পথের পাঁচালী

আজ কিন্তু অপুর মনে হইল, বাহিব হইতে কি একটা প্ৰচণ্ড শক্তি আসিয়া তাহাকে তাহার বাবার নিকট হইতে সরাইযা লইয়া গিযাছে। বাবা নির্জন ছায়াভবা বৈকালে বাঁশ বন ঘেরা বাড়িতে একা বসিয়া বসিয়া লিখিতেছে, কিন্তু এমন শক্তি নাই যে, তাহাকে বসাইয়া রাখে। এখন যদি বলে—খোকা, এসে পড়তে বসো-আমুনি চারিদিক হইতে একটা যেন ভয়ানক প্রতিবাদের হট্টগোল উঠিবে। সকলে যেন বলিবে-না, না, এ হয় না! এ হয় না! যাত্রা যে বসে বসে!…কোনো উল্লাসের প্রবল শক্তি তাহার বাবাকে যেন নিতান্ত অসহায় নিরীহ দুর্বল করিয়া দিয়াছে। সাধ্য নাই যে, তাহার পড়িবার কথা পর্যন্ত মুখে উচ্চারণ করে। বাবার জন্য অপুর মন কেমন করে।

দুৰ্গা বলিল-অপু, তুই মাকে বল না। আমিও দেখতে যাবো। অপু বলে—ম, দিদি কেন আসুক না। আমার সঙ্গে? চিক দিয়ে ঘিরে দিয়েচে, সেইখেনে বসবে?

মা বলে-এখন থাক, আমি ওই ওদের বাড়ির মেয়েরা যাবে, তাদের সঙ্গে যাবো,-আমার সঙ্গে যাবে এখন।

বারোয়ারিতলায় যাইবার সময় দুৰ্গা পিছন হইতে তাহাকে ডাকিল-শোন অপু। পরে সে কাছে আসিয়া হাসি-হাসি মুখে বলিল-হোত পাত দিকি! অপু হাত পাতিতেই দুৰ্গা তাহার হাতে দুটা পয়সা রাখিয়াই তাহার হাতটা নিজের দুহাতের মধ্যে লইয়া মুঠা পাকাইয়া দিয়া বলিল-দু দায়সায় মুড়কি কিনে খাস, নয়তো যদি নিচু বিক্রি হয় তো কিনে খাস।

ইহার দিনসাতেক পূর্বে একদিন অপু আসিয়া চুপি চুপি দিদিকে জিজ্ঞাসা করিয়াছিল–তোর পুতুলের বাক্সে পয়সা আছে? একটা দিবি? দুর্গা বলিয়াছিল–কি হবে পয়সা তোর? অপু দিদির মুখের দিকে চাহিয়া একটুখানি হাসিয়া বলিল-নিচু খাবো-কথা শেষ করিয়া সে পুনরায় লজ্জার হাসি হাসিল। কৈফিয়তের সুরে বলে-বোষ্টমদের বাগানে ওরা মাচা বেঁধেচে দিদি, অনেক নিচু পেড়েচে, দু-কুড়ি-ইই-এক পয়সার ছটা, এই এত বড় বড়, একেবারে সিঁদুরের মতো রাঙা, সত্যু কিনলে সাধন। কিনলে-পরে একটু থামিয়া জিজ্ঞাসা করিল–আছে দিদি?

দুর্গার পুতুলের বাক্সে সেদিন কিছুই ছিল না, সে কিছু দিতে পারে নাই। অপুকে বিরসমুখে চলিয়া যাইতে দেখিয়া সেদিন তাহার খুব কষ্ট হইয়াছিল, তাই কাল বৈকালে সে বাবার কাছে পয়সা দুটা চড়ক দেখিবার নাম করিয়া চাহিয়া লয়। সোনার ভাটার মতো ভাইটা, মুখের আবদার না। রাখিতে পারিলে দুৰ্গার ভারি মন কেমন করে।

অপু চলিয়া গেলে তাহার মা ঘোট হইতে আসিয়া বলে—দুগগা একটা কাজ করতো! রানুদের বাগান থেকে দুটো সাদা গন্ধভেদালির পাতা খুঁজে নিয়ে আয় তো-অপুর শরীরটা অসুখ করেচে, একটু ঝোল করে দেবে!–

মায়ের কথায় সে একছুটে রানুদের বাগানে যায়-বাগানে মানুষ-সমান উঁচু ঘন আগাছার জঙ্গলের মধ্যে গন্ধভেদালির পাতা খুঁজিতে খুঁজিতে মনের সুখে মাথা দুলাইয়া পিসিমার মুখে ছেলেবেলায় শেখা একটি ছড়া আবৃত্তি করে–

