পথের পাঁচালী

মহাঝড়!

দিন রাত সোঁ-সোঁ শব্দ-নদীর জল বাড়ে-কত ঘরদোর কত জায়গায় যে পড়িয়া গেল!…নদী নালা জলে ভাসিয়া গিয়াছে-গরু-বাছুর গাছের তলে, বাশবনে, বাড়ির ছাঁচতলায় অঝোরে দাঁড়াইয়া ভিজিতেছে, পাখি-পাখালির শব্দ নাই কোনোদিকে! চাব পাঁচ দিন সমান ভাবে কাটিল–কেবল ঝড়ের শব্দ আর অবিশ্রাস্ত ধারাবর্ষণ!-অপু দাওয়ায় উঠিয়া তাড়াতাড়ি ভিজা মাথা মুছিতে মুছিতে বলিল-আমাদের বাঁশতলায় জল এসেচে দিদি, দেখবি?

দুৰ্গা কাঁথা মুড়ি দিয়া শুইয়াছিল–না উঠিয়াই বলিল-কতখানি জল এসেচে রে?…

অপু বলে, তোর জ্বর সারলে কাল দেখে আসিস। … তেঁতুলতলার পথে হাঁটু জল! পরে জিজ্ঞাসা করে-মা কোথায় রে?

ঘরে একটা দানা নেই।–দুটোখানি বাসি চালভাজা মাত্র আছে। অপু কান্নাকাটি করে,—তা হবে না। মা, আমার খিদে পায় না বুঝি—আমি দুটি ভাত খাবো।–হুঁ-উ-

তার মা বলিল, লক্ষ্মী মানিক আমাব-ও রকম কি করে। অনেক করে চালভাজা মেখে দেবো। এখন-রাধবো কেমন করে; দেখচিস নে কি রকম সেওটা করেচে?-উনুনের মধ্যে এক উনুন জল যে? পরে সে কাপড়ের ভিতর হইতে একটা কি বাহির করিয়া হাসিমুখে দেখাইয়া বলে-এই দ্যাখ একটা কইমাছ বাঁশতলায় কানে হেঁটে দেখি বেড়াচ্চে—বন্যের জল পেয়ে সব উঠে আসছে গাঙ থেকে-বরোজ পোতার ডোবা ভেসে নদীর সঙ্গে এক হয়ে গিয়েচে কিনা?…তাই সব উঠে আসচে—

দুৰ্গা কাঁথা ফেলিয়া ওঠে-অবাক হইয়া যায়। বলে, দেখি মা মাছটা? হ্যাঁ মা, কইমাছ বুঝি কানে হেঁটে বেড়ায়? আর আছে?…

অপু এখনই বৃষ্টিমাথায় ছুটিয়া যায় আর কি-অনেক কষ্ট তাহার মা তাহাকে থামায়।

দুর্গা বলে–একটু জ্বর সারলে কাল সকালে চল অপু, তুই আর আমি বাঁশবাগান থেকে মাছ নিয়ে আসবো এখন। পরে সে অবাক হইয়া ভাবে-বাঁশাবাগানে মাছ! কী করে এল? বাঃ তো!– মা কি আর ডালো করে খুঁজেচে। খুঁজলে আরও সেখানে আছে-দেখতে পেলাম না কি রকম কইমাছ কানো হ্যাঁটে-কাল সকালে দেখবো-সকালে জ্বর সেরে যাবে–

চারিদিকে বন-বাগান ঘিরিয়া সন্ধ্যা নামে। সন্ধ্যার মেঘে ত্ৰয়োদশীর অন্ধকারে চারিধার একাকার। দুর্গা যে বিছানা পাতিয়া শুইয়া আছে, তাহারই এক পাশে তাহার মা ও অপু বসে। সর্বজয়া ভাবে-আজ যদি এখখুনি একখানা পত্তর আসে নীরেন বাবাজীর? কি জানি, তা হতে কি আর পারে না? নীরেন তো পছন্দই করে গিয়েচেন-কি জানি কি হল আদেষ্টে! নাঃ, সে সব কি আর আমার আদেষ্টে হবে? তুমিও যেমন! তা হলে আর ভাবনা ছিল কি?

