পথের পাঁচালী

হরিহরের জ্ঞান হইলেই ছেলের জন্য অস্থির হইযা উঠে। এদিকে ওদিকে চাহিয়া ক্ষীণসুরে বলে–খোকা কই! খোকা কই!…সৰ্বজয়া বলে-আসচে, তাই কি হতচ্ছাড়া ছেলে একটু কাছে বসবে…বেরিযেচে বুঝি সেই ঘাটে। ছেলে বাড়ি এলে বলে-বসতে পারিসনে একটু কাছে। খোকা খোকা করে পাগল-খোকার তো ভেবে ঘুম নেই—যা বসগে, যা, গায়ে মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দিতে নেই বুঝি? ছেলে হয়ে স্বগগে ঘণ্টা দেবেন কি না?

অপু অপ্রতিভ মুখে বাবার শিয়রের পাশে বসে। কিন্তু খানিক বসিয়াই মনে ভাবে—ওঃ। কতক্ষণ বসে থাকবো।–বেশ তো? আমার বুঝি একটু বেড়াতে কি খেলা করতে নেই। কনকনে ঠাণ্ডায় পা অবশ হইয়া আসে। তাহার মন ছটফট করে-একদৌড়ে একেবারে সেই দশাশ্বমেধ ঘাট। জলের রানা, নির্মল মুক্ত হাওয়া, সুরেশ নবনারীর ভিড়। পটু, সুবীর…গুলু-পটল-পল্টুর দাদা। রামনগরের রাজার সেই ময়ুরপঙ্খীটায় আজ আবার বাচ, বেলা চারটার সময়! উসখুসি করিতে করিতে চক্ষুলজ্জায় সন্ধ্যা করিয়া ফেলে, মায়ের ভয়ে যাইতে সাহস পায় না।

সকালে সর্বজয়া একদিন ছেলেকে বলিল-হ্যারে, ওই সাদা বাড়িটার পাশে কোন ছত্তর জানিস?

–উঁহু–

–তুই ছত্তরে খাসনি একদিনও এখানে এসে? কাশীতে এসে ছত্তরে খেতে হয় কিন্তু, জানিসনে বুঝি! খেয়ে আসিস না আজ?…দেখেই আসিস না?

–কাশীতে এসে ছত্তরে খেতে হয় কেন?

—খেলে পুণ্য হয়—আজ দশাশ্বমেধ ঘাটে নেয়ে অমনি ছত্তর থেকে খেয়ে আসিস বুঝলি। বেলা বারোটার সময় সত্ৰ হইতে খাইয়া অপু বাড়ি ফিরিল। তাহার মা বান্নাঘবেব বাবান্দায বসিয়া বাটিতে কি লইয়া খাইতেছিল–তাহাকে দেখিয়া প্রথমটা লুকাইবার চেষ্টা করিলা বটে কিন্তু অপু অত্যন্ত কাছে আসিয়া পড়িয়াছে-লুকাইতে গেলে সন্দেহ জাগানো হয়। ভাবিয়া সহজ সুরে বলিবার চেষ্টা করিল-খেয়ে এলি? কেন খাওয়ালে রে?

মা অড়হরের ডাল-ভিজা খাইতেছে।

—ভালো না-কুমড়োর একটা ছাই ঘণ্ট-বসে বসে হয়রান—বড্ড ময়লা কাপড়-পরা লোক সব খেতে যায়-আমি আর যাচ্ছি নে, পুণ্যতে আমার দরকার নেই-ওকি খাচ্ছ মা? তোমার বের্তো নাকি? রান্না হয় নি?

–আজি তো আমার কুলুইচণ্ডী—এই দুটো অড়লের ডাল ভিজে-বেশ খেতে লাগে-আমি বড় ভালোবাসি… খাবি দুটো ওবেলা?

রাত্ৰিতেও রান্না হইল না। তাহার মা বলিল-আড়ালের ডাল ভিজে খেয়ে দ্যাখা দিকি? বেশ লাগবে এখন-এবেলা রাঁধলাম না, ভারি তো খাস, এত কটা ভাতে বসিস বই তো নয়- ওই খেয়ে কি আর খেতে পারবি?

পরদিন দুপুরে নন্দবাবু একতাড়া পান অপুর হাতে দিয়া বলিল-তোমার মার কাছ থেকে সেজে নিয়ে এসো তো? রোগীর ঘরের পাশের ঘরে সর্বজয়া বসিয়া পান সাজিতেছে। নন্দবাবু জুতার শব্দ করিতে করিতে উপর হইতে নামিয়া রোগীর ঘরে ঢুকিল এবং অতি অল্পক্ষণ পরেই সেখান হইতে বাহির হইয়া সর্বজয়া যে-ঘরে পান সাজিতেছে সেখানে ঢুকিল। সারারাত্রি জাগিয়া কাটাইয়া সর্বজয়ার ঝিামানি ধরিয়াছিল, জুতার শব্দে চমক ভাঙিলে একেবারে সম্মুখে নন্দবাবুকে দেখিয়া সে জড়সড় হইয়া ঘোমটা টানিয়া দিল। নন্দবাবু বলিল-পান সাজা হয়েচে বৌঠাকরুন? সর্বজয়া নীরবে সাজা পানের খিলিগুলি রেকরিতে করিয়া সামনে দিকে ঠেলিয়া দিতে নন্দবাবু এক খিলি তুলিয়া মুখের মধ্যে পুরিয়া বলিল-চুন বড় কম হয় বৌঠাকরুন তোমার পানে, সরো দেখি আমি নিচ্চি–

