পথের পাঁচালী

অনেক রাত্রে উঠিয়া এক-একদিন হরিহর বাহিরে দাওয়ায় বসিয়া কি ভাবিত, অনির্দিষ্ট কোন আনন্দে তাহার মন যেন পালকের মতো হালকা হইয়া উঠিত।

কি উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ তাহার সম্মুখে!…

ঝাড়লন্ঠনের আলো-দোলানো বড় আসরে সে দেখিতে পায়, দেশে দেশে গ্রামে গ্রামে তাহার ছড়া, গান, শ্যামাসংগীত, পদ রাত্রির পর রাত্রি ধরিয়া গাওনা হইতেছে। কত দূর-দূরান্তর হইতে মাঠ ঘাট ভাঙিয়া লোক খাবারের পুঁটুলি বাঁধিয়া আনিয়া বসিয়া আছে শুনিতে। দলের অধিকারীরা তাহার বাড়ি আসিয়া সাধিয়া পালা চাহিয়া লইয়া গিয়াছে।

বাঃ! ভারি চমৎকার তো। কার বাঁধা ছড়া?—‘কবির গুরু ঠাকুর হবু-’ হরু ঠাকুরের?– না। নিশ্চিন্দিপুরের হরিহর রায় মহাশয়ের।

এই দশাশ্বমেধ ঘাটেই বসিয়া তো বাইশ বৎসর পূর্বে মনে মনে কত ভাঙাগড়া করিয়াছেতারপর কবে সে সব ধীরে ধীরে ভুলিয়া গেল-কবে ধীরে ধীরে নতুন খাতাপত্রের তাড়া বাক্সের অনাদৃত, গুপ্ত কোণ আশ্রয় করিয়া দিনের আলো হইতে মুখ লুকাইয়া রহিল-যৌবনের স্বপ্নজাল জীবন-মধ্যাহ্নে কুয়াশার মতো দিগন্তে মিলাইয়া গেল।

হারানো যৌবনের দিকে চাহিয়া দেখিলে বুকের মধ্যে কেমন করিয়া ওঠে, কত কথা মনে পড়ে-জীবনের সে সব দিনকে আর একটিবারও ফেরানো যায় না?

দশাশ্বমেধ ঘাটে অনেক ছেলের সঙ্গে অপুর ভাব হইয়াছে। কিন্তু এখানে তাহার বয়সি সব ছেলেই স্কুলে পড়ে, সে-ই কেবল এখনও স্কুলে পড়ে নাই। নিশ্চিন্দিপুরে মাছ ধরিয়া ও নৌকায় বেড়াইয়া দিন কাটানো চুলিত বটে, কিন্তু এখানে সমবয়সিদের কাছে কিছু পড়ে না বলিতে লজ্জা করে।

তাহা ছাড়া দশাশ্বমেধ ঘাটে যেসব ছেলের সঙ্গে তাহার ভাব হইয়াছে, সবাই অবস্থাপন্ন ঘরের চলে। পল্টুর দাদা একদিন কথায় কথায় বলিয়াছিল যে তাহার বাবাকে খুব বিদেশে বেড়াইতে হয়। অপু বলিয়াছিল-কেন, তোমাদের বুঝি খুব শিষ্য-বাড়ি আছে?

পটুর দাদা আশ্চর্য হইয়া বলিল-শিষ্য-বাড়ি? কিসের ভাই?…

অপু সদুত্তর দিবার পূর্বেই সে বলিল-আমার বাবা কন্ট্রাক্টরি করেন কি না? তা ছাড়া কাঁথিতে ছোট জমিদারি আছে- তবে আজকাল কিস্তি দিয়ে কী-ই বা থাকে?

এক-একদিন বৈকালে অপু দশাশ্বমেধ ঘাটে বেড়াইতে গিয়া বাবার মুখে পুরাণপাঠ শোনে। হরিণশিশু শ্বাপদ কর্তৃক নিহত হইলে হরিণ-বালকের স্নেহাসক্ত রাজর্ষি ভারতের করুণ বিরহবেদনা ও পরিশেষে তাহার মৃত্যুর কাহিনী ষষ্ঠী মন্দিরে পৈঠার উপর বসিয়া একমনে শুনিতে শুনিতে তাহার চোখে জল আসে-এদিকে আবার যখন সিন্ধু সৌবীরের রাজা রঘুগণ তাঁহার স্বরূপ না জানিয়া ব্ৰহ্মার্ষি ভরতকে শিবিকাবাহক নিযুক্ত করেন-তখন হইতে কৌতুহলে ও উৎকণ্ঠায় তাহার বুক দুবু দুরু করে, মনে হয় এইবার একটা কিছু ঘটিবে; ঠিক ঘটবে। কথকতার শেষে পূরবী সূরের আশীৰ্বাচনটি তাহারা ভারি ভালো লাগে–

কালে বৰ্ষতৃ পর্জন্যং পৃথিবী শস্যশালিনী

লোকাঃ সন্তু নিরাময়াঃ…

সন্ধ্যার দিকে মন্দিরে মন্দিরে শঙ্খ ঘণ্টার ধ্বনির সঙ্গে অস্তসূর্যের রাঙা আভা ও পূরবীর মুৰ্দ্ধনার সঙ্গে হরিণ-বালকের বিয়োগবেদনাতুর রাজর্ষির ব্যথা যেন মিশাইয়া থাকে।

বাড়িতে কাগজ কলম বাবার কাছে লইয়া গিয়া বলে-আমায় লিখে দাও না বাবা, ওই যে তুমি গাও-কালে বৰ্ষতু পর্জন্যং?