ওদিকে ভাইবোনে তুমুল তর্ক বাধিয়া যায়। অপু সরিয়া মায়ের কাছে ঘেঁষিয়া বসে-ঠাণ্ডা হাওয়ায় বেজায় শীত করে। হাসিয়া বলে—মা-কি? সেই–শ্যামলঙ্কা বাটুনা বাটে মাটিতে লুটায় কেশ?…

দুৰ্গা বলে-ততক্ষণে মা আমার ছেড়ে গিয়েচেন দেশ—

অপু বলে-দূর-হ্যাঁ মা তাই? ততক্ষণে মা আমার ছেড়ে গিয়েচেন দেশ?-কথা বলিয়াই সে দিদির অজ্ঞতায় হাসে।

সর্বজয়ার বুকে ছেলের অবোধ উল্লাসের হাসি শেলের মতো বেঁধে। মনে মনে ভাবে-সাতটা নয় পাঁচটা নয়-এই তো একটা ছেলে–কি আদেষ্ট যে করে এসেছিলাম–তার মুখের আবদার রাখতে পারিনে-ঘি না, লুচি না, সন্দেশ না-কি না শুধু দুটো ভাত-নিনকি?!…আবার ভাবেএই ভাঙা ঘর, টানাটানির সংসার।–অপু মানুষ হলে আর এ দুঃখ থাকবে না।–ভগবান তাকে মানুষ করে তোলেন যেন।…

তাহার পর সে বসিয়া বসিয়া গল্প করে, যখন প্রথম সে নিশ্চিন্দিপুরে ঘর করিতে আসিয়াছিল, তখন এক বৎসর এই রকম অবিশ্রান্ত বর্ষায় নদীর জল এত বাড়িয়াছিল যে ঘাটের পথে মুখুজ্যেবাগানের কাছে বড় বোঝাই নৌকা পর্যন্ত আসিয়াছিল।

অপু বলে-কত বড় নৌকো মা?

—মস্ত-ওই যে খোট্টাদের চুনের নৌকো, সাজিমাটির নৌকো, মাঝে মাঝে আসে দেখিচিস তো—অত বড়–

দুৰ্গা হঠাৎ জিজ্ঞাসা করে-মা তুমি চারগুছির বিনুনি করতে জানো?

অনেক রাত্রে সর্বজয়ার ঘুম ভাঙিয়া যায়–অপু ডাকিতেছে-মা, ওমা ওঠে- আমার গায়ে জল পড়াচে–

সর্বজয়া উঠিয়া আলো জ্বলে-বাহিরে ভয়ানক বৃষ্টির শব্দ হইতেছে। ফুটা ছাদ দিয়া ঘরের সর্বত্র জল পড়িতেছে। সে বিছানা সরাইয়া পাতিয়া দেয়। দুৰ্গা অঘোর জুরে শুইয়া আছে—তাহার মা গায়ে হাত দিযা দ্যাখে তাহার গায়ের কাঁথা ভিজিয়া সাপ সাপ করিতেছে। ডাকিয়া বলে-দুর্গও দুর্গা শুনছিস?…একটু ওঠু দিকি? বিছানাটা সরিয়ে নি—ও দুর্গ-শিগগির, একেবারে ভিজে গোল যে সব?…

ছেলেমেয়ে ঘুমাইয়া পড়িলেও সর্বজয়ার ঘুম আসে না। অন্ধকার রাত-এই ঘন বর্ষা…তাহার মন ছমছম করে-ভয় হয় একটা যেন কিছু ঘটিবে.কিছু ঘটিবে। বুকের মধ্যে কেমন যেন করে। ভাবে- সে মানুষেরই বা কি হল? কোন পত্তিরও আসে না’—টাকা মরুকগে যাক। এরকম তো কোনোবার হয় না?…তার শরীরটা ভালো আছে তো? মা সিদ্ধেশ্বরী, স-পাঁচ আনার ভোগ দেবো, ভালো খবর এনে দাও মা–