সর্বজয়ার কোলের কাছে পানের বাটা। বাড়িতে কেহ নাই, অপু কোথায় বাহির হইয়াছে। পাশের ঘরে হরিহর ঔষধের বশে ঘুমাইতেছে। নিস্তব্ধ দুপুর। হঠাৎ সর্বজয়ার মনে হইল যেন নন্দবাবু চুন লইবার অছিলায় অনাবশ্যকরূপে–তাহার অত্যন্ত কাছে ঘোষিয়া আসিতে চাহিতেছে-একটা অস্পষ্ট চিৎকার করিয়া এক লহমার মধ্যে সে উঠিয়া গিয়া ঘরের বাহিরে দাঁড়াইল! একটা বিদ্যুতের মতো কিসের স্রোত তাহার পা হইতে মাথা পর্যন্ত খেলিয়া গেল। আঙুল দিয়া সিঁড়ি দেখাইয়া তীব্রস্বরে বলিল-চলে যান। এখখনি ওপরে।–কখখনো আর নিচে আসবেন না-নিচে এলে আমি মাথা খুঁড়ে খুন হবো-কেন আপনি আসেন? খবরদার আর আসবেন না–

সর্বজয়া পড়িল মহা ফাপারে। বিদেশ জায়গা, এই রোগী ঘরে-নিঃসহায়, হাতে একটি পয়সা নাই, একটি পরিচিত লোক কোনো দিকে নাই, ছেলের বছর এগারো বয়স মোটে-তাও বুদ্ধিসুদ্ধি নাই, নিতান্ত নির্বোধ। এদিকে এই সব উৎপাত।

উপরের পাঞ্জাবী স্ত্রীলোকটি কালেভদ্রে নিচে নামে-এক আধা বার সর্বজয়াকে উপরে তাহার ঘরে লইয়া গিয়াছিল, কিন্তু পাঁচ-ছয় মাস কাশীতে আসিয়াও সর্বজয়া না পারে হিন্দি বলিতে, না পারে ভালো বুঝিতে, কাজেই আলাপ মোটেই জমে নাই। অদ্য তাহার কাছে গিয়া নন্দবাবুর ঘটনা আনুপূর্বিক বলিয়া কাঁদিয়া ফেলিল। পাঞ্জাবী মেয়েটির নাম সূরযকুঁয়ারী, স্বামী-স্ত্রী দুজনেই পাঞ্জাবের রোয়ালসার জেলার অধিবাসী; স্বামীটি রেলে ওভারসিয়ারের কাজ করে। মেয়েটির বয়স খুব অল্প না হইলেও দেখিতে কম বয়সি, গৌরাঙ্গী, আয়তনয়না, আঁটসাঁট দীর্ঘগড়ন। সে সব শুনিয়া বলিল– কোনো ভয় নাই, আপনি নিৰ্ভয়ে থাকুন, আবার যদি কিছু বদমায়েশির ভাব দেখেন আমায় বলবেন, আমার স্বামীকে দিয়া উহার নাক কাটিয়া ঠাণ্ডা করিয়া ছাড়িব।…

ঠিক দুপুর। কয়রাত্রি জাগিবার পর সর্বজয়া মেজেতে আঁচল পাতিয়া শুইয়া ঘুমাইয়া পড়িয়াছে। উত্তরের ঘরের জানোলা দিয়া একফালি রৌদ্র আসিয়া সবু উঠানটাতে বাঁকাভাবে পড়িয়াছে। অপু মাটির মালসাতে গাঁদাফুলের গাছ লাগাইয়াছিল, দু-তিনটা একপেটে গাদা নিতান্ত বিরক্তভাবে ফুটিয়া আছে।–তলায় একটা বিড়াল-ছানা বসিয়া। অপু বাবার বিছানার পাশেই বসিয়া ছিল। তাহার বাবা আজ সকাল হইতে একটু ভালো আছে—ডাক্তার বলিয়াছে বোধহয় জীবনের আশা হইল। ভালো থাকিলেও রোগীর খুব চৈতন্য আছে বলিয়া মনে হয় না, বেহুঁশ অবস্থা। তাহার বাবা হঠাৎ চোখ খুলিয়া তাহার দিকে খানিকটা চাহিয়া থাকিয়া কি বলিল। অপুর মনে হইল বাবা তাহাকে আরও কাছে সরিয়া যাইতে বলিতেছে। অপু সরিয়া যাইতে হরিহর রোগশীর্ণ ক্ষীণ দুই হাতে ছেলের গলা জড়াইয়া ধরিয়া নীরবে তাহার মুখের দিকে অনেকক্ষণ ধরিয়া একদৃষ্টি চাহিয়া রহিল। অপু একটু অবাক হইল, বাবার চোখের ওরকম দৃষ্টি কখনও সে দেখে নাই।