হলুদ বনে বনে–

নাক-ছবিটি হারিয়ে গেছে সুখ নেইকো মনে–

ত্রয়োবিংশ পরিচ্ছেদ

যাত্রা আরম্ভ হয়। জগৎ নাই, কেহ নাই—শুধু অপু আছে, আর নীলমণি হাজরার যাত্রা দল আছে সামনে। সন্ধ্যার আগে বেহালায় ইমন আলাপ করে, ভালো বেহালদার। পাড়াগাঁয়ের ছেলে কখনও সে ভালো জিনিস শোনে নাই।–উদাস-করুণ সুরে হঠাৎ মন কেমন করিয়া উঠে, মনে হয়। বাবা এখনও বসিযা বাড়িতে সেই কী লিখিতেছে—দিদি আসিতে চাহিয়াও আসিতে পারে নাই। প্রথম যখন জরির সাজ-পোশাক পবিয়া টাঙানো ঝাড় ও কড়ির ড়ুমের আলো-সজ্জিত আসরে বাজার মন্ত্রীর দল আসিতে আরম্ভ করে, অপু মনে ভাবে এমন সব জিনিস তাহার বাবা দেখিল না! সবাই তো আসরে আসিয়াছে গ্রামের, তাহদের পাড়ার কোনও লোক তো বাকি নাই! বাবা কেন এখনও…? পালা দ্রুত অগ্রসর হইতে থাকে। সেবার সে বালক-কীর্তনের দলের যাত্রা শুনিয়াছিলসে কি, আর এ কি! কি সব সাজ! কি সব চেহারা!…

হঠাৎ পিছন হইতে কে বলে-খোকা বেশ দেখতে পোচ্ছ তো?…তাহার বাবা কখন আসিয়া আসরে বসিয়াছে অপু জানিতে পারে নাই। বাবার দিকে ফিরিয়া বলে-বাবা, দিদি এসেচে?.চিকের মধ্যে বুঝি?

মন্ত্রীব গুপ্ত ষড়যন্ত্রে যখন রাজা রাজ্যচ্যুত হইয়া স্ত্রী পুত্ৰ লইয়া বনে চলিতেছেন, তখন কঁদুনে সুরে বেহালার সংগত হয়। তারপব রাজা করুণ রস বন্ধুক্ষণ জমাইয়া রাখিবার জন্য স্ত্রীপুত্রের হাত ধরিয়া এক এক পা করিয়া থামেন, আর এক এক পা অগ্রসর হইতে থাকেন, সত্যিকার জগতে কোন বনবাস-গমনোদ্যত রাজা নিতান্ত অপ্রকৃতিস্থ না হইলে একদল লোকের সম্মুখে সেরূপ করে না। বিশ্বস্ত রাজ-সেনাপতি রাগে এমন কাপেন যে মৃগী-রোগগ্ৰস্ত রোগীর পক্ষেও। তাহা হিংসার বিষয় হইবার কথা। অপু আপলক চোখে চাহিয়া বসিয়া থাকে, মুগ্ধ বিস্মিত হইয়া যায়; এমন তো সে কখনও দেখে নাই।

তারপর কোথায় চলিয়া গিয়াছেন রাজা, কোথায় গিয়াছেন রানী!..ঘন নিবিড় বনে শুধু রাজপুত্ৰ অজয় ও রাজকুমারী ইন্দুলেখা ভাইবোন ঘুরিয়া বেড়ায়! কেউ নাই যে তাহদের মুখের দিকে চায়, কেউ নাই যে নির্জন বনে তাহদের পথ দেখাইয়া লইয়া চলে। ছোট ভাইয়ের জন্য ফল আনিতে একটু দূরে চলিয়া যাইয়া ইন্দুলেখা আর ফেরে না। অজয় বনের মধ্যে বোনকে খুঁজিয়া বেড়ায়তাহার পর নদীর ধরে হঠাৎ খুঁজিয়া পায় ইন্দুলেখার মৃতদেহ-ক্ষুধার তাড়নায় বিষফল খাইয়া সে মরিয়া গিয়াছে। অজয়ের করুণ গান-কোথা ছেড়ে গেলি। এ বনকাস্তারে প্রাণপ্রিয় প্রাণসখী রেশুনিয়া অপু এতক্ষণ মুগ্ধ চোখে চাহিয়া ছিল-আর থাকিতে পারে না, ফুলিয়া ফুলিয়া কাঁদে।

কলিঙ্গরাজের সহিত বিচিত্ৰকেতুর যুদ্ধে তলোয়ার খেলা কী!..যায়, বুঝি ঝাড়গুলা গুড়া হয়, নয় তো কোন হতভাগ্য দর্শকের চোখ দুটি বা যায়। রব ওঠে-ঝাড় সামলে-ঝাড় সামলে!..কিন্তু অদ্ভুত যুদ্ধকৌশল-সব বাঁচাইয়া চলে-ধন্য বিচিত্ৰকেতু!

