পথের পাঁচালী

গল্প ভালো করিয়া শেষ হইতে না হইতে দুৰ্গা জুরের ধমকে আর বসিতে পারে না, উঠিয়া ঘরের মধ্যে কাঁথা মুড়ি দিয়া শোয়,

আজকাল বাবা বাড়ি নাই, অপুকে আর খুঁজিয়া মেলা দায়। বই দপ্তরে ঘুণ ধরিবার জোগাড়গ হইয়াছে। সকাল বেলা সেই যে এক পুঁটুলি কড়ি লইয়া বাহির হয়, আর ফেরে একেবারে দুপুর ঘুরিয়া গেলে খাইবার সময়। তাহার মা বকে-ছেলের না নিকুচি করেচে-তোমার লেখাপড়া একেবারে ছিকেয় উঠলো? এবার বাড়ি এলে সব কথা বলে দেবো, দেখো এখন তুমি–

অপু ভয়ে ভয়ে দপ্তর লইয়া বসে। বইগুলো খুব চারিদিকে ছড়ায়। মাকে বলে, একটু খয়ের দাও মা, আমি দোয়াতের কালিতে দেবো।–

পরে সে বসিয়া বসিয়া হাতের লেখা লিখিয়া রৌদ্রে দেয়। শুকাইয়া গেলে খয়ের-ভিজানো কালি চক চক করে–অপু মহাখুশির সহিত সেদিকে, চাহিয়া থাকে-ভাবে-আর একটু খয়ের দেবো কাল থেকে-ওঃ কী চক চক করচে দেখো একবার! পানের বাটা হইতে মাকে লুকাইয়া বড় একখণ্ড খয়ের লইয়া কালির দোয়াতে দেয়। পরে লেখা লিখিয়া শুখাইতে দিয়া কতটা আজ জ্বলজ্বল করে দেখিবার জন্য কৌতুহলের সহিত সেদিকে চাহিয়া থাকে। মনে হয়-আচ্ছা যদি আর একটু দি?

একদিন মার কাছে ধরা পড়িয়া যায়। মা বলে, ছেলের লেখার সঙ্গে খোঁজ নেই। কেবল ড্যালা ড্যালা খয়ের রোজ দরকার।–রেখে দে খায়ের–

ধরা পড়িয়া একটু অপ্রতিভ হইয়া বলে, খয়ের নৈলে কালি হয় বুঝি?…আমি বুঝি এমনি এমনি–

–না খয়ের নৈলে কালি হবে কেন? এইসব রাজ্যির ছেলে আর লেখাপড়া কচ্চে না– তাদের সেরা সোর খয়ের রোজ জোগানো রয়েছে যে দোকানো! যাঃ–

অপু বসিয়া বসিয়া একখানা খাতায় নাটক লেখে। বহু লিখিয়া খাতাখানা সে প্রায় ভরাইয়া ফেলিয়াছে, মন্ত্রীর বিশ্বাসঘাতকতায় রাজা রাজ্য ছাড়িয়া বনে যান, রাজপুত্র নীলাম্বর ও রাজকুমারী অম্বা বনের মধ্যে দসুর হাতে পড়েন, ঘোর যুদ্ধ হয়, পরে রাজকুমারীর মৃতদেহ নদীতীরে দেখা যায়। নাটকে সতু বলিয়া একটি জটিল চরিত্র সৃষ্ট হইবার অল্পপরেই বিশেষ কোনো মারাত্মক দোষের বর্ণনা না থাকা সত্ত্বেও সে প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত হয়। নাটকের শেষদিকে রাজপুত্রী অম্বার নারদের বরে পুনজীবন প্রাপ্তি বা বিশ্বস্ত সেনাপতি জীবনকেতুর সহিত তাঁহার বিবাহ প্রভৃতি ঘটনায় যাহারা বলেন যে, গত বৈশাখ মাসে দেখা যাত্রার পালা হইতে এক নামগুলি ছাড়া মূলত কোন অংশই পৃথক নহে, বা সেই হইতেই ইহা হুবহু লওয়া, তাহারা ভুলিয়া যান যে, অতীতের কোনো এক নীরব জ্যোৎস্নময়ী রাত্রিতে নির্জন বাসকক্ষের স্তিমিত দীপশয্যায় এক প্রাচীন কবির নীলমেঘের মতো দৃশ্যমান ময়ুর-নিনাদিত দূর বনভূমির স্বপ্ন যদি কালিদাসকে মুক্ত মেঘের ভ্রমণ বর্ণনে অনুপ্রাণিত করিয়া থাকে, তাহা হইলেই বা কি?…সে বিস্মৃতি শুভ-যামিনীর বন্দনা মানুষে নিজের অজ্ঞাতসারে হাজার বৎসর ধরিয়া করিয়া আসিতেছে।

