পথের পাঁচালী

কিন্তু বেচারি সর্বজয়া কি করিয়া জানিবে, সকলেই তো কিছু ‘সর্ব-দৰ্শন-সংগ্ৰহ পড়ে নাই, বা সকলেই কিছু পারদের গুণও জানে না।

আকাশে তাহা হইলে তো সকলেই উড়িত!

বিংশ পরিচ্ছেদ

অনেকদিন হইতে গ্রামের বৃদ্ধ নরোত্তম দাস বাবাজির সঙ্গে অপুর বড় ভাব। গাঙ্গুলি পাড়ার গৌরবর্ণ দিব্যাকান্তি, সদানন্দ বৃদ্ধ সামান্য খড়ের ঘরে বাস করেন। বিশেষ গোলমাল ভালোবাসেন না, প্রায়ই নির্জনে থাকেন, সন্ধ্যার পর মাঝে মাঝে গাঙ্গুলিদের চণ্ডীমণ্ডপে গিয়া বসেন। অপুর বাল্যকাল হইতেই হরিহর ছেলেকে সঙ্গে করিয়া মাঝে মাঝে নরোত্তম দাসের কাছে লইয়া যাইত—সেই হইতেই দুজনের মধ্যে খুব ভাব। মাঝে মাঝে অপু গিয়া বৃদ্ধের নিকট হাজির হয়, ডাক দেয়,-দাদু আছো? বৃদ্ধ তাড়াতাড়ি ঘর হইতে বাহির হইয়া তালপাতার চাটাইখানা দাওয়ায় পাতিয়া দিয়া বলেন- এসো দাদাভাই এসো, বসো বসো–

অন্যস্থানে অপু মুখচোরা, মুখ দিয়া কথা বাহির হয় না-কিন্তু এই সরল শান্তদর্শন বৃদ্ধের সঙ্গে সে সম্পূর্ণ নিঃসংকোচে মিশিয়া থাকে, বৃদ্ধের সঙ্গে তাহার আলাপ, খেলার সঙ্গীদের সঙ্গে আলাপের মতো ঘনিষ্ঠ, বাধাহীন ও উল্লাস-ভরা! নরোত্তম দাসের কেহ নাই, বৃদ্ধ একাই থাকেন।– এক স্বজাতীয় বৈষ্ণবের মেয়ে কাজকর্ম করিয়া দিয়া চলিয়া যায়। অনেক সময় সারা বিকাল ধরিয়া অপু বসিয়া বসিয়া গল্প শোনে ও গল্প করে। একথা সে জানে যে, নরোত্তম দাস বাবাজি তাহার বাবার অপেক্ষাও বয়সে অনেক বড়, অন্নদা রায়েব অপেক্ষাও বড়-কিন্তু এই বয়োবৃদ্ধতার জন্যই অপুর কেমন যেন মনে হয় বৃদ্ধ তাহার সতীর্থ, এখানে আসিলে তাহার সকল সংকোচ, সকল লজ্জা আপনা হইতেই ঘুচিয়া যায়। গল্প করিতে করিতে, অপু মন খুলিয়া হাসে, এমন সব কথা বলে যাহা অন্যস্থানে সে ভয়ে বলিতে পারে না, পাছে প্ৰবীণ লোকেরা কেহ ধমক দিয়া ‘জ্যাঠা ছেলে’ বলে। নরোত্তম দাস বলেন–দাদু, তুমি আমার গৌর,-তোমাকে দেখলে আমার মনে হয় দাদু, আমার গৌর তোমার বয়সে ঠিক তোমার মতই সুন্দর, সুশ্ৰী, নিম্পাপ ছিলেন-ওইরকম ভাব-মাখানো চোখ ছিল তাঁরও–

অন্যস্থানে এ কথায় অপুর হয়তো লজ্জা হইত, এখানে সে হাসিয়া বলে–দাদু তা হলে এবার তুমি আমায় সেই বইখানার ছবি দেখাও

বৃদ্ধ ঘর হইতে ‘প্রেমভক্তি-চন্দ্ৰিকা’ খানা বাহির করি যা আনেন। তাহার অত্যন্ত প্রিয় গ্রন্থ, নির্জনে পড়িতে পড়িতে তিনি মুগ্ধ বিভোর হইয়া থাকেন। ছবি মোট দু’খনি, দেখানো শেষ হইয়া গেলে বৃদ্ধ বলেন, আমি মরবাব সমযে বইখানা তোমাকে দিয়ে যাবো দাদু, তোমার হাতে বইয়ের অপমান হবে না–

তাহার এক শিষ্য মাঝে মাঝে পদ রচনা করিয়া তাহাকে শুনাইতে আসিত। বৃদ্ধ বিরক্ত হইয়া বলিতেন, পদ বেঁধেচো বেশ করেচো, ওসব আমায় শুনিয়ে না বাপু, পদকর্তা ছিলেন বিদ্যাপতি চণ্ডীদাস-ৰ্তাদের পর ওসব আমার কানে বাজে-ওসব গিয়ে অন্য জায়গায় শোনাও।