হরিহর খুশি হইয়া বলে-তুই বুঝি শূনসি খোকা?

-আমি তো রোজই থাকি।–তুমি কাল যখন ভারতের মা মারা যাওয়ার কথা বলছিলে আমি তখন তো তোমার পিছন দিকে বসে-ষষ্ঠীর মন্দিরের ধাপে–

–তোর কি রকম লাগে।–ভালো লাগে?

–খু-উ-উ-ব। আমি তো রোজ রোজ শুনি—

অপু কিন্তু একটা কথা লুকায়। যেদিন তাহার সঙ্গীরা থাকে, সেদিন কিন্তু বাবার দিকে সে যায় না। সেদিন বাবার নিকট দিয়া যাইতেছিল, তাহার বাবা দেখিতে পাইয়া ডাকিল।–খোকা, ও খোকা–

তাহার সঙ্গের বন্ধুটি বলিল-তোমাকে চেনে নাকি?

–অপু শুধু ঘাড় নাড়িয়া জানায়, হ্যাঁ। সে বাবার কাছে আসে নাই সেদিন। তাহার বাবা ঘাটে কথকতা করিতেছে, একথা বন্ধুরা পাছে টের পায়! সে পল্টুর দাদা ছাড়া অন্য বন্ধুদের কাছে গল্প করিয়াছে, কাশীতে তাহদের বাড়ি আছে, তাহারা কাশীতে হাওয়া বদলাইতে আসিয়াছে, দেশে খুব বড় বাড়ি, তাহার বাবা কন্টট্রাক্টরি করেন, তা ছাড়া দেশে জমিদারিও আছে। শেষে বলে-কিন্তু জমিদারি থাকলে কি হবে, কিস্তি দিযে কীইবা থাকে?

তাহার বন্ধুদের বয়স তাহার অপেক্ষা খুব বেশি নয় বলিয়াই বোধ হয় তাহার বর্ণিত গল্পের সঙ্গে তাহার পোশাক-পরিচ্ছদের অসঙ্গতি ধরা পড়ে না, বিশেষত তাহার সুন্দব মুখের গুণে সব মানাইয়া যায়।

পূৰ্ণিমার দিন কথক ঠাকুরেব ওখানে বেশ ভিড় হইল। সন্ধ্যার পব হরিহর কথা শেষ করিযী। ঘাটের রানায় বসিয়া বিশ্রাম করিতেছে, কথক ঠাকুর জলে হাত মুখ ধুইতে নামিল। হরিহরকে দেখিয়া বলিল-এই যে আপনিও আছেন, দেখলেন তো কাণ্ড, পুস্নিমের দিনটা—বলি আজ দিনটা ভালো আছে, বামন-ভিক্ষে লাগাই।–মাসে মাসে এই কাশীতে বামন-ভিক্ষা হলে পরে পনেরো সের আধমণ করে চাল পড়তো-আজকাল মশাই মহা বামন-ভিক্ষেতেও লোকে আর ভেজে না-চালের তো একটা দানাও না-এদিকে সিকে পাঁচেক হবে, তবে মধ্যে আবার দুটো অচল দোয়ানি!.মশায়ের শিক্ষা কোথায়?

–শিক্ষা তো ছিল এ কাশীতেই অনেকদিন আগে। তবে এত দিন দেশেই ছিলাম-এইবার এখানে এসে বাসা করে আছি.

—মশায়ের বাসা কি নিকটে?…একটু চা খাওয়াতে পারেন?…কদিন থেকে ভাবচি একটু চা থাবো।-এই দেখুন না, চাদরের মুড়োয় চা বেঁধে নিয়ে নিয়ে ঘুরি, বলি না হয় কোনো হালুইকরের দোকানে একটু গরম জল করিগে…গলা বসে গিয়েচে, একটু লোন-চা খেলে গলাটা…

-হ্যাঁ হ্যাঁ, আসুন না। এই তো নিকটেই আমার বাসা-চলুন না? কথককে লইয়া হরিহর বাড়ি আসিল।

চা খাওয়ার পাট কোন কালে নাই। কড়ায় জল গরম করিয়া চা তৈরি হইল। অপু’ৰ্কাসার গ্লাসে চা ও রেকাবিতে কিছু খাবার কথকের সামনে লইয়া আসিল। খাবার দেখিয়া কথকঠাকুর ভারি খুশি হইল-খাবারের আশা সে করে নাই।

–এটি ছেলে বুঝি! বাঃ বেশ ছেলে তো আপনার? ভারি সুন্দর দেখতে–বাঃ–এসো এসো বাবা, থাক থাক কল্যাণ হোক-লোন-চা করিয়েছেন তো মশায়?…দেখি–