আগুন দিয়াই আগুন জ্বালানো যায়, ছাই-এর টিপিতে মশাল গুজিয়া কে কোথায় মশাল জুলে?…

দপ্তরে একখানা বই আছে-বইখানার নাম চরিতমালা, লেখা আছে ঈশ্বরচন্দ্ৰ বিদ্যাসাগর প্রণীত। পুরানো বই, তাহার বাবার নানা জায়গা হইতে ছেলের জন্য বইসংগ্ৰহ করিবার বাতিক আছে, কোথা হইতে একখানা আনিয়াছিল, অপু মাঝে মাঝে খানিকটা পড়িয়া থাকে। বইখানিতে যাঁহাদের গল্প আছে সে ওই রকম হইতে চায়। হাটে আলু বেচিতে পাঠাইলে কৃষকপুত্র রস্কো বেড়ার ধারে বসিয়া বীজগণিতের চর্চা করিত, কাগজের অভাবে চামড়ার পাতে ভোঁতা আল দিয়া অক্ষাকষিত, মেষপালক ড়ুবাল ইতস্তত সঞ্চরণশীল মেঘদলকে যাদৃচ্ছি। বিচরণের সুযোগ দিয়া একমনে গাছতলায় বসিয়া ভুচিত্র পাঠে মগ্ন থাকিত-সে। ওই রকম হইতে চায়।. বীজগণিত’ কি জিনিস? সে বীজগণিত পড়িতে চায় রস্কোর মতো। সে এই হাতের লেখা লিখিতে চায় না, ধারাপাত কি শুভঙ্করী এসব তাহার ভালো লাগে না। ওইরকম নির্জন গাছতলায়, বনের ছায়ায়, কি বেড়ার ধারে বসিয়া বসিয়া সে “ভুচিত্র’ (জিনিসটা কি?) পাতিয়া পড়িবে, বড় বড় বই পড়িবে, পণ্ডিত হইবে ওই রকম। কিন্তু কোথায় পাইবে সে সব জিনিস? কোথায় বা ‘ভূচিত্র’, কোথায় বা ‘বীজগণিত’, কোথায়ই বা ল্যাটিন ব্যাকরণ?—এখানে শুধুই কড়ি কষার আর্য, আর তৃতীয় নামতা।

মা বকিলে কি হইবে, যাহা সে পড়িতে চায়, তাহা এখানে কই?

পঞ্চবিংশ পরিচ্ছেদ

কয়দিন খুব বর্ষা চলিতেছে। অন্নদা রায়ের চণ্ডীমণ্ডপে সন্ধ্যাবেলায় মজলিশ বসে। সেদিন সেখানে নীলকুঠির ভূয়ো গল্প হইতে শুরু হইয়া পুরীর কোন মন্দিরের মাথায় পাঁচমন ভারী চুম্বক পাথর বসানো আছে, যাহার আকর্ষণের বলে নিকটবতী সমুদ্রগামী জাহাজ প্রায়ই পথভ্ৰষ্ট হইয়া আসিয়া তীরবতী মগ্ন শৈলে লাগিয়া ভাঙিয়া যায় প্রভৃতি-আরব্য উপন্যাসের গল্পের মতো নানা আজগুবি কাহিনীর বর্ণনা চলিতেছিল। শ্রোতাদের কাহারও উঠিবার ইচ্ছা ছিল না, এরকম আজগুবি গল্প ছাড়িয়া কাহারও বাড়ি যাইতে মন সরিতেছিল না। ভূগোল হইতে শীঘ্রই গল্পের ধারা আসিয়া জ্যোতিষে পৌঁছিল। দীনু চৌধুরী বলিতেছিলেন-ভৃগু-সংহিতার মতো আমন বই তো আর নেই! তুমি যাও, শুধু জন্মরাশিটা গিয়ে দিয়ে দাও, তোমার বাবার নাম, কোন কুলে জন্ম, ভূত ভবিষ্যৎ সব বলে দেবে-তুমি মিলিয়ে নাও—গ্রহ ও রাশিচক্রের যত রকম ইয়ে হয়-তা সব দেওয়া আছে কি না? মায় তোমার পূর্বজন্ম পর্যন্ত–

সকলে সাগ্রহে শুনিতেছিলেন, কিন্তু রামময় হঠাৎ বাহিরের দিকে চাহিয়া বলিলেন-না, ওঠা যাক, এর পর যাওয়া যাবে না-দেখচো না-দেখচো না কাণ্ডখানা? একটা বড় ঝটুক-টাট্‌কা না হলে বঁচি, গতিক বড় খারাপ, চলো সব—

বৃষ্টির বিরাম নাই। একটু থামে, আবাব আমনি জোরে আসে, বৃষ্টির ছাটে চারিধার ধোঁয়া ধোঁয়া।