তার পরদিন সকালের দিকে সামান্য একটু বৃষ্টি থামিল। সবজয়া বাটীর বাহির হইয়া দেখিল বাশবনের মধ্যে ছোট ডোবাটা জলে ভর্তি হইয়া গিয়াছে। ঘাটের পথে নিবারণের মা ভিজিতে ভিজিতে কোথায় যাইতেছিল, সর্বজয়া ডাকিয়া বলিল-ও নিবারণের মা শোনা—পরে সলজভাবে বলিল-সেই তুই একবার বলিছিলি না, বিন্দবুনি চাদরের কথা তোর ছেলের জন্যে-তা নিবি?…

নিবারণের মা বলিল-আছে? দেয়া একটু ধীবুক, মোর ছেলেরে সঙ্গে করে এখনি আসবো এখন-নতুন আছে মা-ঠাকুরোন, না পুরোনো?…

সর্বজয়া বলিল, তুই আয় না-এখুনি দেখবি?…একটু পুরোনো, কিন্তু সে কেউ গায়ে দেয় নি-ধোয়া তোলা আছে-পরে একটু থামিয়া বলিল-তোরা আজকাল চাল ভানচিস নে?.

নিবারণের মা বলিল-এই বাদলায় কি ধান শূকোয় মা ঠাকুরোন…খাবার বলে দুটোখানি রেখে দিইচি অমনি

সর্বজয়া বলিল-এক কাজ করা না-তাই গিয়ে আমায় আধকাটা খানেক আজ দিয়ে যাবি?. একটু সরিয়া আসিয়া মিনতির সুরে বলিল-বৃষ্টির জন্যে বাজার থেকে চাল আনাবার লোক পাচ্চিনে-টাকা নিয়ে নিয়ে বেড়াচ্চি তা কেউ যদি রাজি হয়—বড় মুশকিলে পড়িচি মা–

নিবারণের মা স্বীকার হইয়া গেল, বলিল-আসবো এখন নিয়ে, কিন্তু সে ভেটের ধানের চালির ভাত কি আপনারা খেতে পারবেন মা-ঠাকুরোন?…বড্ড মোটা—

নিমছাল সিদ্ধ দুৰ্গা আর খাইতে পারে না। তাহার অসুখ একভাবেই আছে। ঔষধ নাই, পথ্য নাই, ডাক্তার নাই, বৈদ্য নাই। বলে–এক পয়সার বিস্কুট আনিয়ে দেবে মা, নোনতা, মুখে বেশ লাগে।

সাবু তাই জোটে না, তার বিস্কুট।

বৈকালবেলা হইতে আবার ভয়ানক বৃষ্টি নামিল। বৃষ্টির সঙ্গে ঝড়ও যেন বেশি করিয়া আসে-ঘোর বর্ষণমুখর নির্জন, জলে থই-থই, কুহু পুবে হাওয়া বওয়া, মেঘে অন্ধকারে একাকার ভাদ্র-সন্ধ্যা! আবার সেই রকম কালো কালো পেঁজা তুলোর মতো মেঘ উড়িয়া চলিয়াছে।…বৃষ্টির শব্দে কান পাতা যায় না—দরজা জানোলা দিযা ঠাণ্ডা হাওয়ার ঝাপটার সঙ্গে বৃষ্টির ছাট দু-জু করিয়া ঢোকে-ছেড়া থলে ছেড়া কাপড়-গোঁজা ভাঙা কাবাটের আড়ালের সাধ্য কি যে ঝড়ের ভীম আক্রমণের মুখে দাঁড়ায়।

