পথের পাঁচালী

তাহারও যদি ওইরকম হয়? ওই তাহার বাবাকে, মাকে, অপুকে ছাড়িয-আব কখনও দেখা হইবে না-কখনও না-কখনও না-এই তাহদের বাড়ি, গাবতলা, ঘাটের পথ?

ভাবিলে গা শিহরিয়া ওঠে, দরকাব নাই! কি জানি কেন আজকাল তাহার মনে হয় একটা কিছু তাহার জীবনে শীঘ্ন ঘটিবে। একটা এমন কিছু জীবনে শীঘ্রই আসিতেছে যাহা আর কখনও আসে না। দিন-রাতে খেলা-ধুলার, কাজ-কর্মের ফাঁকে ফাঁকে এ কথা তাহার প্রায়ই মনে হয়. ঠিক সে বুঝিতে পারে না তাহা কি, বা কেমন করিয়া সেটার আসিবার কথা মনে উঠে, তবুও মনে হয়, কেবলই মনে হয়, তাহা আসিতেছে…আসিতেছে.শীঘ্রই আসিতেছে…

চড়ুইভাতির মাঝামাঝি অপূদের বাড়ির উঠানে কাহার ডাক শোনা গেল। দুর্গা বলিলবিনির গলা যেন-নিয়ে আয় তো ডেকে অপু। একটু পরে অপুর পিছনে পিছনে দুৰ্গার সমবয়সি একটি কালো মেয়ে আসিল-একটু হাসিয়া যেন কতকটা সম্রামের সুরে বলিল-কি হচ্চে দুর্গা দিদি?

দুর্গা বলিল-আয় না বিনি, চড়ুইভাতি কচ্চি—বোস—

মেয়েটি ও পাড়ার কালীনাথ চক্কত্তির মেয়ে-পরনে আধময়লা শাড়ি, হাতে সবু সৰ্বকাচের চুড়ি, একটু লম্বা গড়ন, মুখ নিতান্ত সাদাসিধা। তাহার বাপ যুগীর বামুন বলিয়া সামাজিক ব্যাপারে। পাড়ায় তাহাদের নিমন্ত্রণ হয় না, গ্রামের একপাশে নিতান্ত সংকুচিত ভাবে বাস করে। অবস্থাও ভালো নয়। বিনি দুর্গার ফরমাইজ খাটিতে লাগিল খুব। বেড়াইতে আসিয়া হঠাৎ সে যেন একটা লাভজনক ব্যাপারের মধ্যে আসিয়া পড়িয়াছে, এখন ইহারা তাহাকে সে উৎসবের অংশীদার স্বীকার করিবে কি না করিবে-এরপ একটা দ্বিধামিশ্রিত উল্লাসের ভাব তাহার কথাবার্তায় ভাবভঙ্গিতে প্ৰকাশ পাইতেছিল। দুর্গা বলিল-বিনি, আর দুটো শূকনো কাঠ দাখ, তো-আগুনটা জ্বলচে না ভালো–

বিনি তখনই কাঠ আনিতে ছুটিল এবং একটু পরে এক বোঝা শুকনো বেলের ডাল আনিয়া হাজির করিয়া বলিল-এতে হবে দুগগা দিদি-না। আর আনবো?…

দুৰ্গা যখন বলিল-বিনি এসেচে-ও-ও তো এখানে খাবে।–আর দুটো চাল নিয়ে আয় অপু–

বিনির মুখখানা খুশিতে উজ্জ্বল হইয়া উঠিল। খানিকটা পরে বিনি জল আনিয়া দিল। আগ্রহের সুরে জিজ্ঞাসা করিল—কি কি তরকারি দুগগা দিদি?

ভাত নামাইয়া দুৰ্গা তেলটুিকু দিয়া বেগুন তাহাতে ফেলিয়া দিয়া ভাজে। খানিকটা পরে সে অবাক হইয়া ছোবার দিকে চাহিয়া থাকে, অপুকে ডাকিয়া বলে-ঠিক একেবারে সত্যিকারের বেগুন ভাজার মতো। রং হচ্চে দেখচিস অপু! ঠিক যেন মা’র রান্না বেগুন-ভাজা না?

অপুরও ব্যাপারটা আশ্চর্য বোধ হয়। তাহারও এতক্ষণ যেন বিশ্বাস হইতেছিল না যে, তাহাদের বন-ভোজনে সত্যিকার ভাত, সত্যিকার বেগুন-ভাজা সম্ভবপর হইবে! তাহার পর তিনজনে মহা আনন্দে কলার পাতে খাইতে বসে, শুধু ভাত আর বেগুন-ভাজা আর কিছু না। অপু গ্ৰাস মুখে তুলিবার সময় দুৰ্গা সেদিকে চাহিয়া ছিল, আগ্রহের সঙ্গে জিজ্ঞাসা করে,-কেমন হয়েচে রে বেগুনভাজা?