সহজ, সামান্য, অনাড়ম্বর জীবনের গতিপথ বাহিয়া এখানে কেমন যেন একটা অন্তঃসলিলা মুক্তির ধারা বহিতে থাকে, অপুর মন সেটুকু কেমন করিয়া ধরিয়া ফেলে। তাহার কাছে তাহা তাজা মাটি, পাখি, গাছপালার সাহচর্যের মতো অন্তরঙ্গ ও আনন্দপূর্ণ ঠেকে বলিয়াই দাদুর কাছে আসিবার আকর্ষণ তাহার এত প্ৰবল।

ফিরিবার সময় অপু নরোত্তম দাসের উঠানের গাছতলাটা হইতে একরাশি মুচুকুন্দ-চাঁপা ফুল কুড়াইয়া আনে। বিছানায় সেগুলি সে রাখিয়া দেয়। তাহার পরে সন্ধ্যায় আলো জুলিলেই বাবার আদেশে পড়িতে বসিতে হয়। ঘণ্টা-খানেকের বেশি কোনোদিনই পড়িতে হয় না, কিন্তু অপুর মনে হয়। কত রােতই যে হইয়া গেল! পরে ছুটি পাইয়া সে শূইতে যায়, বিছানায় শুইয়া পড়ে,–আর অমনি আজকার দিনের সকল খেলাধুলা, সারাদিনের সকল আনন্দের স্মৃতিতে ভরপুর হইয়া বিছানায় রাখা মুচকুন্দ-চ্যাপার গন্ধ তাহার ক্লাস্ত দেহমনকে খেলাধুলার অতীত ক্ষণগুলির জন্য বিরহাতুর বালকপ্রাণকে অভিভূত করিয়া বহিতে থাকে। বিছানায় উপুড় হইয়া ফুলের রাশির মধ্যে মুখ ড়ুবাইয়া সে অনেকক্ষণ ঘ্রাণ লয়।

সেদিন তাহার দিদি চুপি চুপি বলে—চড়ুইভাতি করবি অপু?

তাহাদের দোর দিয়া পাড়ার সকলে কুলুই-চণ্ডীর ব্রতের বন-ভোজনে গ্রামের পিছনের মাঠে যায়, তাহার মাও যায়। কিন্তু তাহকে লইয়া যায় না। সেখানে সব নিজের নিজের জিনিসপত্র। অত চাল-ডাল তাহদের নাই। আর বন-ভোজনে গিয়া সকলে বাহির করে কত কি জিনিস, ভালো চাল, ডাল, ঘি, দুধ-তাহার মা বাহির করে শুধু মোটা চাল, মটরের-ডাল-বাটা, আর দুই একটি বেগুন। পাশে বসিয়া ভুবন মুখুজ্যেদের সেজ ঠাকরুনের ছেলেমেয়েরা নতুন আখের গুড়ের পাটালি দিয়া দুধ ও কলা মাখিয়া ভাত খায়, নিজের ছেলেমেয়েদের জন্য তাহার মায়ের মন কেমন করে।

তাহার অপুও ওই-রকম দুধ কলা দিয়া পাটালি মাখিয়া ভাত খাইতে ভালোবাসে!…

শান্ত মাঠের ধারের বনে রাঙা সন্ধ্যা নামে, বাঁশবনের পথে ফিরিতে শুধু ছেলের মুখই মনে পড়ে।

নীলমণি রায়ের জঙ্গলাকীর্ণ ভিটার ওধারের খানিকটা বন দুর্গা নিজের হাতে দা দিয়া কাটিয়া পরিষ্কার করিয়া ভাইকে বলিল-দাঁড়িয়ে দ্যাখ, তেঁতুলতলায় মা আসচে। কিনা-আমি চাল বের করে। নিয়ে আসি শিগগির করে—

একটা ভালো নারিকেলের মালায় দুই পলা তেল চুপি চুপি তেলের ভাড়টা হইতে বাহির করিয়া আনিল। অপহৃত মালামাল বাহিরে আনিয়া ভাইয়ের জিম্মা করিয়া বলিল-শিগগির নিয়ে যা, দৌড়ে অপু—সেইখানে রেখে আয়, দেখিস যেন গরুটরুতে খেয়ে ফেলে না–

এমন সময় মাতোর মা তাহার ছোট ছেলেকে পিছনে লইয়া খিড়কির দোর দিয়া উঠানে ঢুকিল। দুর্গা বলিল—এদিকে কোথেকে তমরেজের বৌ?

মাতোর মায়ের বয়সও খুব বেশি নয়, দেখিতেও মন্দ ছিল না, কিন্তু স্বামীর মৃত্যুর পর হইতেই কষ্টে পড়িয়া মলিন ও শীর্ণ হইয়া পড়িয়াছে। বলিল—কুঠির মাঠে গিয়েছিলাম কাঠ কুভূতি-কুঁইচের মালা নেবা?