হরিহর মোট পাঁচটা টাকা পাঠাইয়াছিল, তাহার পর আর পত্ৰও নাই, টাকাও নাই। সেও অনেক দিন হইয়া গোল-রোজ সকালে উঠিয়া সর্বজয়া ভাবে আজ ঠিক খরচ আসিবে। ছেলেকে বলে, তুই খেলে খেলে বেড়াস বলে দেখতে পাসনে, ডাক-বাক্সটার কাছে বসে থাকবি-পিওন যেমন আসবে। আর অমনি জিজ্ঞেস করবি–

অপু বলে-বা, আমি বুঝি বসে থাকি নে? কালও তো এলো পুটিদের চিঠি, আমাদের খবরের কাগজ দিয়ে গেল-জিজ্ঞেস করে এসো দিকি পুটকে? কাল তবে আমাদের খবরের কাগজ কি করে এলো? আমি থাকিনে বই কি?

বর্ষা রীতিমতো নামিয়াছে। অপু মায়ের কথায় ঠোয় রায়েদের চণ্ডীমণ্ডপে পিওনের প্রত্যাশায় বসিয়া থাকে। সাধু কর্মকারের ঘরে চালা হইতে গোলা পায়রার দল ভিজিতে ভিজিতে ঝটাপট করিয়া উড়িতে উড়িতে রায়েদের পশ্চিমের ঘরের কার্নিসে আসিতেছে, চাহিয়া চাহিয়া দ্যাখে। আকাশের ডাককে সে বড় ভয় করে। বিদ্যুৎ চমকাইলে মনে মনে ভাবে-দেবতা কিরকম নলপাচ্চে দেখেচোঁ, এইবার ঠিক ডাকবে-পরে সে চোখ বুজিয়া কানে আঙুল দিয়া থাকে।

বাড়ি ফিরিয়া দ্যাখে মা ও দিদি সারা বিকাল ভিজিতে ভিজিতে রাশীকৃত কচুর শাক তুলিয়া রান্নাঘরের দাওয়ায় জড়ো করিয়াছে।

অপু বলে-কোথেকে আনলে মা? উঃ কত!

দুর্গা হাসিয়া বলে-কত- উ-উঃ! তোমার তো বসে বসে বড় সুবিধে1.ওই ওদের ডোবার জামতলা থেকে-এই এতটা এক হ্যাঁটু জল। যাও দিকি?…

সকালে ঘাটে গিয়া নাপিত-বৌয়ের সঙ্গে দেখা হয়। সর্বজয়া কাপড়ের ভিতর হইতে কাসার একখানা রেকবি বাহির করিয়া বলে, এই দ্যাখো জিনিসখানা, খুব ভালো-ভরণ না, কিছু না, ফুল কাঁসা। তুমি বলেছিলে, তাই বলি যাই নিয়ে-এ সে জিনিস নয়, এ আমার বিয়ের দান—এখন এ জিনিস আর মেলে না

অনেক দরদস্তুরের পর নাপিত-বৌ নগদ একটি আধুলি আঁচল হইতে খুলিয়া দিয়া রেকর্মবিখানা কাপড়ের মধ্যে লুকাইয়া লয়। কাউকে যেন না প্রকাশ করে–সর্বজয়া এ অনুরোধ বার বার করে।

দুই একদিনে ঘনীভূত বৰ্ষা নামিল। তুহু পুবে হাওয়া, খানাডোবা সব থই থই করিতেছেপথে ঘাটে একহ্যাঁটু জল, দিনরাত সো সো, বাশবনে ঝড় বাধে-বাঁশের মাথা মাটিতে লুটাইয়া লুটাইয়া পড়ে-আকাশের কোথাও ফাক নাই-মাঝে মাঝে আগেকার চেয়ে অন্ধকার করিয়া আসে-কালো কালো মেঘের রাশ হু-হু, উড়িয়া পুব হইতে পশ্চিমে চলিয়াছে-দূর আকাশের কোথায় যেন দেবাসুরের মহাসংগ্রাম বাধিয়াছে, কোন কৌশলী সেনানায়কের চালনায় জলস্থলআকাশ একাকারে ছাইয়া ফেলিয়া বিরাট দৈত্যসৈন্য, বাহিনীর পর বাহিনী, অক্ষৌহিণীৰ পর অক্ষৌহিণী, অদৃশ্য রথী-মহারথীদের নায়কত্বে ঝড়ের বেগে অগ্রসর হইতেছে-প্ৰজ্বলন্ত অত্যুগ্র দেববাজ আগুন উড়াইয়া চক্ষের নিমেষে বিশাল কৃষ্ণচমূর এদিক-ওদিক পর্যন্ত ছিঁড়িয়া ফাঁড়িযা এই ছিন্ন ভিন্ন করিয়া দিতেছে-এই আবার কোথা হইতে রক্তবীজের বংশ করাল কৃষ্ণছায়ায় পৃথিবী অন্তরীক্ষা অন্ধকার করিয়া ঘিরিয়া আসিতেছে।

175 Shares