বেশি রাত্ৰে সকলে ঘুমাইলে বেশি বৃষ্টি নামিল। সর্বজয়ার ঘুম আসে না—সে বিছানায উঠিয়া বসে। বাহিরে শুধু একটানা ফুস হ্রস জলের শব্দ; কুদ্ধ দৈত্যের মতো গজমান একটানা গোঁ গোঁ বাবে ঝড়ের দমকা বাড়িতে বাধিতেছে! …জীৰ্ণ কোঠাখানা এক-একবাবেবী দমকায় যেন থর থর কবিয়া কঁপে,.ভয়ে তাহার প্রাণ উড়িয়া যায়.গ্রামের একাধারে বাঁশবনের মধ্যে ছোট ছোট ছেলেমেযে লইয়া নিঃসহায়!.মনে মনে বলে-ঠাকুর, আমি মারি তাতে খেতি নেই-এদেব কি করি?-এই রাত্তিরে যাই বা কোথায়?… মনে মনে বসিয়া বসিয়া ভাবে-আচ্ছা যদি কোঠা পড়ে, তবে দালানের দেওয়ালটা বোধ হয় আগে পড়বে।-যেমন শব্দ হবে আমনি পানচালার দোর দিয়ে এদের টেনে বাব করে নেবো–

সে যেন আর বসিয়া থাকিতে পারে না-কয়দিন সে ওলশাক কচুশাক সিদ্ধ করিয়া খাইয়া দিন কটাইতেছে–নিজে উপবাসের পর উপবাস দিয়া ছেলেমেয়েকে যাহা কিছু সামান্য খাদ্য ছিল খাওয়াইতেছে- শরীর ভাবনায় অনাহারে দুর্বল, মাথার মধ্যে কেমন করে।

ঝড়ের গোঁ গো শব্দ, অনেক রাত্রে ঝড় বাড়িল। বাহিরে কি ঝটিকা আসিল! উপায়! একবার বড় একটা দমকায় ভয় পাইয়া সে ঝড়ের গতিক বুঝিবার জন্য সন্তৰ্পণে দালানের দুয়ার খুলিয়া বাইরের রোয়াকে মুখ বাড়াইল.বৃষ্টির ছাটে কাপড় চুল সব ভিজিয়া গেল-জু দুএকটানা হওয়ার শব্দে বৃষ্টিপতনের ঝড়ের শব্দ ঢাকিয়া গিয়াছে-বাহিরে কিছু দেখা যায় না-অন্ধকারের মেঘে। আকাশে বাতাসে গাছপালায় সব একাকার! ঝড়-বৃষ্টির শব্দে আর কিছু শোনা যায় না।

এই হিংস্ৰ অন্ধকার ও ক্রুর ঝটিকাময়ী রজনীর আত্মা যেন প্ৰলয়দেবের দূতরূপে ভীম। ভৈরব বেগে সৃষ্টি গ্রাস করিতে ছুটিয়া আসিতেছে-অন্ধকারে, রাত্রে, গাছপালায়, আকাশে, মাটিতে তাহার গতিবেগ বাধিয়া শব্দ উঠিতেছে-সুইশ সু-উ-উ-উইশ.সু উ উ উ ই শ…এই শব্দের প্রথমাংশের দিকে বিশ্বগ্রাসী দূতটা যেন পিছু হটিয়া বল সঞ্চয় করিতেছে-সু উ উ—এবং শেষের অংশটায় পৃথিবীর উচ্চ নীচ তাবৎ বায়ুস্তর আলোড়ন, মন্থন করিয়া বায়ুস্তরে বিশাল তুফান তুলিয়া তাহার সমস্ত আসুরিকতার বলে সর্বজয়াদের জীর্ণ কোঠাটার পিছনে ধাক্কা দিতেছে-ইই শ..! কোঠা দুলিয়া দুলিয়া উঠিতেছে…আর থাকে না! ইহার মধ্যে যেন কোনো অধীরতা, বিশৃঙ্খলতা, ভ্রম-ভ্রান্তি নাইযেন দৃঢ়, অভ্যস্থ, প্রণালীবদ্ধ ভাবের কর্তব্যকাৰ্য.বিশ্বটাকে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে চুৰ্ণ করিয়া উড়াইয়া দেওয়ার ভার যে লইয়াছে, যুগে যুগে এরকম কত হাস্যমুখী সৃষ্টিকে বিধ্বস্ত করিয়া অনন্ত আকাশের অন্ধকারে তারাবাজির মতো ছড়াইয়া দিয়া আসিয়াছে যে মহাশক্তিমান ধ্বংসদূত-এ তার অভ্যস্ত কাৰ্য…এতে তার অধীরতা উন্মত্ততা সাজে না…

175 Shares