পথের পাঁচালী

তুমি কে খোকা? কোথেকে আসচো?…

অপু আনাড়ির মতো আগাইয়া আসিয়া অতিকষ্টে উচ্চারণ করিল–এই আমার বাড়ি–নিশ্চিন্দিপুরে, আমার-নাম অ-অপু।

তাহার মনে হইতেছিল, না আসিলেই ভালো হইত। হয়তো তাহার পিসিমা তাহার এরূপ অপ্রত্যাশিত আগমনে বিরক্ত হইবে, হয়তো ভাবিবে কোথা হইতে আবার এক আপদ আসিয়া জুটিল।…তাহা ছাড়া,-কে জানিত আগে যে অপরিচিত স্থানে আসিয়া কথাবার্তা কওয়া এত কঠিন কাজ? তাহার কপাল ঘামিয়া উঠিল।

কিন্তু মেয়েটি তখনই ছুটিয়া আসিয়া তাহার হাত ধরিয়া মহা-আদরে রোয়াকে উঠাইয়া লইয়া গেল। তাহার মা-বাবা কেমন আছেন সেকথা জিজ্ঞাসা করিল। তাহার চিবুকে হাত দিয়া কত আদরের কথা বলিল। দিদিকে যদিও কখনও দেখে নাই। তবুও দিদির নাম করিয়া খুব দুঃখ করিল। নিজের হাতে তাহার গায়ের জামা খুলিয়া হাতমুখ ধোয়াইয়া শুকনা গামছা দিয়া মুছইয়া তাড়াতাড়ি এক গ্লাস চিনির শরবৎ করিয়া আনিল। পিসি বলিতে সে যাহা ভাবিয়ছিল তাহা নয়, অল্প বয়স, রাজীর দিদির চেয়ে একটু বড়।

তাহার পিসিও তাহার দিকে চাহিয়া চাহিয়া দেখিতেছিল। জ্ঞাতি-সম্পর্কের ভাইপোটি যে দেখিতে এত সুন্দর বা তাহার বয়স এত কম তাহার পিসি বোধ হয় ইতিপূর্বে জানিত না। তাই পাশের বাড়ি হইতে একজন প্রতিবেশিনী আসিয়া অপুর পরিচয় জিজ্ঞাসা করিলে সে একটু গর্বের সহিত বলিল-আমার ভাইপো, নিশ্চিন্দিপুরে বাড়ি, খুড়তুতো ভায়ের ছেলে; সম্পর্কে খুবই আপন, তবে আসা-যাওয়া নেই। তাই!… পরে সে পুনরায় গর্বের চোখে অপুর দিকে চাহিয়া রহিল। ভাবটা এই–দ্যাখো আমার ভাইপোর কেমন রাজপুত্ত্বরের মতো চেহারা, এখন বোঝে কী দরের-কী বংশের মেয়ে আমি!…

সন্ধ্যার পর কুঞ্জ চক্ৰবতী বাড়ি আসিল। পাকশিটে-মারা চোয়াড়ে-চোয়াড়ে চেহারা, বয়স বুঝিবার উপায় নাই। তাহার পিসিকে দেখিয়া তাহার যেমন লজ্জা হইয়াছিল, পিসেমশায়কে তেমনি তাহার ভয় হইল। ছেলেবেলায় সে যে প্ৰসন্ন গুরুমশায়ের কাছে পড়িত, তেমনি যেন চেহারাটা। মনে হইল এ লোক যেন এখনই বলিতে পারে-বড্ড জ্যাঠা ছেলে দেখচি তো তুমি?…

