পথের পাঁচালী

কালে বৰ্ষতু পর্জন্যং পৃথিবী শস্যশালিনী….

লোকাঃ সন্তু নিরাময়াঃ…

দ্বাত্রিংশ পরিচ্ছেদ

কোনোরূপে মাসখানেক কাটিল। এই একমাসের মধ্যে সর্বজয়া নানা উপায় চিন্তা করিয়াছে কিন্তু কোনোটাই সমীচীন মনে হয় না। দু-একবার দেশে ফিরিবার কথাও যে তাহার না মনে হইয়াছে এমন নয়, কিন্তু যখনই সে কথা মনে ওঠে, তখনই সে তাহা চাপিয়া যায়। প্রথমত তো দেশের এক ভিটাটুকু ছাড়া বাকি সব কতক দেনার দায়ে, কতক এমনি বেচিয়া কিনিয়া আসা হইয়াছে, জমিজমা কিছুই আর নাই। দ্বিতীয়ত সেখান হইতে বিদায় লইবার পূর্বে সে পথে-ঘাটে বৌ-বিদের সম্মুখে নিজেদের ভবিষ্যতের সুখের ছবি কতভাবে আঁকিয়া দেখাইয়াছে। নিশ্চিন্দিপুরের মাটি ছাড়িয়া যাওয়ার অপেক্ষা মাত্র, এ পোড়া মুখের দেশে তাহার স্বামীর কদর কেহ বুঝিল না, কিন্তু যেখানে যাইতেছে সেখানে যে তাঁহাকে সকলে লুফিয়া লইবে, অবস্থা ফিরিতে যে এক বৎসরও দেরি হইবে না-এ কথা হাতমুখ নাড়িয়া সর্বজয়া কতভাবে তাহদের বুঝাইয়াছে! এই তো চৈত্র মাস, এক বৎসর এখনও পূর্ণ হয় নাই। ইহারই মধ্যে এরূপ নিঃসম্বল দীন অবস্থায়, তাহার উপরে বিধবার বেশে সেখানে ফিরিয়া গিয়া সকলের সম্মুখে দাঁড়াইবার কথাটা ভাবিতেই সে লজ্জায় সংকোচে মাটিতে মিশিয়া যাইতেছিল। যাহা হইবার এখানেই হউক, ছেলের হাত ধরিয়া কাশীর পথে পথে ভিক্ষা করিয়া ছেলেকে মানুষ করিবে, কে দেখিতে আসিবে এখানে?

মাসখানেক পরে একটা সুবিধা হইল। কেদার ঘাটের এক ভদ্রলোক মিশনের অফিসে জানাইলেন যে তাঁহার পরিচিত এক ধনী পরিবারের জন্য একটি ব্রাহ্মাণের মেয়ে আবশ্যক, জগতের মেয়ে, ঘরে আসিবেন, কাজকর্মে সাহায্য করিবেন। মিশন এরূপ কোনো লোকের সন্ধান দিতে পারেন কি না? শেষ পর্যন্ত মিশনের যোগাযোগে ভদ্রলোকটি অপূদের সেখানে পাঠাইতে রাজি হইলেন। সর্বজয়া অকুল সমুদ্রে কুল পাইয়া গেল। দিন-দুই পরে সেই ভদ্রলোকটি বলিয়া পাঠাইলেন যে, বাসা একেবারে উঠাইয়া যাইবার জন্য যেন ইহারা প্ৰস্তুত হয়, কারণ সেই ধনী গৃহস্থদের বাটী লইয়া যাইবেন।

প্রকাণ্ড বড় হলদে বঙের বুড়িটা। কাশীতে যে রকম বড় বড় বাড়ি আছে, সেই ধরনের খুব বড় বাড়ি। সকলেব পিছনে পিছনে সর্বজয়া ছেলেকে লইয়া সংকুচিতভাবে বাড়ির ভিতর ঢুকিল।

