, আমাকে দেখেই তো কথা উঠল। বাবাকে দিয়ে পত্তর লেখাবে সেই মাস্টার মশায়ের বাবা যেখানে থাকেন সেখানে–

–মা জানে?

—আমি এসে মাকে জিজ্ঞেস করবো ভাবলাম-ভুলে গিইচ। জিজ্ঞেস করবো দিদি মা বোধ হয় শোনে নি; কাল খুড়িমা মাকে ডেকে নিয়ে বলবে বলছিল–

পরে সে বলিল-তুই কত রেলগাড়ি চড়বি দেখিস, মাস্টার মশাইরা থাকেন। এখান থেকে অনেক দূরে-রেলে যেতে হয়–

দুৰ্গা চুপ করিয়া রহিল।

সে রেলগাড়ির ছবি দেখিয়াছে।–অপুর একখানা বইয়ের মধ্যে আছে। খুব লম্বা, অনেকগুলো চাকা, সামনের দিকে কল, সেখানে আগুন দেওয়া আছে, ধোঁয়া ওড়ে। রেলগাড়িখানা আগাগোড়া লোহার, চাকাও তাই-গরুর গাড়ির মতো কাঠের চাকা নয়। রেল লাইনের ধারে কোনো খড়ের বাড়ি নাই, থাকিতে পারে না, পুড়িয়া যায়। রেলগাড়ি যখন চলে তখন তাহার নল হইতে আগুন বাহির হয়। কিনা! সে ভাই-এর গায়ে হাত বুলাইয়া বলিল-তোকেও সঙ্গে করে নিয়ে যাবো। তাহার পর দুজনেই চুপ করিয়া ঘুমাইবার জোগাড় করিল। ঘুমাইতে গিয়া একটা কথা বার বার দুর্গার মনে হইতেছিল–ঠাকুর সুদৰ্শন তাহার কথা শুনিয়াছেন! আজই তো সুদর্শনের কাছে সে-ঠাকুরের বড় দয়া-মা তো ঠিক কথা বলে!

175 Shares