পরদিন সকালে উঠিয়া অপু পাড়ার পথে এদিকে-ওদিকে একটু ঘুরিয়া আসিল। চারিদিক জঙ্গলে ভরা, ফাঁকা জমি-দূৰ্বাঘাস প্রায় নাই, এমন জঙ্গল। এই একটা বাড়ি, আবার বনে-ঘেরা সুড়িপথ বাহিয়া গিয়া আবার দূরে একটা বাড়ি। অনেক সময় লোকের বাড়ির উঠানের উপর দিয়া পথ। তাহার বয়সি দু’চারজনকে খেলা করিতে দেখিল বটে, কিন্তু সকলেই তাহার দিকে এমন হ্যাঁ করিয়া চাহিয়া রহিল যে, তাহাদের সঙ্গে আলাপ করিবার চেষ্টা করা তো দূরের কথা, সে তাহাদের মুখের দিকে চাহিতে পারিল না।

পিসির বাড়ির দিকে ফিরিবার সময়ও বিপদ। এরূপ সকালে মার কাছে সে চিড়া, মুড়ি, নাড়ু বা বাসি-ভাত খাইয়া থাকে। এখানে কি উহারা দিবে? কাল তো রাত্ৰে ভাত খাইবার সময় দুধের সঙ্গে সন্দেশ কিনিয়া আনিয়া দিয়াছে। আজ যদি সে এখনই ফিরে, তবে হয়তো উহারা ভাবিবে ছেলেটা ভারি পেটুক; খাবার খাইবার লোভে-লোভে এত সকালে বাড়ি ফিরিল। রোজ রোজ খাবার খাওয়া কি ভালো?…এখন সে কি করে? নাঃ, বাড়ি ফিরিবে না। আরও খানিক পথে পথে ফিরিয়া একেবারে সেই ভাত খাওয়ার সময়ের একটু আগে বাড়ি যাইবে। অপরিচিত জায়গায় এতক্ষণ পথেই বা কোথায় দাঁড়াইয়া থাকে?

পায়ে পায়ে সে অবশেষে বাড়িতেই আসিয়া পৌঁছিল।

একটি ছয়-সাত বছরের মেয়ে একটা কাঁসার বাটি হাতে বাড়ি ঢুকিয়া উঠান হইতে ডাকিয়া কহিল-নাউ রেঁধেচো জেঠিমা, মোরে একটু দেবে?…

অপুর পিসিমা ঘরের ভিতর হইতে বলিল-কে রে, গুলকী? না, ওবেলা রাধবো, এসে নিয়ে যাস…

গুলকী বাটি নামাইয়া রোয়াকের ধারে দাঁড়াইয়া রহিল। মাথার চুলগুলা কাঁকড়া ঝাকড়া, ছেলেদের চুলের মতো খাটো। ময়লা কাপড় পরনে, মাথায় তেল নাই, রং শ্যামবর্ণ। অপুর দিকে চাহিয়া, কি বুঝিয়া একবার ফিক করিয়া হাসিয়া সে বাটি উঠাইয়া চলিয়া গেল।

অপু জিজ্ঞাসা করিল-মেয়েটা কাদের পিসিমা?

তাহার পিসি বলিল-কে, গুলকী? ওদের বাড়ি এখানে না-ওর মা-বাপ কেউ কোথাও নেই। নিবারণ মুখুজ্যের বৌ-এই যে পাশের বাড়ি, ওর দূর-সম্পর্কের জেঠি-সেখানেই থাকে।

