পথের পাঁচালী

মাসি চলিয়া গেলে অপু মায়ের কাছে ঘেঁষিয়া বসিল। তাহার মা আদর করিয়া চিবুকে হাত দিয়া বলিল—কোথায় থাকিস দুপুরে বলা তো?…

অপু হাসিয়া বলিল-ওপরের বৈঠকখানা ঘরে কলেব গান বাজাচে মা-শুনছিলাম–ওই বারান্দাটা থেকে–

সর্বজয়া খুশি হইল।

–হ্যাঁরে, তোর সঙেগ বাবুদের ছেলেদের ভাব-সাব হয় নি?…তোকে ডেকে বসায়?

–খু-উ-উব!…

অপু এটা মিথ্যা বলিল। তাহাকে ডাকিয়া কেহ বাসায় না। ওপরের বৈঠকখানাতে গ্রামোফোন বাজানোর শব্দ পাইলেই খানিকটা ইতস্তত করিয়া পরে ভয়ে ভয়ে উপরে উঠিয়া যায় ও বৈঠকখানার দোরের পাশে চুপ করিয়া দাঁড়াইয়া গান শোনে। প্রতি মুহুর্তেই তাহার ভয় হয় এইবার হয়তো উহারা তাহাকে বলিবে নিচে চলিয়া যাইতে। গান শেষ হইলে নিচে নামিবার সময় ভাবে– কেউ তো কিছু বক্‌লে না? কেন বক্‌বে? দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গান শুনি বাইরে, আমি তো বাবুদের ঘরের মধ্যে যাচ্ছি নে? এরা ভালো লোক খুব–

এ বাড়ির ছেলেদের সঙ্গেও তার মেলামেশা হইল না। তাহারা উহাকে আমলই দেয় নাই। সেদিন রমেন, টেবু, সমীর, সন্তু-ইহারা একটা চৌকা পিড়ির মতো তক্তা সামনে পাতিয়া কাঠের কালো কালো গুটি চলিয়া এক রকম খেলা খেলিতেছিল, নাম নাকি ক্যাবাম খেলা—সে খানিকটা দূরে দাঁড়াইয়া দাঁড়াইয়া খেলোটা দেখিতেছিল–তার চেয়ে বেগুনবিচি খেলা ঢের ভালো।

বৈশাখেব প্রথমে বড়বাবুর মেয়ের বিবাহ উপলক্ষে বাড়ি সরগরম হইয়া উঠিল। গয়া, মুঙ্গের, এলাহাবাদ, কলিকাতা, কাশী নানাস্থান হইতে কুটুম্ব-কুটুম্বিনীদের আগমন শুরু হইল। সকলেই বড়লোকের ঘরের মেয়ে ও বড়ঘরের বধূ, প্রত্যেকের সঙ্গে নিজেদের ঝি-চাকর আসিয়াছে নিচের তলার দালান-বারান্দা রাত্রে তাহারাই দখল করে। সারারাত্ৰি হৈ চৈ।

সকালে সর্বজয়াকে ডাকিয়া গিন্নি বলিলেন—ও অপূর্বের মা, তুমি এক কাজ করো, এখন দিন দুই রান্নাঘরের কাজ তোমার থাকুক, নানান জায়গা থেকে তত্ত্ব আসচে, তুমি আর ছোট মোক্ষদা সে সবগুলো গুছিয়ে তোমাদের বুটির ঘরের ভঁড়ারে তোলাপাড়া করো-মিষ্টি খাবার ওখানেই রেখো, ফল-ফুলুরি যা দেখবে পাঁচবার মতো, সদৃঝির হাতে পাঠিয়ে দেবে, নয়তো রেখে দিয়ো, জলখাবারের সময় নিয়ে আসলে বামনী মাসি–

সকাল হইতে সন্ধ্যা পর্যন্ত বিস্তু-বেহারাদের মাথায় কত জায়গা হইতে যে কত তত্ত্ব আসিতে লাগিল সর্বজয়া গুনিয়া সংখ্যা করিতে পারে না। মিষ্টান্নের জায়গা দিতে পারা যায় না, ছোট ছোট রূপার চন্দনের বাটি জমিয়া গেল পনেরো-ষোলটা। আমি এখনও উঠে নাই, তবুও একটা বড় ধামা আমে বোঝাই হইয়া গেল।

সর্বজয়া বামনী মাসির হাতে খাবার তুলিয়া দিতে দিতে ভাবে -এই এত ভালোমন্দ, এত কাণ্ড, তাই কি ছেলেটার জন্যে কিছু-আহা, বাছা আমার সরকারীদের খাবার ঘরের কোণটায় কাঁচুমাচু হয়ে বসে দুটো ভাত খাম, না দিতে পারি পাতে দুখানা ভালো দেখে মাছ, না একটু ভালো তরকারি, না এক হাত দুধ – তখখুনি ওই সদু হারামজাদী লাগবে নিজের ছেলের পাতে বাবুদের হেঁসেল থেকে সব–

বিবাহের দিন খুব ভিড়। বাবপক্ষ সকালের গাড়িতে আসিয়া পৌঁছিয়া শহরের অন্য এক বাড়িতে ছিল। সন্ধ্যার কিছু পূর্বে প্রকাণ্ড শোভাযাত্ৰা করিয়া বর আসিল।