অন্তঃপুরে পা দিতেই অভ্যর্থনার একটা রোল উঠিল–তাহার জন্য নহে-যে দলটি এইমাত্র কাশী হইতে বেড়াইয়া ফিরিল, তাহাদের জন্য।

ভিড় ও গোলমাল একটু কমিলে বাড়ির গিন্নি সর্বজয়ার সম্মুখে আসিলেন। খুব মোটাসোটা, এক সময়ে বেশ সুন্দরী ছিলেন বোঝা যায়, বয়স পঞ্চাশের উপর। গিন্নিকে প্ৰণাম করিতেই তিনি বলিলেন-থাক, থাক, এসো, এসো-আহা এই অল্প বয সেই এই–এটি ছেলে বুঝি? খাসা ছেলে–কি নাম?

আর একজন কে বলিলেন-বাড়ি বুঝি কাশীতেই? না?–তবে বুঝি—

সকলের কৌতূহল-দৃষ্টির সম্মুখে সর্বজয়া বড় লজ্জা ও অস্বস্তি বোধ করিতেছিল। গিন্নির হুকুমে যখন ঝি তাহার জন্য নির্দিষ্ট ঘরে তাহাকে লইয়া গেল, তখন সে হাঁপ ফেলিয়া বাঁচিল।…

পরদিন হইতে সর্বজয়া চুক্তিমতো রান্নার কাজে ভর্তি হইল। রাঁধুনী সে এক নয়, চার-পাঁচজন আছে। তিন-চারটা বান্নাঘর। আঁশ নিরামিষ, দুধের ঘর, রুটির ঘর, বাহিরের লোকদিগেব রান্নার আলাদা ঘর। ঝি-চাকরের সংখ্যা নাই। রান্নাবাড়িটা অন্তঃপুরের মধ্যে হইলেও একটু পৃথক। সেদিকটা যেন বি-চাকিব-বামুনের রাজত্ব। বাড়ির মেয়েরা কাজ বলিয়া ও বুঝাইয়া দিয়া যান মাত্র, বিশেষ কারণ না ঘটিলে রান্নাবাড়িতে বড় একটা থাকেন না।

সর্বজয়া কি রাঁধিবে একথা লইয়া আলোচনা হয়। সর্বজয়ার বরাবরই বিশ্বাস সে খুব ভালো রাঁধিতে পারে। সে বলিল, নিরামিষ তরকারি রান্নার ভার বরং তাহার উপর থাকুক। রাঁধুনী বামনী মোক্ষদা মুচকি হাসিয়া বলিল-বাবুদের রান্না তুমি করবে? তা হলেই তো চিত্তির। পরে পাচিবিকে ডাক দিয়া কহিল, শূনচিস, ও পাঁচি, কাশীর ইনি বলচেন নাকি বাবুদের তরকারি রাধবেন! কি নাম গো তোমার? ভুলে যাই-মোক্ষদার ওষ্ঠের কোণের ব্যঙ্গের হাসিতে, সর্বজয়া সেদিন সংকোচে অভিভূত হইয়া পড়িয়াছিল বটে, কিন্তু দু-একদিনেই সে বুঝিতে পারিল যে তাহার পাড়াগাঁয়ের কোনো তরকারি রান্না সেখানে খাটিবে না। ঝোলে যে এত চিনি মিশাইতে হয় বা বাঁধাকপি ফ্রিটার্স বলিয়া যে একটা তরকারি আছে, একথা সে এই প্রথম শুনিল।

গৃহিণী সর্বজয়াকে মাস দুই বেশ যত্ন করিয়াছিলেন। হালকা কাজ দেওয়া, খোঁজখবর নেওয়া। ক্রমে ক্রমে অন্য পাঁচজনের সমান হইয়া দাঁড়াইতে হইল। বেলা দুইটা পর্যন্ত কাজ করার পর প্রথম প্রথম সে বড় অবসন্ন হইয়া পড়ে, এভাবে অনবরত আগুনের তাতে থাকার অভ্যাস তাহার কোনো কালে নাই, অত বেলায় খাইবার প্রবৃত্তি বড় একটা থাকে না। অন্য অন্য রাঁধুনীরা নিজেদের জন্য আলাদা করিয়া মাছ তরকারি লুকাইয়া রাখে, কতক খায়, কতক বাহিরে কোথাও লইয়া যায়। সে পাতের কাছে একবার বসে মাত্র!