পরদিন পাড়ার একটা ছেলে আসিয়া যাচিয়া তাহার সঙ্গে ভাব করিল ও সঙ্গে করিয়া গ্রামের সকল পাড়া ঘুরাইয়া দেখাইয়া বেড়াইল। বাড়ি ফিরিবার পথে দেখিল-সেই অনাথা মেয়ে গুলকী পথের ধারে পা ছড়াইয়া একলাটি বসিয়া কী খাইতেছে। তাহাকে দেখিয়া তাড়াতাড়ি আঁচল গুটািইতে গেল-আঁচলে একরাশ আধাপাকা বকুল ফল। অপু। ইতিমধ্যে পিসিমার কাছে তাহার আরও পরিচয় লইয়াছে; নিবারণ মুখুজ্যের বৌ ভালো ব্যবহার করে না, লোক ভালো নয়। পিসিমা বলিতেছিল– জেঠি তো নয় রণচণ্ডী, কত দিন খেতেও দেয় না, এর বাড়ি ওর বাড়ি খেয়ে বেড়ায়। নিজের পুষ্যিই সাতগাণ্ডা—তাদেরই জোটে না, তায় আবার পর!.গুলকীকে দেখিয়া অপুর মোটেই লজ্জা হয় নাছোট্ট একটুকু মেয়েটা, আহা কেহ নাই! তাহার সঙ্গে ভোব করিতে অপুর বড় ইচ্ছা হইল। সে কাছে গিয়া বলিল-আঁচলে কি লুকুচ্চিস দেখি খুকি?..

গুলকী হঠাৎ আঁচল গুটািইয়া লইয়া ফিক করিয়া হাসিয়া নিচু হইয়া দৌড় দিল। তাহার কাণ্ড দেখিয়া অপুর হাসি পাইল। ছুটিবার সময় গুলকীর আঁচলের বকুল ফল পড়িতে পড়িতে চলিয়াছিল, সেগুলি সে কুড়াইতে কুড়াইতে বলিল-পড়ে গেল, সব পড়ে গেল, নিয়ে যা তোর বকুল ও খুকি, কিছু বলবো না, ও খুকি!..

গুলকী ততক্ষণে উধাও হইয়াছে।

পুকুরে স্নান সারিয়া আসিয়া সে বসিয়া আছে, এমন সময় দেখিতে পাইল খিড়কি দরজার আড়াল হইতে গুলকী একবার একটুখানি করিয়া উঁকি মারিতেছে আর একবার মুখ লুকাইতেছে। তাহার সহিত চোখোচে্যুখি হওয়াতে গুলকী ফিক্‌ করিয়া হাসিয়া ফেলিল। অপু দাঁড়াইয়া উঠিয়া বলিল-দীড়া, তোকে ধরচি এক দৌড়ে—বলিয়া সে খিড়কি-দরজার দিকে ছুটিল।

গুলকী আর পেছন দিকে না চাহিয়া পথ বাহিয়া সোজা পুকুরপাড়ের দিকে ছুটু দিল। কিন্তু অপুর সঙ্গে পরিবে কেন? নিরূপায় দেখিয়া দাঁড়াইয়া পড়িতেই অপু তাহার কাঁকড়া চুলগুৱা মুঠায় চাপিয়া ধরিয়া বলিল-বড় ছুটি দিচ্ছিলি যে? আমার সঙ্গে ছুটে বুঝি তুই পারবি, খুকি?

গুলকীর প্রথম ভয় হইয়াছিল বুঝি বা তাহাকে মারিবে! কিন্তু অপু চুলের মুঠি ছাড়িয়া দিয়া হাসিয়া ফেলায়, সে বুঝিল এ একটা খেলা। সে আবার সেই রকম হাসিয়া ফেলিল।

অপুর বড় দয়া হইল। তাহার মুখের হাসিতে এমন একটা আভাস ছিল যাহাতে অপুর মনে হইল এ তাহার সঙ্গে ভোব করিতে চায়-খেলা করিতে চায়; কিন্তু ছেলেমানুষ, কথা কহিতে জানে না বলিয়া এইরকম উকিঝুকি মারিয়া-ফিক করিয়া হাসিয়া-দৌড়িয়া পলাইয়া-তাহার ইচ্ছা প্রকাশ করে। অন্য উপায় ইহার জানা নাই। এ যেন ঠিক তাহার দিদি: এই বয়সে দিদি যেন এই রকমই ছিল–এই রকম আঁচলে কুল-বেল-বৈঁচি বাঁধিয়া আপন মনে ঘুরিয়া বেড়াইত, কেহ বুঝিত না, কেহ দেখিত না, এই রকম পেটুক-এই রকম বুদ্ধিহীন ছোট মেয়ে!