রাত্রি দশটার সময় নিদ্ৰিত অপুর কি শব্দে ঘুম ভাঙিয়া গেল। ঘরে ক্ষীণ আলো জ্বলিতেছে– মা অঘোরে ঘুমাইতেছে, বাবার গলার মধ্যে নানাসুরে যেন কি একটা শব্দ হইতেছে। তাহার কেমন ভয় ভয় ঠেকিল। বুঝলমাখানো কড়িকাঠ, স্যাঁতা মেঝে, হাড়ভাঙা শীত, কাঠকয়লার আগুনের ধোঁয়া–সব মিলিয়া যেন একটা কঠিন দুঃস্বপ্ন। বাবার অসুখ সারিলে যে বাঁচা যায়!

শেষ রাত্রে তাহার মায়ের ঠেলা পাইয়া তাহার ঘুম ভাঙিয়া গেল!–অপু, ও অপু ওঠ, শিগগির গিয়ে ওপরে থেকে হিন্দুস্তানী বৌকে ডেকে আনতো–

অপু উঠিয়া শুনিল বাবার গলার সেই শব্দটা আরও বাড়িয়াছে। উপর হইতে সূরযকুঁয়ারী আসিবার একটু পরেই রাত্রি চারটার সময় হরিহর মারা গেল।

মাঝ-বর্ষার ধারামুখর কুয়াশাচ্ছন্ন দিনে মনে হয় যে পৃথিবীর রৌদ্রদীপ্ত দিনগুলো স্বপ্ন না সত্য? এই মেঘ, এই দুর্দিন, অনন্ত ভবিষ্যতের পথে এরাই রহিল চিরসখী–দিগন্তের মায়ালীলার মতো চৈত্র-বৈশাখের যে দিনগুলা অতীতে মিলাইয়া গিয়াছে–আর কি তাহা ফিরিয়া আসে?

চারিধার হইতে সর্বজয়াকে কি এক কুয়াশায় ঘিরিয়া ফেলিল। তাহার মাধ্য দিয়া না দেখা যায় পথ, না চেনা যায় সাখী, না জানা যায় কোথায় আছি। সন্দেহ হয় এ কুয়াশা বোধ হয় বেলা হইলে রৌদ্র উঠিলেও কাটিবে না, এর পেছনে আছে আকাশ-ছাওয়া ফিকে ধূসর রং-এর সারাদিনব্যাপী অকাল বাদলের মেঘ।

বিপদের দিনে পাঞ্জাবী ওভারসিয়ার জালিম সিং ও তাহার স্ত্রী যথেষ্ট উপকার করিল। জালিম সিং অফিস কামাই করিয়া সৎকারের লোকের জন্য বাঙালিটোলায় ঘোরাঘুরি করিতে লাগিল। খবর পাইয়া রামকৃষ্ণ মিশনের কয়েকজন সেবকও আসিয়া পৌঁছিল।

মণিকর্ণিকার ঘাটে সৎকার অন্তে সন্ধ্যাবেলা অপু স্নান করিয়া ঠাণ্ড পশ্চিমে বাতাসে কাঁপিতে কাঁপিতে পৈঠার উপর উঠিল। রামকৃষ্ণ মিশনের একজন সেবক ও নন্দবাবু তাহাকে উত্তরীয় পরাইতেছিল। বেলা খুব পড়িয়া গিয়াছে, অস্ত-দিগন্তের স্নান আলো পাথরের মন্দিরগুলার আগাটুকুতে মাত্ৰ চিকচিক করিতেছে। সারাদিনের ব্যাপারে দিশেহারা অপুর মনে হইল। তাহার বাবার পরিচিত গলায় উৎসুক শ্রোতাগণের সম্মুখে কে যেন বসিয়া আবৃত্তি করিতেছে–

কালে বৰ্ষতু পর্জন্যং পৃথিবী শস্যশালিনী….

লোকাঃ সন্তু নিরাময়াঃ…

যে বাবাকে সকলে মিলিয়া আজি মণিকণিকার ঘাটে দাহ করিতে আনিয়াছিল, — রোগে, জীবনের যুদ্ধে পরাজিত সে বাবা স্বপ্ন মাত্র–অপু তাহাকে চেনে না, জানে না–তাহার চিরদিনের একান্ত নির্ভরতার পাত্র, সুপরিচিত, হাসিমুখ বাবা জ্ঞান হইয়া অবধি পরিচিত সহজ সূরে, সুকণ্ঠে, প্রতিদিনের মতো কোথায় বসিয়া যেন উদাস পূরবীর সুরে আশীর্বাচন গান করিতেছে–

175 Shares