দুৰ্গা তো বন-বাগান খুঁজিয়া নিজেই কত বৈঁচিফল প্রায়ই তুলিয়া আনে, ঘাড় নাড়াইয়া বলিল-সে কিনিবে না।

মাতোর মা বলিল-নেও না দিদি ঠাকুরোন, বেশ মিষ্টি বুইচে। মধুখালির বিলির ধারে থে তুলেলাম-কেঁচড় হইতে একগাছা মালা বাহির করিয়া দেখাইয়া বলিল-দেখো কত বড় বড়! কািঠ নিয়ে বাজারে যেতি, বিকি কত্তি, পয়সা পেতি বড়ড বেলা হয়ে যাবে, মাতোরে ততক্ষণ এক পয়সার মুড়ি কিনে দেতাম। নেও, পয়সায় দু গাছ দেবানি

দুৰ্গা রাজি হইল না, বলিল-অপু, ঘটিতে একগাল খানিক চালভাজা আছে, নিয়ে এসে মাতোর হাতে দে তো!

উহারা খিড়কি দোর দিয়াই পুনরায় বাহির হইয়া গেলে দুজনে জিনিসপত্র লইয়া চলিল।

চারিদিক বনে ঘেরা। বাহির হইতে দেখা যায় না। খেলাঘরের মাটির ছোবার মতো ছোট্ট একটি হ্যাঁড়িতে দুৰ্গা ভাত চড়াইয়া দিয়া বলিল-এই দ্যাখ্য’অপু, কত বড় বড় মেটে আলুর ফল নিয়ে এসিটি এক জায়গা থেকে। পুঁটিদের তালতলায় একটা ঝোপের মাথায় অনেক হয়ে আছে, ভাতে দোবো…

অপু মহা উৎসাহে শুকনা লতা-কাটি কুড়াইয়া আনে। এই তাঁহাদের প্রথম বন-ভোজন। অপুর এখনও বিশ্বাস হইতেছিল না যে, এখানে সত্যিকারের ভাত-তরকারি রান্না হইবে, না খেলাঘরের। বন-ভোজন, যা কতবার হইয়াছে, সে রকম হইবে,-ধুলার ভাত, খাপরার আলুভাজা, কাঁঠাল পাতার লুচি?

কিন্তু বড় সুন্দর বেলাটি-বড় সুন্দর স্থান বন-ভোজনের! চারিধারে বনঝোপ, ওদিকে তেলাকুচা লতার দুলুনি, বেলগাছের তলে জঙ্গলে শ্যাওড়া গাছে ফুলের ঝাড়, আধাপোড়া কটা দূর্বঘাসের উপর খঞ্জন পাখিরা নাচিয়া নাচিয়া ছুটিয়া বেড়াইতেছে, নির্জন ঝোপ-ঝাপের আড়ালে নিতৃত নিরালা স্থানটি। প্রথম বসন্তের দিনে ঝোপে ঝোপে নতুন কচি পাতা, ঘেটুফুলের ঝাড় পোড়ো ভিটাটা আলো করিয়া ফুটিয়া আছে, বাতাবি লেবু গাছটায় কয়দিনের কুয়াশায় ফুল অনেক ঝরিয়া গেলেও থোপা থোপা সাদা সাদা ফুল উপরেব ডালে চোখে পড়ে।

দুৰ্গা আজকাল যেন এই গাছপালা, পথঘাট এই অতি পরিচিত গ্রামের প্রতি অন্ধিসন্ধিকে অত্যন্ত বেশি করিয়া আঁকড়াইয়া ধরিতেছে। আসন্ন বিরহের কোন বিষাদে এই কত প্রিয় গাবতলার পথটি, ওই তাহদের বাড়ির পিছনের বাঁশবন, ছায়াভিরা নদীর ঘাটটি আচ্ছন্ন থাকে। তাহার অপুতাহার সোনার খোকা ভাইটি, যাহাকে এক বেলা না দেখিয়া সে থাকিতে পারে না, মন ফু-ফু করেতাহাকে ফেলিয়া সে কতদূর যাইবে!

আর যদি সে না ফেরে– যদি নিতম পিসির মতো হয়?

এই ভিটাতেই নিতম পিসি ছিল, বিবাহ হইয়া কতদিন আগে কোথায় চলিয়া গিয়াছে, আর বাপের ভিটাতে ফিরিয়া আসে নাই। অনেককাল আগেব। কথা-ছেলেবেলা হইতে গল্প শুনিয়া আসিতেছে। সকলে বলে বিবাহ হইয়াছিল মুর্শিদাবাদ জেলায় -সে কতদূরে? কোথায়? কেহ আব তাহার খোঁজখবব করে না, আছে কি নাই, কেহ জানে না। ব্যাপকে নিতম পিসি আর দেখে নাই, মাকে আর দেখে নাই, ভাই-বোনকেও না। সব একে একে মবিন্যা গিযাছে। মাগো, মানুষ কেমন করিয়া এমন নিষ্ঠুর হয়! কেন তাহার খোজ কেহ যে আব্ব করে নাই! কতদিন সে নির্জনে এই নিতম পিসিব কথা ভাবিয়া চোখের জল ফেলিয়াছে! আজি যদি হঠাৎ সে ফিরিয়া আসে–এই ঘোর জঙ্গল-ভরা জনশূন্য বাপেব ভিটা দেখিয়া কি ভাবিবে?

175 Shares