পথের পাঁচালী

কাশী দেখিয়া সে একটু নিরাশ হইয়াছে। বড় বড় বাড়িঘর থাকিলে কি হইবে, এখানে বন নাই মোটেই।

সন্ধ্যার দিকে একদিন কথকঠাকুর হরিহরের বাসায় আসিল। একথা ওকথার পর বলিল-কই আপনার ছেলেকে দেখচি নে?

হরিহর বলিলকোথায় বেরিয়েচে খেলা করতে, দশাশ্বমেঘ ঘাটের দিকেই বোধ হয় বেরিয়েচে–

কথকঠাকুর উড়ানির প্রান্তে কি দ্রব্য খুলিতে খুলিতে বলিল-আপনার ছেলের সঙ্গে বড় ভোব হয়ে গিয়েচে মশাই-সেদিন ঘাটে কাছে ডেকে বসিয়ে অনেকক্ষণ ওর সঙ্গে কথা কইলাম-কড়ি খেলতে ভালোবাসে তাই এই দুটো বড় বড় সমুদ্রের কড়ি সেদিন ব্রতের সিধে কারা দিইছিল, ভাবলাম ওকে দিয়ে আসি-রেখে দিন আপনি, ও এলে দেবেন–

অগ্রহায়ণ মাসের শেবে অপু বাবাকে ধরিল সে স্কুলে ভর্তি হইবে। বলিল-সবাই পড়ে ইস্কুলে বাবা, আমিও পড়বো-ওই তো গলির মোড় ছাড়িয়ে একটুখানি গিয়েই ভালো ইস্কুল–

হরিহর ছেলেকে স্কুলে ভর্তি করিয়া দিল। যদিও ছাত্রবৃত্তিস্কুল তবে ইংরাজি পড়াও হয়। প্রসন্ন গুরুমশায়ের পাঠশালা ছাড়িয়া দেওয়ার পরে-সে। প্রায় চার পাঁচ বছর হইয়া গিয়াছে-এই তাহার পুনরায় অন্য বিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া।

মাঘ মাসের মাঝামাঝি কথকঠাকুর এক টুকরা বালির কাগজ হাতে একদিন হরিহরের বাসায় আসিয়া হাজির। কাগজের টুকরা দেখাইয়া বলিল-দেখুন তো মশাই পড়ে, এই রকম যদি লিখি তবে হয়?

হরিহর পড়িয়া দেখিল, কাশীবাসী রামগোপাল চক্ৰবতী নামে কোনো লোক কথকঠাকুরের নামে স্বগ্রামের দশবিঘা জমি দানপত্র লিখিয়া দিতেছে, অমুক অমুক সাক্ষী, স্থান দশাশ্বমেধ ঘাট, অমুক তারিখ। কথকঠাকুর বলিল-ব্যাপারটা কি জানেন! আমাদের দেশে কুমুরে গ্রামের রামগোপাল চকৃত্তি ভারি পণ্ডিত ছিলেন, মরবার বছর খানেক আগে আমাকে বল্পেন-রামধন, তোমার তো কিছু নেই, ভাবচি তোমাকে বিঘে দশেক জমি দান করব।–তুমি নেবে কি? তা ভাবলাম সদব্ৰাহ্মণ, দিতে চাচ্ছেন, দোেষই বা কি? তারপর তিনি মুখে মুখে জমিটা আমায় দিয়ে দিলেন। দিলেন দিলেন-এতকাল তত গা করিনি, কাশীতেই থাকবো, দেশে ঘরে থাকবো না, কি হবে জমি? তারপর চাকত্তি মশায় গেলেন মারা। জমির দানটা মুখে মুখেই রয়ে গেল। এতকাল পরে ভাবচি দেশে ষাবো-ছেলেপিলে না হলে কি আর মানুষ মশাই? আপনাকে বলতে কি, শ’তিনেক টাকা হাতে করেচি-করেচি জলাহার করে.মশাই-আর শ’দুই টাকা পেলে শ্রোত্ৰিয় ঘরের মেয়ে পাওয়া যায়–তা যদি তাই ঘটে, তবে জমিটা দরকার হবে তো? ভাবলুম মুখে মুখে দান, সে কি আর চাকত্তি মশাই-এর ছেলেরা মানবে? ভেবে চিন্তে এই কাগজখানা বসে বসে লিখিচি-নিজেই লিখিচি মশাই, সাইটই সব-দুজন সাক্ষী, সব বানানো-দেখি লেখা কাগজ যদি মানে। গিয়ে বলবো এই দ্যাখো তোমার বাবা এই জমিটা দান করেচেন–

