পথের পাঁচালী

যাইবার সময় সে হঠাৎ পুঁটুলি খুলিয়া কষ্টে সঞ্চিত পাঁচটি টাকা বাহির করিয়া সর্বজয়ার হাতে দিতে গেল। একটু লজ্জার সুরে বলিল-এই পাঁচটা টাকা দিয়ে দিদির বিয়ের সময় একখানা ভালো কাপড়–

সর্বজয়া বলিল—না বাবা, না।–তুমি মুখে বললে এই খুব হল, টাকা দিতে হবে না, তোমার এখন টাকার কত দরকার-বিয়ে-থাওয়া করে সংসারী হতে হবে–

তবু সে কিছুতেই ছাড়ে না। অনেক বুঝাইয়া। তবে তাহাকে নিরস্ত করিতে হইল।

তাহার পর সকলে উহাদের বাড়ির দরজার সামনে খানিকটা পথ পর্যন্ত তাহাকে আগাইয়া দিতে আসিল। যাইবার সময় সে বার বার বলিয়া গেল, দিদির বিয়ের সময় অবশ্য করিয়া যেন তাহাকে পত্র দেওয়া হয়।

গাবতলার ছায়ায় ছায়ায় তাহার সুকুমার বালকমূর্তি ভািটশ্যাওড়া ঝোপের আড়ালে অদৃশ্য হইয়া গেলে হঠাৎ সর্বজয়ার মনে হইল, বড় ছেলেমানুষ আহা, এই বয়সে বেরিয়েছে নিজের রোজগার নিজে কর্তে। অপুর আমার যদি ওইরকম হাত-মাগো!…

চতুর্বিংশ পরিচ্ছেদ

প্রথম প্রথম যখন হরিহর কাশী হইতে আসিল তখন সকলে বলিত তাহার ভবিষ্যৎ বড় উজ্জ্বল, এ অঞ্চলে ওরকম বিদ্যা শিখিয়া কেহ আসে নাই। তাহার বিদ্যার সুখ্যাতি সকলের মুখে ছিল, সকলে বলিত সে এইবার একটা কিছু করিবে। সর্বজয়াও ভাবিত, শীঘ্রই উহারা তাহার স্বামীকে ডাকাইয়া একটা ভালো চাকুরি দিবে (কাহারা চাকুরি দেয় সে সম্বন্ধে তাহার ধারণা ছিল কুয়াশাচ্ছন্ন সমুদ্রবক্ষের মতো অস্পষ্ট)। কিন্তু মাসের পর মাস, বৎসরের পর বৎসর করিয়া বহুকাল চলিয়া গেল, অর্ধারাত্রির মাথায় কোনো জরির পোশাকপরা ঘোড়সওয়ার সভাপণ্ডিত পদের নিয়োগ-পত্ৰ লইয়া দুটিয়া আসিল না, বা আরব্য উপন্যাসের দৈত্য কোন মণি-খচিত মায়াপ্রাসাদ আকাশ বাহিয়া উড়াইয়া আনিয়া তাহাদের ভাঙা ঘরে বসাইয়া দিয়া গেল না, বরং সে ঘরের পোকা-কাটা কবাট দিন দিন আরও জীর্ণ হইতে চলিল, কড়িকাঠ। আরও বুলিয়া পড়িতে চাহিল, আগে যাও বা ছিল তাও আর সব থাকিতেছে না, তবু সে একেবারে আশা ছাড়ে নাই। হরিহরও বিদেশ হইতে আসিয়া প্রতিবারই একটা না একটা আশার কথা এমনভাবে বলে, যেন সব ঠিক, অল্পমাত্র বিলম্ব আছে, অবস্থা ফিরিল বলিয়া। কিন্তু হয়।

জীবন বড় মধুময় শুধু এইজন্য যে, এই মাধুর্যের অনেকটাই স্বপ্ন ও কল্পনা দিয়া গড়া। হোক না। স্বপ্ন মিথ্যা, কল্পনা বাস্তবতার লেশশূন্য; নাই বা থাকিল সব সময় তাহদের পিছনে সার্থকতা; তাহারাই যে জীবনের শ্রেষ্ঠ সম্পদ, তাহারা আসুক, জীবনে অক্ষয় হোক তাহাদের আসন; তুচ্ছ সার্থকতা, তুচ্ছ লাভ।

হরিহর বাড়ি হইতে গিয়াছে প্রায় দুই-তিন মাস। টাকাকড়ি খরচপত্র অনেকদিন পাঠায় নাই। দুৰ্গা অসুখে ভুগিতেছে একটু বেশি, খায় দায় অসুখ হয়, দুদিন একটু ভালো থাকে, হঠাৎ একদিন আবার হয়।