রান্নার বিরাট ব্যাপার দেখিয়া সর্বজয়া অবাক হইয়া যায়, এত বড় কাণ্ড-কারখানার ধারণা কোনো দিন স্বপ্নেও তাহার ছিল না, বিস্মিত হইয়া মনে মনে ভাবে, দু’বেলায় তিন সেরা করে তেলের খরচ? রোজ একটা যজ্ঞির তেল-ঘি এর খরচ!… পাড়াগায়ের গরিব ঘরের ছোট সংসারের অভিজ্ঞতা লইয়া সে এসব বুঝিয়া উঠিতে পারে না।

একদিন সবু চালের ভাত রান্নার বড় ডেকচিটা নামাইবার সময় মোক্ষদা বামনীকে ডাক দিয়া বলিল-ও মাসিমা, ডেকচিটা একটুখানি ধরবে?

মোক্ষদা শুনিয়াও শুনিল না।

এদিকে ভাত ধরিয়া যায় দেখিয়া নিজেই নামাইতে গিয়া ভারী ডেকচিটা কত করিযা ফেলিল, গরম ফেন পায়ের পাতায় পড়িয়া তখনই ফোস্কা পড়িয়া গেল। গৃহিণী সেই দিনই তাঁহাকে বুটির ঘরে বদলি করিয়া বলিয়া দিলেন, পা না। সারা পর্যন্ত তাহাকে কোনো কাজ করিতে হইবে না।

সর্বজয়া ছেলেকে লইয়া নিচের একটা ঘরে থাকে। ঘরটা পশ্চিমদিকের দালানের পাশেই। কিন্তু সেটা এত নিচু, আর মেঝে এত স্যাতসেঁতে এবং ঘরটাতে সব সময় এমন একটা গন্ধ বাহির হয় যে, কাশীর ঘরাও এর চেয়ে অনেক ভালো ছিল। দেয়ালের নিচের দিকটা নোনা-ধরা, বাঙা, রাঙা বড় বড় ছোপ, প্রতিবার বাহির হইতে ঢুকিয়াই অপু বলে-উঃ, কিসের গন্ধ দেখচোঁ মা, ঠিক যেন পুরোনো চালের কি কিসের গন্ধ বলো দিকি?…নিচের এ ঘরগুলা কর্তৃপক্ষ মনুষ্যবাসের উপযুক্ত করিয়া তৈয়ারি করেন নাই, সেইজন্যই এগুলিতে চাকর-বাকর রাঁধুনীরা থাকে।

উপরের দালানের সব ঘরগুলি অপু বাহির হইতে বেড়াইয়া বেড়াইয়া দেখিয়াছে, বড় বড় জানালা দরজা। জানালায় সব কাচ বসানো। ঘরে ঘরে গদি-আঁটা বড় বড় চেয়ার, ঝকঝকে টেবিল, যেন মুখ দেখা যায়, এত ঝকঝকি করে। অপুদের বাড়িতে যেমন কর্পোেটর পুরানো আসন ছিল, ওই রকম কিন্তু ওর চেয়েও ঢের ভালো, পুরু ও প্রায় নতুন-কার্পেট মেজেতে পাতা! দেওয়ালে আয়না টাঙানো, এত বড় বড় যে, অপুর সমস্ত চেহারাখানা তাহাতে দেখা যায়। সে মনে মনে ভাবে-এত বড় বড় কাচ পায় কোথায়? জুড়ে জুড়ে করেচে। বোধ হয়–