উঠিবার সময় কথকঠাকুর বলিল-ভালো কথা মশাই, মঙ্গলবারে মাধবী-পূর্ণিমার দিন আপনার ছেলেকে আমি সঙ্গে করে নিয়ে যাবো ওই টেওটার রাজার ঠাকুরের বাড়িতে, ঠিক মানমন্দিরের গায়েই একেবারে। সন্ধের পর বছর বছর ব্রাহ্মণভোজন করায় কি না। একটু সগর্বে বলিল-আমায় একখানা করে নেমন্তন্ন পত্তর দ্যায়, বেশ ভালো খাওয়ায়, চমৎকার। আমি এসে নিয়ে যাবো সেদিন কিন্তু।

মাঘীপূর্ণিমার দিন শেষরাত্রি হইতে পথে স্নানাধীদের ভিড় দেখিয়া সর্বজয়া অবাক হইয়া গেল। দলে দলে মেয়ে পুরুষে জয় বিশ্বনাথজী কি জয়’, ‘বোলো বোম’, ‘বোলো বোম বলিতে বলিতে দুরন্ত মাঘের শীতকে উপেক্ষা করিয়া স্নানের জন্য চলিয়াছে। একটু বেলা হইলে পাঞ্জাবী স্ত্রীলোকটির সঙ্গে সর্বজয়াও স্নান করিতে গোলগঙ্গার ঘাটের জল, সিঁড়ি, মন্দির, পথ সব উৎসববেশে সজিত নরনারীতে পূর্ণ। জলে নামা এক দুঃসাধ্য ব্যাপার। ষষ্ঠীর মন্দিরে লাল নিশান উড়িতেছে।

সন্ধ্যার আগে কথকঠাকুর অপুকে লাইতে আসিল। সর্বজয়া বলিল-পাঠিয়ে দাও গিয়ে, কেউ নেই, অপুর ওপর একটা দাম হয়েচে, দশাশ্বমেধ ঘাটে ওকে ডেকে কাছে বসিয়ে গল্প করে, একদিন নাকি পোপে কিনে খাইয়েচে-পাঠিয়ে দাও, লোক ভালো–

অপু প্ৰথমে কথকঠাকুরের সঙ্গে তাহার বাসায় গেল। খোলার ঘর, মাটির দেওয়ালের নানাস্থানে খড়ি দিয়া হিসাব লেখা। নমুনা–

সিয়ারসোলের রানীর বাড়ি ভাগবত পাঠ …৪্‌

মুসম্মত কুন্তার ঠাকুর বাড়ি… ওই … … ২্‌

ধারক লালজী দেবের একদিনের খোরাকি… ৪।০

বিশেষ কিছু আসবাবপত্র নাই। একখানা সবু চৌকি পাতা, একটা ছোট টিনের তোরঙ্গ, একটা দড়ি-টাঙানো আলনা, একজোড়া খড়ম। দেওয়ালের গায়ে পেরেকে একটা বড় পদ্মবীজের মালা টাঙানো।

কথকঠাকুর বলিল-কমললেবুখাবে?

অপু ঘাড় নাড়িয়া বলিল-আছে আপনার?

কি জানি কেন এই কথকঠাকুরের কাছে তাহার কোনোপ্রকার লজ্জা কি সংকোচ বোধ হইতেছিল না। লেবুর খোসা ছাড়াইতে ছাড়াইতে জিজ্ঞাসা করিল-‘কালে বৰ্ষতৃ পর্জন্যং’ জানেন আপনি?

–কালে বৰ্ষতু পর্জন্যং? খুব জানি, রোজ বলি তো, একদিন শুনো না—

এখন বলুন না একটিবার?

কথক সুর করিয়া বলিল বটে। কিন্তু অপুর মনে হইল তাহার বাবার মুখে শুনিলে আরও ভালো লাগে, কথকের গলা বড় মোটা।

দেশে লইয়া যাইবার জন্য কথকঠাকুর নানা খুচুরা মাটির ও পাথরের জিনিস—পুতুল, খেলনা, শিবলিঙ্গ মালা, কাঠের কঁকই সংগ্ৰহ করিয়া রাখিয়াছে। অপুকে দেখাইয়া বলিল-কাশীর জিনিস, সবাই বলবে কি এনেচ দেখি! তাই নিয়ে যাবো–