হরিহর বলিল-আপনার কি ছেলেপিলে সব এখানেই-

–সংসারই নেই তো ছেলেপিলে?…দশ বিঘে জমিও বেরিয়ে গেল অথচ ও মূলেও হাভাত-জমি ক’বিঘে যদি আজ থাকতো-তো আজ কি এই এতদূরে আসি।–আপনিও যেমন!…এসব কি আর দেশ মশাই?…বিশ্বেশ্বর অবিশ্যি মাথায় থাকুন-এমন শীতকাল যাচ্চে মশাই-না একটু খেজুর রস, না একটু গুড় পাটালি–আমার নিজের মশাই দু’কুড়ি খেজুর গাছ–

–মশাইয়ের দেশটা কোথায়?

–সাতক্ষীরের সন্নিকট-বাদুড়ে-শীতলকাটি জানেন? শীতলকাঠির চক্কত্তিরা খুব ঘবানাহরিহর তামাক সাজিয়া নিজে কয়েক টান দিয়া কথক ঠাকুবের হাতে দিয়া বলিল-খান—

–কিছু না মশায়, ফাগুন মাসের দিকে তো যাই-একটা বাগান আছে, দিয়ে আসি বিক্লি করে- আমরা আবার শ্রোত্রিয় কিনা?… তা জমি দশ বিঘে ছিল তাই বন্ধক দিয়ে পণ জোগাড় করলাম–বিয়েও করলাম। –মশাই দশ বছর ঘর করলাম। –হল কি জানেন? সন্ধ্যাবেলা রান্নাঘরের চাল থেকে কুমড়ো কাটতে গিয়েচে-ছিল মশাই সেখানে সাপ আমার জন্যে তৈরি হয়ে-হাতে দিয়েচে কামড়ে–আমি আবার নেই সেদিন বাড়ি–কেইবা বদ্যি কবরেজ দেখিয়েচে, কেই বা করেচে-পাটুলির ঘাট পার হচ্চি–গায়ের মহেশ সাধুখ ওপার থেকে আসচে, আমায় বল্লেশিগগির বাড়ি যান মশায়—আপনার বাড়ি বড় বিপদ-কি বিপদ তা বলে না-বাড়ি পৌঁছে দেখি আগের রাত্ৰিতেই বৌ তো গিয়েচে মারে!–এই গোল ব্যাপার মশাই…জমিকে জমিও গেল।– এদিকেও–। সেই থেকে বলি যাই, দেশে থেকে আর কী-ই বা হবে।–কোথেকে পাবো তিন-চারশ টাকা যে আবার বিয়ে করবো?…যাই বিশ্বনাথের ওখানে.অন্নকক্টটা তো হবে না…আজ বছর আষ্টেক হয়ে গেল-এক খুড়তুতো ভাই আছে৷–জমিজমা সামান্য যা একটু আছে, দখল করে বসে আছেবলে তোমার ভাগ নেই।–বেশ বাপু, নেই তো নেই।–গোলমালের মধ্যে কখখনো আমি যাবো না-কবগে যা দখল। উঠি মশাই–আপনাব এখানে বেশ চা খাওয়া গেল-আপনার ছেলেটি কোথায় গেল? বেশ ছেলে, খাসা ছেলে–

পুরানো চামড়ায় তালি দেওয়া ক্যাম্বিসের জুতা জোড়াটা ঝাড়িয়া লইয়া কথকঠাকুর পায়ে দিয়া দবাজার কাছে আসিল-যাইতে যাইতে বলিল-কালও লাগাবো বামনভিক্ষ্যে-দেখি কি হয়—

একত্রিংশ পরিচ্ছেদ

হরিহরের বাসাটা বিশেষ ভালো নয়। নিচের তলায় স্যাৎসোঁতে ঘর, তাও মাত্ৰ দুখানি, এত অন্ধকার যে হঠাৎ বাহির হইতে আসিলে ঘরের কোনো জিনিস নজরে পড়ে না। এরকম স্থানে সর্বজয়া কখনও বাস করে নাই, তাহাদের দেশের বাড়ি পুরানো হইলেও রৌদ্রহাওয়া খেলিবার বড় বড় দরজা জানোলা ছিল, সেকালের উঁচু ভিতের কোঠা, খটু খটু করিত, শুকনা। এ বাসার স্যাৎসেঁতে মেজে ও অন্ধকারে সর্বজয়ার মাথা ধরে। অপু তো মোটেই ঘরে থাকে না, সূর্যালোকপুষ্ট নবীন তবুর ন্যায়। শুধু আলোর দিকে তার মুখটি থাকে ফিরানো, নিশ্চিন্দিপুরের মুক্ত মাঠে, নদীর আলো হাওয়ায় মানুষ হইয়া এই বদ্ধঘরের অন্ধকারে তার প্রাণ হাঁপাইয়া ওঠে, একদণ্ডও সে সেখানে তিষ্ঠিতে পারে না।

175 Shares