অপু বলে-বেশ হয়েচে দিদি, কিন্তু নুন হয় নি যেন—

লবণকে রন্ধনের উপকরণের তালিকা হইতে ইহারা অদ্য একেবারেই বাদ দিয়াছে, লবণের বালাই রাখে নাই। কিন্তু মহাখুশিতে তিনজনে কোষো মেটে আলুর ফল ভাতে ও পানসে আধাপোড়া বেগুন-ভাজা দিয়া চড়ুইভাতির ভাত খাইতে বসিল। দুর্গার এই প্রথম রান্না, সে বিস্ময়মিশানো আনন্দের সঙ্গে নিজের হাতের শিল্প-সৃষ্টি উপভোগ করিতেছিল! এই বন-ঝোপের মধ্যে, এই শূকনো আতাপাতার রাশের মধ্যে, খেজুর তলায় ঝরিয়া-পড়া খেজুর পাতার পাশে বসিয়া সত্যিকারের ভাত তরকারি খাওয়া।

খাইতে খাইতে দুর্গা অপুর দিকে চাহিয়া হি হি করিয়া খুশির হাসি হাসিল। খুশিতে ভাতের দলা তাহার গলার মধ্যে আটকাইয়া যাইতেছিল যেন। বিনি খাইতে খাইতে ভয়ে ভয়ে বলিল—একটু তেল আছে দুগাগাদি? মেটে আলুর ফল ভাতে মেখে নিতাম।

দুৰ্গা বলিল-অপু, ছুটে নিয়ে আয় একটু তেল—

যে জীবন কত শত পুলকের ভাণ্ডার, কত আনন্দ-মুহূর্তের আলো-জ্যোৎস্নার অবদানে মণ্ডিত, ইহাদের সে মাধুরীময় জীবনযাত্রার সবে তো আরম্ভ। অনন্ত যে জীবনপথ দূর হইতে বহুদূরে দৃষ্টির কোন ওপারে বিসৰ্পিত, সে পথের ইহারা নিতান্ত ক্ষুদ্র পথিকদল, পথের বাঁকে ফুলেফলে দুঃখেসুখে, ইহাদের অভ্যর্থনা একেবারে নূতন।

আনন্দ! আনন্দ! প্রসারের আনন্দ, জীবনের মাঝে মাঝে যে আড়াল আছে, বিশাল তুষারমৌলি গিরিসংকটের ওদিকের যে পথটা দেখিতেছে না, তাহার আনন্দ! আজকের আনন্দ! সামান্য, সামান্য ছোটখাটো তুচ্ছ জিনিসের আনন্দ!

অপু বলিল-মাকে কি বলবি দিদি? আবার ওবেলা ভাত খাবি?

—দূর মাকে কখনও বলি! সন্ধের পর দেখিস খিদে পাবে এখন—

যুগীর বামুন বলিয়া পাড়ায় জল খাইতে চাহিলে লোকে ঘটিতে করিয়া জল খাইতে দেয়, তাহাও আবার মজিয়া দিতে হয়। বিনি দু-একবার ইতস্তত করিয়া অপুর গ্লাসটা দেখাইয়া বলিলআমার গালে একটু জল ঢেলে দেও তো অপু? জলি তেষ্টা পেয়েছে!

অপু বলিল-নাও না বিনিদি, তুমি নিয়ে চুমুক দিয়ে খাও না!

তবু যেন বিনির সাহস হয় না। দুর্গা বলিল-নে না বিনি, গেলাসটা নিয়ে খা না?

খাওয়া-দাওয়া হইয়া গেলে দুর্গা বলিল-হ্যাঁড়িটা ফেলা হবে না। কিন্তু, আবার আর একদিন বনভোজন করবো-কেমন তো, ওই কুলগাছটার ওপরে টাঙিয়ে রেখে দেবো।

অপু বলিল-হ্যাঁঠা, ওখানে থাকবে কিনা? মাতোর মা কাঠ কুড়োতে আসে, দেখতে পেলে নিয়ে যাবে দিদি—ভারি চোর–

একটা ভাঙা পাচিলের ঘুলঘুলির মধ্যে ছোবাটা দুৰ্গা রাখিয়া দিল।

অপুর বুক টিপ টিপ করিতেছিল। ওই ঘুলঘুলিটার ওপিঠে আর একটা ছোট ঘুলঘুলি আছে, তাহার মধ্যে অপু লুকাইয়া চুবুটের বাক্স রাখিয়া দিয়াছে, দিদি সেদিকে যদি যাইয়া পড়ে।