নানা সরু গলি পার হইয়া একটা অন্ধকার বাড়ির দরজার সামনে আসিয়া কথকঠাকুর দাঁড়াইল। নিচু দরজা দিয়া অতি কষ্টে কথকের সঙ্গে ঢুকিয়া অপুর মনে হইল বাড়িটায় কেহ কোথাও নাই, সব নিঝুম। কথকঠাকুর দু’একবার গলায় কাশির শব্দ করিতে কে একজন দালানের চারপাই হইতে ঘুম ভাঙিয়া উঠিয়া মোটা গলায় হিন্দিতে কি জিজ্ঞাসা করিল, অপু ত্যাহা বুঝিতে পারিল না। কথকঠাকুর পরিচয় দিবার পরেও মনে হইল লোকটা তাহাকে চিনেও না বা তাহাদের আগমন প্রত্যাশাও করে নাই। পরে লোকটা যেন একটু বিরক্তির সহিত কাহাকে কি জিজ্ঞাসা করিতে গেল। কিন্তু ফিরিতে এত দেরি করিতে লাগিল যে, অপুর মনে হইল হয়তো ইহারা বলিবে তোমাদের তো নিমন্ত্রণ হয় নাই, যাও তোমরা। যাহ্যাঁই হউক, অন্ধকারে ঠায় পনেরো মিনিট দাঁড়াইবার পরে লোকটা ফিরিয়া আসিয়া দালানের একস্থানে আধ-অন্ধকারে খানকতক শালপাতা পাতিয়া ইহাদের বসাইয়া দিল। একটা মোটা পিতলের লোটায় জল দিয়া গিয়াছে। কথকঠাকুর যেন ভয়ে ভয়ে গিয়া আসনের উপর বসিল। রাজার বাড়ি, কি না জানি খাওয়ায়? অধীর আগ্রহে অপু প্রায় আরও বিশ মিনিট পাতা পাতিয়া বসিয়া রহিল-কাহারও দেখা নাই। নিমন্ত্রণ খাইতে পাইবার নিশ্চয়তার সম্বন্ধে যখন পুনরায় অপুর মনে সন্দেহ দেখা দিতেছে ঠিক সেই সময় পরিবেষ্টার আবির্ভাবরূপ অঘটন ঘটিল। মোটা মোটা আটার পুরী ও স্বাদ-গন্ধহীন বেগুনের ঘণ্ট-শেষে খুব বড় বড় লাড়ু। অপু কামড়াইতে গিয়া লাড়ুতে দাঁত বসাইতে পারিল না, এত কঠিন। কথকঠাকুর চাহিয়া চাহিয়া সেই মোটা পুরী খান দশ-বারো আগ্রহের সহিত খাইল। মাঝে মাঝে অপুর দিকে চাহিয়া বলিতেছিল–পেট ভরে খাও, লজ্জা কোরো না, বেশ খাওয়ায়।–বেশ লাড়ু না? দাঁতে এখনও খুব জোর আছে, বেশ চিবুতে পারি।

একশত বৎসর একসঙ্গে থাকিলেও কেহ হয়তো আমার হৃদয়ের বাহিরে থাকিয়া যায়। যদি না কোনো বিশেষ ঘটনায় সে আমার হৃদয়ের কবাট খুলিতে পারে। আজকার এই নিমন্ত্রণ খাইতে আসার অনাদর, অবজ্ঞা, অপু বালক হইলেও বুঝিযাছিল। তাহার পরও এই খাইবার লোভে ও আনন্দে অপুর অন্তরতম হৃদয়ে ঘা লাগিল। তাহার মনে হইল এ কথকঠাকুর অতি অভাজন। ভাবিল, কথকঠাকুর কখনও কিছু খেতে পায় না, আহা, এই লাড়ু তাই আমন করে খাচ্ছে-ওকে একদিন মাকে বলে বাসাতে নেমন্তন্ন করে খাওয়াবো–

করুণা ভালোবাসার সব চেয়ে মূল্যবান মশলা, তার গাঁথুনি বড় পাকা হয়। তাহার শৈশব মনে এই বিদেশী, দুদিনের পরিচিত, বাঙালি কথকঠাকুর তাহার দিদি ও গুলকীর সঙ্গে এক হারে গাঁথা হইয়া গেল সুদ্ধ এক লাড়ু খাইবার অধীর লোভের ভঙ্গিতে।

ইহার অল্পদিন পরেই কথকঠাকুর দেশে চলিয়া গেল। রাজঘাটের স্টেশনে কথকঠাকুরের নির্বন্ধতিশয্যে হরিহর অপুকে সঙ্গে করিয়া তাহাকে গাড়িতে তুলিয়া দিতে গেল। হবিহরের মনে হইল আজ বাইশ বৎসর পূর্বে সে যাহা করিতে দেশে গিয়াছিল-এ ব্যক্তি তাহার বর্তমান বয়সের চেয়েও অন্তত আট বৎসর বেশি বয়সে তাহ্যাঁই করিতে অর্থাৎ নূতন করিয়া সংসার পাতিতে দেশে চলিয়াছে। সুতরাং তাঁহারই বা বয়সটা এমন কি হইয়াছে? কোন কাজ করিবার সময়ের অভাব হইতে পারে তাহার?

175 Shares