অপু ভাবিল-এর সঙ্গে কেউ খেলা করে না, একে নিয়ে একটু খেলি। আহা, মা-বাপ-হারা দুঃখী মেয়ে, আপন মনে বেড়ায়!—সে গুলকীর চুলের মুঠ ছাড়িয়া দিয়া হাত ধরিয়াছিল, বলিলখেলা করবি খুকি? চল ওই পুকুরের পাড়ে। না, এক কাজ করা খুঁকি, আমি তোকে ধরবো-আর তুই ছুটে যাবি; ওই কাঁঠাল গাছটা বুড়ি। আয়

মুঠ ছাড়িয়া দিতেই গুলকী আর না দাঁড়াইয়া আবার নিচু হইয়া দৌড় দিল। অপু চেঁচাইয়া বলিল–আচ্ছা যা, যা দেখি কদূর যাবি-ঠিক তোকে ধরব দেখিস। আচ্ছা ওই গেলি তো এই দ্যাখ-বলিয়া নিঃশ্বাস বন্ধ করিয়া সে এক দৌড় দিল-চু-উ-উ-উ। গুলকী পিছন দিকে চাহিয়া অপুকে দৌড়িতে দেখিয়া প্ৰাণপণে যতটুকু তাহার ক্ষুদ্র শক্তিতে কুলায় দৌড়িবার চেষ্টা করিল–কিন্তু অপু একটুখানি ছুটিয়া গিয়াই তাহাকে ধরিয়া ফেলিল। ভারি ছুটতে শিখিচিস খুঁকি না? তা কি তুই আমার সঙ্গে পারিস? চল চোর-চৌকিদার খেলা করবি-তুই হবি চোর-এই কাঁঠাল পাতা চুরি

গুলকীর মুখে হাসি আর ধরিতেছিল না-হয়তো সে এতক্ষণ মনে মনে চাহিতেছিল এই সুন্দর ছেলেটির সঙ্গে ভাব করিতে। মাথা নাড়িয়া আশ্বাস দিবার সুরে বলিল-কাইবিচি নেবে?

অপু মনে ভাবিল চাষার গ্রামে থাকিয়া ও এই সব কথা শিখিয়াছে।–তাহদের গ্রামে যেমন গোয়ালা কি সদগোপের ছেলেমেয়েরা কথা বলে তেমনি।

দুপুরবেলা তাহার পিসিমা ডাকিলে পিছনে পিছনে গুলকী আসিল! অপুর খাওয়া হইয়া গেলে তাহার পিসি জিজ্ঞাসা করিল-ভাত খাবি গুলকী? অপুর পাতে বোস-মোচার ঘণ্ট আছে—ডাল দিচ্ছি, অপু ভাবিল–আহা, ও খাবে জানলে দুখানা মাছ ওর জন্যে রেখে দিতাম। গুলকী দ্বিরুক্তি না। করিয়া নির্লজ্জভাবে খাইতে বসিল। অনেকগুলি ভাত চাহিয়া লইয়া ডাল দিয়া সেগুলি মাখিল, পরে অনেকক্ষণ বসিয়া বসিয়া অত ভাত না খাইতে পারিয়া পাতের পাশে রাশীকৃত ঠেলিয়া রাখিল। তবুও উঠিবার নাম করে না। অপুর পিসিমা হাসিয়া বলিল-আর খেতে হবে না গুলকী-হ্যাঁসফাঁস কচ্চিাস-নে ওঠ, কত ভাত নিয়ে ফেললি দ্যাখা তো? তোর কেবল দিষ্টি-খিদে-পরে বলিল, জেঠিমার কাণ্ড দ্যাখো-এতখানি বেলা হয়েচে-কাঁচা মেয়েট-ভাত খেতে ডাকেও না? হলাইবা পর-তা হলেও কচি তো?…

175 Shares