নেড়াদের বাড়িতে কিছুদিন আগে নেড়ার ভগ্নীপতি ও তঁহার এক বন্ধু আসিয়াছিল। কলিকাতার কাছে কোথায় বাড়ি। খুব বাবু, খুব চুবুট খায়। এই একবার খাইল, আবার এই খাইতেছে। অপুর মনে মনে অত্যন্ত ইচ্ছা হইয়াছিল সেও একবাব চুবুট খাইয়া দেখিবে, কেমন লাগে। সে নেড়ার সঙ্গে পরামর্শ করিয়া গ্রামের হরিশ যুগীর দোকান হইতে তিন পয়সায় রাঙা কাগজ মোড়া দশটি চুরুট কিনিয়া আনে। সেদিন এই ঘন জঙ্গলের মধ্যে একা বসিয়া চুপি চুপি একটা সিগারেট ধরাইয়া খাইয়াছিল-ভালো লাগে নাই, তেতো তেতো, কেমন একটা বঁটোঝ, দুটান খাইয়া সে আর খাইতে পারে নাই, কিন্তু তাহার ভাগের বা ক চারটি চুরুট সে ফেলিয়াও দিতে পারে নাই, নেড়ার ভগ্নীপতির নিকট সংগৃহীত একটা খালি চুবুটাম বাক্সে সে-কয়টি সে ওই পোড়োভিটের জঙ্গলে ভাঙা পাঁচিলের ঘুলঘুলিতে লুকাইয়া রাখিয়া দিয়াছে। প্রথম চুবুট খাইবার দিন চুবুট টানা শেষ হইয়া গেলে ভয়ে তাহার বুকের মধ্যে কেমন করিয়া উঠিতেছিল, পাছে মুখের গন্ধে মা টের পায়। পাকা কুল অনেক করিয়া খাইয়া নিজের মুখের হাই হাত পাতিয়া ধরিয়া অনেকবার পরীক্ষা করিয়া। তবে সে সেদিন পুনর্বার মনুষ্যসমাজে প্রবেশ করিয়াছিল। যায় বুঝি আজ বামলসুদ্ধ ধরা পড়িয়া!

কিন্তু দিদির পাচিলের ওপিঠে যাইবার দরকার হয় না। এপিঠেই কাজ। সারা হইয়া যায়।

একবিংশ পরিচ্ছেদ

কথাটা সর্বজয়া ঘাটে গিয়া পাড়ার মেয়েদের মুখে শুনিল।

আজ কয়েকদিন হইতে নীরেনের সঙ্গে অন্নদা রায়ের, বিশেষ করিয়া তাঁহার ছেলে গোকুলের মনান্তর চলিতেছিল। কাল দুপুর বেলা নাকি খুব ঝগড়া ও চেঁচামেচি বাধে। ফলে কাল রাত্রেই নীরেন জিনিসপত্র লইয়া এখান হইতে চলিয়া গিয়াছে। অন্নদা রায়ের প্রতিবেশী যজ্ঞেশ্বর দীঘড়ীর স্বী হরিমতি বলিতেছিলেন–সত্যি মিথ্যে জানিনে, ক’দিন থেকে তো নানারকম কথা শুনতে পাচ্ছি-আমি বাপু বিশ্বোস করিনে, বেঁটে তেমন নয়। আবার নাকি শুনলাম নীরেন লুকিয়ে টাকা দিয়েছে, বৌ নাকি টাকা কোথায় পাঠিয়েছিল, নীরেনের হাতের লেখা রসিদ ফিরে এসে গোকুলের হাতে পড়েচে এই সব।—যাক বাপু, সে সব পরের কুচ্ছ শুনে কি হবে? নীরেন শুনলাম বলচে-আপনারা সকলে মিলে একজনের ওপর অত্যাচার কর্তে পারেন। তাতে দোষ হয় না?–আপনারা যা ভাবেন ভাবুন, বৌ-ঠাকরুন। একবার হুকুম করুন, আমি ওঁকে এই দণ্ডে আমার হারানো মায়ের মতো মাথায় করে নিয়ে যাবো।–তারপর আপনারা যা করবার করবেন। তারপর খুব হৈ চৈ খানিকক্ষণ হল-সন্দের আগেই সে গয়লাপাড়া থেকে একখানা গাড়ি ডেকে আনলে, জিনিসপত্তর নিয়ে চলে গেল।

সর্বজয়া কথাটা শুনিয়া বড় দমিয়া গেল। ইতিমধ্যে স্বামীকে দিয়া অন্নদা রায়কে নীচেরনের পিতার নিকট এ বিবাহ সম্বন্ধে পত্র লিখিতে অনুরোধ করিয়াছে। নীরেনকে আরও দুইবার বাড়িতে নিমন্ত্ৰণ করিয়াছিল–ছেলেটিকে তাহার অত্যন্ত পছন্দ হইয়াছে। হরিহর তাহাকে অনেকবার বুঝাইয়াছে, নীরেনের পিতা বড়লোক-তাহদের ঘরে তিনি কি আর পুত্রের বিবাহ দিবেন? সর্বজয়া কিন্তু আশা ছাড়ে নাই, তাহার মনের মধ্যে কোথায় যেন সাহস পাইয়াছে-এ বিবাহের যোগাযোগ যেন দুরাশা নয়, ইহা ঘটিবে। হরিহর মনে মনে বিশ্বাস না করিলেও স্ত্রীর অনুরোধে অন্নদা রায়কে কয়েকবার তাগিদ দিয়াছিল বটে। কিন্তু এখন যে বড় বিপদ ঘটিল!

175 Shares