সর্বজয়া মেয়ের বিবাহের জন্য স্বামীকে প্রায়ই তাগাদ দেয়। স্বামীকে দিয়া দুই-তিনখানা পত্র নীরেন্দ্রর পিতা রাজ্যেশ্বরবাবুর নিকট লিখিয়াছে। সেদিকের আশাও সে এখনও ছাড়ে নাই। হরিহর বলে, তুমি কি খেপিলে নাকি? ওসকল বড়লোকের কাণ্ড, রাজ্যেশ্বর কাকা কি আব আমাদের পুছবেন? তবুও সর্বজয়া ছাড়ে না; বলে, লেখো না। আর একখানা, লিখেই দ্যাখো না-নীরেন তো পছন্দই করে গিয়েছেন। দুই এক মাস চলিয়া যায়, বিশেষ কোন উত্তর আসে না, আবোব সে স্বামীকে পত্র লিখিবার তাগাদা দিতে শুরু করে।

এখার হরিহর যখন বিদেশে যায়, তখন বলিয়া গিয়াছে এইবার সে এখান হইতে উঠিয়া অন্যত্র বাস করিবার একটা কিছু ঠিক করিয়া আসিবেই।

পাড়ার একপাশে নিকনো পুছানো ছোট্ট খড়ের ঘর দু’তিনখানা। গোয়ালে হৃষ্টপুষ্ট দুগ্ধবতী গাভী বঁধা, মাচা ভরা বিচালি, গোলা ভরা ধান। মাঠের ধারের মটর ক্ষেতের তাজা, সবুজ গন্ধ খোলা হাওয়ায় উঠান দিয়া বহিয়া যায়। পাখি ডাকে-নীলকণ্ঠ, বাবুই, শ্যামা। অপু সকালে উঠিয়া বড় মাটির ভাঁড়ে ধোয়া এক পাত্র তাজা সফোন কালো গাই-এর দুধের সঙ্গে গরম মুড়ির ফলার খাইয়া পড়িতে বসে। দুৰ্গা ম্যালেরিয়ায় ভোগে না। সকলেই জানে, সকলেই খাতির করে, আসিয়া পায়ের ধূলা লয়। গরিব বলিয়া কেহ তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে না।

…শুধুই স্বপ্ন দেখে, দিন নাই, রাত নাই, সর্বজয়া শুধুই স্বপ্ন দেখে। তাহার মনে হয়, এতকাল পরে সত্য-সত্যই একটা কিছু লাগিয়া যাইবে। মনের মধ্যে কে যেন বলে।

কেন এতদিন হয় নাই? কেন এতকাল পরে? সেই ছেলেবেলাকার দিনে জামতলায় সজনেতলায় ঘুরিবার সময় হইতে সেঁজুতির আলপনা আঁকা মন্ত্রের সঙ্গে এ সাধ যে তাহার মনে জড়াইয়া আছে, লক্ষ্মীর আলতাপরা পায়ের দাগ আঁকা আঙিনায় শ্বশুরবাড়ির ঘর-সংসার পাতাইবে। এরকম ভাঙা পুরানো কোঠা বাঁশবন কে চাহিয়াছিল?

দুৰ্গা একটা ছোট্ট মানকচু কোথা হইতে জোগাড় করিয়া আনিয়া রান্নাঘরে ধরনা দিয়া বসিয়া থাকে। তাহার মা বলে, তোর হোল কি দুগগা? আজ কি বলে ভাত খাবি? কাল সন্ধেবেলাও তো জ্বর এসেচে?

দুৰ্গা বলে, তা হোক মা, সে জ্বর বুঝি-একটু তো মোট শীত করলো?…তুমি এই মানকচুটা ভাতে দিয়ে দুটো ভাত-।

তাহার মা বলে-যাঃ, অসুখ হয়ে তোর খাই খাই বড় বেড়েছে। আজ কাল ভালো যদি থাকিস তো পরশু বরং দেবো–

অনেক কাকুতিমিনতির পর না পারিয়া শেষে দুর্গা মানকচু তুলিয়া রাখিয়া দেয়। খানিকটা চুপ করিয়া বসিয়া থাকে, আপন মনে বলে, আজ খুব ভালো আছি, আজ আর জ্বর আসবে না। আমারওবেলা দুখানা বুটি আর আলুভাজ খাবো। একটু পরে হাই ওঠে, সে জানে ইহা জ্বর আসার পুর্বলক্ষণ। তবুও সে মনকে বোঝায়, হাই উঠুক, এমনি তো কত হাই ওঠে, জ্বর আর হবে না। ক্ৰমে শীত করে, রৌদ্রে গিয়া বসিতে ইচ্ছা হয়। সে রৌদ্রে না গিয়া মনকে প্ৰবোধ দেয় যে, শীত বোধ হওয়া একটা স্বাভাবিক শারীরিক ব্যাপার, জ্বর আসার সহিত ইহার সম্পর্ক কি?