দোতলার বারান্দায় আর একটা বড় ঘর আছে–সেটা প্রায়ই বন্ধ থাকে, মাঝে মাঝে চাকরবাকরে আলো হাওয়া খাওয়াইবার জন্য খোলে। সেটার মধ্যে কি আছে জানিবার জন্য অপুর অদম্য কৌতূহল হয়। একদিন ঘরের দরজা খোলা দেখিয়া সে ঘরের মধ্যে ঢুকিয়াছিল। কি বড় বড় ছবি! পাথরের পুতুল! বড় বড় গদি-আঁটা চেয়ার-আয়না,-সে ঘুরিয়া বেড়াইয়া সব দেখিতেছে, এমন সময় ছটু খানসামা তাহাকে ঘরের মধ্যে দেখিতে পাইয়া বুখিয়া আসিয়া বলিল—কোন বা?… কাহে ইসমে ঘুসা?

হয়তো সেদিন সে মারই খাইত, কিন্তু বাড়ির একজন ঝি দালান দিয়া যাইতে যাইতে দেখিয়া বলিল-এই ছটু, ছেড়ে দাও, কিছু বোলো না-ওর মা এখানে থাকে-দেখচে দেখুক না–

সকলের খাওয়া-দাওয়া সারা হইলে সর্বজয়া বেলা আড়াইটার সময়ে নিজের ঘরটিতে আসিয়া খানিকটা শোয়। সারাদিনের মধ্যে এই সময়ের মধ্যে কেবল মায়ের সঙ্গে মন খুলিয়া কথা হয় বলিয়া মাঝে মাঝে অপু এসময়ে ঘরে আসে। তাহার মা তাহাকে একবার করিয়া দিনের মধ্যে চায়। এ বাড়িতে আসা পর্যন্ত অপু যেন দূরে চলিয়া গিয়াছে। সারাদিন খাটুনি আর খাটুনি-ছেলের সঙ্গ হইতে দূরে থাকিতে হয়। বহু রাত্রে কোজ সারিয়া আসিতে অপু ঘুমাইয়া পড়ে, কথা হয় না। এই দুপুবটার জন্য তার মন তৃষিত হইয়া থাকে।

দোরে পায়ের শব্দ হইল। সর্বজয়া বলিল-কে, অপু! আয়-দোর ঠেলিয়া বামনী মাসি ঘরে চুকিল। সর্বজয়া বলিল-আসুন, মাসিম বসুন। সঙ্গে সঙ্গে অপুও আসিল। বামনী মাসি বাবুদের সম্পর্কে আত্মীয়া। কাজেই তাঁহাকে খাতিব করিয়া বসাইল। বামনী মাসির মুখ ভারী-ভারী। খানিকক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া বলিল-দেখলে তো আজ কাণ্ডখানা বড়-বৌমার? বলি কি দোষটা, তুমি তো বরাবরই বুগির ঘরে ছিলে? মাছ, ঘি এনে চুপড়িতে করে রেখে গেল, আমি ভাবলাম বাঁধাকপিতে বুঝি-কি রকম অপমানটা দেখলে তো একবার? পোলোয়ার মাছ তো সে কথা বিকে দিয়ে বলে পাঠালে তো হত। সন্দু বিও কি কম বদমায়েশের ধাড়ি নাকি?.. গিন্নির পেয়ারের ঝি কিনা? মাটি মাড়িয়ে চলে না, ওপরে গিয়ে সাতখানা করে লাগায়। –ওই তো ছিরিকণ্ঠ ঠাকুরও ছিল—বলুক দিকি? গল্প করিতে করিতে বেলা যায়। মাসি বলে, যাই জলখাবারের ময়দা মাখি গো-চারটে বাজালো–

175 Shares