মধ্যে অনেকক্ষণ ধরিয়া জুড়ির দীর্ঘ গান ও বেহালায় কসরত-এর সময় অপুকে তাহার বাবা ডাকিয়া বলে-ঘুম পাচ্ছে… বাড়ি যাবে খোকা?…সুম। সর্বনাশ!..না, সে বাড়ি যাইবে না। বাহিরে ডাকিয়া তাহার বাবা বলে-এই দুটো পয়সা রাখো বাবা, কিছু কিনে খেযো, আমি বাড়ি গেলাম। অপুর ইচ্ছা হয় সে এক পয়সার পান। কিনিয়া খাইবে, পানের দোকানের কাছে অত্যন্ত কিসের ভিড় দেখিয়া অগ্রসর হইয়া দ্যাখে, অবাক কাণ্ড! সেনাপতি বিচিত্ৰকেতু হাতিয়ারবন্দ অবস্থায বার্ডসাই কিনিয়া ধরাইতেছেন—তঁহাকে ঘিরিয়া, রথযাত্রার ভিড়। আশ্চর্যের উপর আশ্চর্য!… রাজকুমার অজয় কোথা হইতে আসিয়া বিচিত্ৰকেতুর কনুই-এ। হাত দিয়া বলিল-এক পযসার পান খাওয়াও না কিশোরীদা? রাজপুত্রের প্রতি সেনাপতির বিশ্বস্ততার নিদর্শন দেখা গেল না-হাত ঝাড়া দিয়া বলিল-যাঃ অত পয়সা নেই-ওবেলা সাবানখানা যে দুজনে মাখলে, আমাকে কি বলেছিলে? রাজপুত্র পুনবায় বলিল-খাওয়াও না কিশোরীদা? আমি বুঝি কখনও কিছু দিইনি তোমাকে? বিচিত্ৰকেতু হাত ছাড়াইয়া চলিয়া গেল।

অপুর সমবয়সি হইবে। টুকটুকে, বেশ দেখিতে, গানেব। গলা বড় সুন্দব। অপু মুগ্ধ হইযা তাহার দিকে চাহিয়া থাকে-বড় ইচ্ছা হয় আলাপ কবিতে। হঠাৎ সে কিসের টানে সাহসী হইয়া আগাইয়া যায়-একটু লজ্জার সঙ্গে বলে-পান খাবে?..অজয় একটু অবাক হয়, বলে-তুমি খাওয়াবে? নিয়ে এসো না। দুজনে ভাব হইয়া যায়। ভোব বলিলে ভুল হয়। অপু মুগ্ধ, অভিভূত হইয়া যায়! ইহাকেই সে এতদিন মনে মনে চাহিয়া আসিয়াছে-এই রাজপুত্ৰ অজযকে। তাহার মাযের শত রূপকথার কাহিনীর মধ্য দিয়া, শৈশবের শত স্বপ্নময়ী মুগ্ধ কল্পনার ঘোরে তাহার প্রাণ ইহাকেই চাহিয়াছে-এই চোখ, এই মুখ, এই গলার স্বর! ঠিক সে যাহা চায় তাহাই। অজয় জিজ্ঞাসা করে– তোমাদের বাড়ি কোথায় ভাই? …আমাকে একজনের বাড়ি খেতে দিয়েছে, বড্ড বেলায় খেতে দেয়। তোমাদের বাড়িতে খায় কে?…

খুশিতে অপুর সারা গা কেমন করে, সে বলে–“ভাই, আমাদের বাড়িতে একজন খেতে যায়, সে আজ দেখলাম ঢোলক বাজাচে-তুমি কাল থেকে যেয়ো, আমি এসে ডেকে নিয়ে যাবো।– ঢোলকওয়ালা না হয় তুমি যে বাড়িতে আগে খেতে, সেখানে খাবে–

খানিকক্ষণ দুজনে এদিক-ওদিক বেড়াইবার পর অজয় বলে-আমি যাই ভাই, শেষ সিনে আমার গান আছে-আমার পার্ট কেমন লাগচে তোমার?

শেষ বাত্রে যাত্রা ভাঙিলে অপু বাড়ি আসে। পথে আসিতে আসিতে যে যেখানে কথা বলে, তাহার মনে হয় যাত্রাব এক্‌টো হইতেছে। বাড়িতে তাহার দিদি বলে-ও অপু, কেমন যাত্রা শূনলি?.অপুর মনে হয়, গভীর জনশূন্য বনের মধ্যে রাজকুমারী ইন্দুলেখা কি বলিয়া উঠিল। কিসের যে ঘোর তাহাকে পাইয়া বসিয়াছে। মহা খুশির সহিত সে বলে-কাল থেকে, অজয় যে মেজেছিল মা, সে আমাদের বাড়ি খেতে আসবে।–

তাহার মা বলে-দুজনে খাবে?-দুজনকে কোত্থেকে—

175 Shares