কিন্তু কোনো প্ৰবোধ খাটে না। রৌদ্র না পড়িতে পড়িতে জ্বর আসে, সে লুকাইয়া গিয়া রৌদ্রে বসে, পাছে মা টের পায়। তাহার মন তুহু করে, ভাবে-জুর জ্বর ভেবে এরকম হচ্ছে, সত্যি সত্যি জ্বর হয়নি

রাঙা রোদ শ্যাওলাধরা ভাঙা পাচিলের গায়ে গিয়া পড়ে। বৈকালের ছায়া ঘন হয়। দুর্গার মনে হয় অন্যমনস্ক হইয়া থাকিলে জ্বর চলিয়া যাইবে। অপুকে বলে, বোস দিকি একটু আমার কাছে, আয় গল্প করি।

একদিন আর-বছর ঘন বর্ষার রাতে সে ও অপু মতলব আঁটিয়া শেষরাত্রে পিছনে সেজ ঠাকবুনদের বাগানে তাল কুড়াইতে গিয়াছিল, হঠাৎ দুর্গার পয়ে পটু করিয়া এক কাঁটা ফুটিয়া গেল। যন্ত্রণায় পিছু হটিয়া বাঁ পা-খানা যেখানে রাখিল, সেখানে বাঁ পায়েও পট্‌ করিয়া আর একটা।… সকাল বেলা দেখা গেল, পাছে রাত্রে উহারা কেহ তাল কুড়াইয়া লয়, এজন্য সতু তালতলার পথে সোজা করিয়া সারি সারি বেল-কাঁটা পুতিয়া রাখিয়াছে।

আর একদিন যা আশ্চর্য ব্যাপার!—

কোথা হইতে সেদিন এক বুড়া বাঙাল মুসলমান একটা বড় রং-চং করা কাঁচবসানো টিনের বাক্স লইয়া খেলা দেখাইতে আসে। ও-পাড়ায় জীবন চৌধুরীর উঠানে সে খেলা দেখাইতেছিল। দুর্গা পাশেই দাঁড়াইয়াছিল। তাহার পয়সা ছিল না। আর সকলে এক এক পয়সা দিয়া বাক্সের গায়ে একটা চেঙের মধ্য দিয়া কি সব, দেখিতেছিল।

বুড়া মুসলমানটি বাক্স বাজাইয়া সুর করিয়া বলিতেছিল, তাজ বিবিকা রোজা দেখো, হাতি বাঘকা লড়াই দেখো! এক-একজনের দেখা শেষ হইলে যেমন সে চোঙ হইতে চোখ সরাইয়া লইতেছিল অমনি দুৰ্গা তাহাকে মহা আগ্রহের সহিত জিজ্ঞাসা করিতেছিল, কি দেখলি রে ওর মধ্যে? সব সত্যিকারের?

উঃ! সে কি অপূর্ব ব্যাপার দেখিয়াছে তাহা তাহারা বলিতে পারে না।…কি সে সব।

সকলের দেখা একে একে হইয়া গেল। দুর্গা চলিয়া যাইতেছিল, বুড়া মুসলমানটি বলিল, দেখবে না খুকি?…

দুৰ্গা ঘাড় নাড়িয়া বলিল, নাঃ-ই-আমার কাছে পয়সা নাই।

লোকটি বলিল, এসো এসো খুকি, দেখে যাও-পয়সা লাগবে না—

দুৰ্গার একটু লজ্জা হইয়াছিল, মুখে বলিল,–নাঃ-কিন্তু আগ্রহে কৌতুহলে তাহার বুকের মধ্যে টিপ, টিপ করিয়া উঠিল।

লোকটি বলিল, এসো এসো, দোষ কি?…এসো, দ্যাখো—

দুৰ্গা উজ্জ্বলমুখে পায়ে পায়ে বাক্সের কাছে আসিয়া দাঁড়াইল বটে, তবুও সাহস করিয়া মুখটা চোঙের মধ্যে দিতে পারে নাই। লোকটি বলিল, এই নলটার মধ্যে দিয়া তাকাও দিকি খুকি?

দুৰ্গা মাথার উড়ন্ত চুলের গোছা কানের পাশে সরাইয়া দিয়া চাহিয়া দেখিল। পরের দশ মিনিটের কথার সে কোনো বর্ণনা করিতে পারে না। সত্যকারের মানুষ ছবিতে কি করিয়া দেখা যায়? কত সাহেব, মেম, ঘরবাড়ি, যুদ্ধ, সে সব কথা সে বলিতে পারে না! কি জিনিসই। সে দেখিয়াছিল!

অপুকে দেখাইতে বড় ইচ্ছা করে, দুৰ্গা কতবার খুঁজিয়াছে, ও খেলা আর কোনও দিন আসে নাই।

175 Shares