বাহিরের উঠান নিমন্ত্রিতাদের দলে ভরিয়া গিয়াছে। সারা উঠানটাতে শতরঞ্চি পাতা, এক কোণে চওড়া জরিপাড় লাল মখমলে মোড়া উঁচু ববাসন, জুরির ঝালরী-দোলানো নীল সাটিনের চাদোষা, দুপাশে কিংখাবের তাকিয়া, বড় বড় বেলফুলেব মালা তিনগাছ করিয়া চাঁদোয়ার খিলানে খিলানে টাঙানো। চারিপাশে বরযাত্ৰীগণের চেয়ার ও কৌচ। বিলাতি সেন্ট ও গোলাপ জলের পিচকারি ঘন ঘন ছুটিতেছে।

অপু এ সমস্ত বিশেষ কিছু দেখে নাই, সে ঘুমাইয়া পড়িয়াছিল। একবার মাত্র সে বাড়ির মধ্যে গিয়াছিল, তখন স্ত্রী-আচার হইতেছে, রাত্রি অনেক! মাকে কোথাও খুঁজিয়া পাইল না, উৎসবের ভিড়ে কে জানে কোথায় কি কাজে ব্যস্ত আছে। দামি বেনারসী শাড়ি-পরা মেয়েদের ভিড়ে উঠানের কোথাও এতটুকু স্থান ফাঁকা নাই। ছোটবাবুর মেয়ে অরুণা কাহাকে ডাকিয়া বাহিরের বৈঠকখানা হইতে বড় অর্গানটা বাড়ির ভিতর আনিতে বলিতেছে।

বিবাহের দিন দুই পরে শখের থিয়েটার উপলক্ষে আবার খুব হৈ চৈ! উঠানের এক কোণে স্টেজ বাঁধা হইয়াছে। গোলাপফুলে ও আর্কিডে স্টেজটা খুব চমৎকার সাজানো! পাঁচশত ডালের প্ৰকাণ্ড ঝাড়টা স্টেজের মধ্যে খাটানো হইল। এ কয়দিনের ব্যাপারে তো একেই অপুর তাক লাগিয়াছে, আজকার থিয়েটার জিনিসটি কি সে আদৌ জানে না, আগ্রহ ও কৌতূহলের সহিত পূর্ব হইতেই ভালো জায়গাটি দখল করিয়া রাখিবার জন্য সে আসরের সামনের দিকে সন্ধ্যা হইতে বসিয়া রহিল।

ক্ৰমে ক্ৰমে একে একে নিমন্ত্রিত ভদ্রলোকেরা আসিতে লাগিলেন, চারিদিকে আলো জ্বলিয়া উঠিল। বাড়ির দারোয়ানেরা জরির উর্দি পরিয়া আসরের বাহিরে ও দরজার কাছে দাঁড়াইল। সরকার ইতস্তত দুটাছুটি করিয়া কাজ দেখাইতে লাগিল। কনসার্ট আরম্ভ হইল। যখন ড্রপসিন উঠিবার আর বেশি দেরি নাই, বাড়ির গোমস্ত গিরিশ সরকার তাহার কাছে আসিয়া নিচু হইয়া চাহিয়া দেখিয়া বলিল-কে? অপু মুখ উঁচু করিয়া চাহিয়া দেখিল কিন্তু মুখচোরা বলিয়া খানিকক্ষণ কথা কহিতে পারিল না। তাহাকে জবাব দিবার অবকাশ না দিয়াই গিরিশ সরকার বলিল-ওঠো, ওঠো, এখানে বাবুরা বসবেন-ওঠো-গিরিশ সরকার আন্দাজে তাহাকে চিনিতে পারিয়াছিল।

অপু পিছনে চাহিয়া বিপন্নমুখে নামতা পড়ার সুরে বলিল-আমি সন্দে থেকে এইখানটায় বসে আছি, পেছনে যে সব ভর্তি, কোথায় যাবো?…তাহার কথা শেষ হইতে না হইতে গিরিশ সরকার তাহার হাতের নড়া ধরিয়া জোরে ঝাঁকুনি দিয়া উঠাইয়া দিয়া বলিল—তোর না কিছু করেছে, জ্যাঠা ছোকরা কোথাকার, জ্ঞান নেই, একেবারে সামনে-বাবুরা বসবেন, উনি রাঁধুনীর ব্যাটা এসেছেন মুখের কাছে বসতে! কোথায় যাবো ওঁকে বলে দাও-ফাজিল জ্যাঠা কোথাকার-যা এখান থেকে যা, ওই থামটার কাছে বসগে, যা কোথাও–

পিছন হইতে দু’একজন কর্মকর্তা বলিলেন–কি হয়েচে, কি হয়েচে গিরিশ-কিসের গোল? কে ও?

-এই দেখুন না ম্যানেজারবাবু, এই জ্যাঠা ছোকরা বাবুদের এখানে এসে বসে আছে, একেবারে সামনে-চন্দননগরের ওঁরা এসেচেন, বসাবার জায়গা নেই।–উঠতে বলচি, আবার মুখোমুখি তর্ক!

ম্যানেজারবাবু বলিলেন–দাও না দুই থাপ্পড় বসিয়ে–

অপু জড়সড় হইয়া কোনো দিকে না চাহিয়া অভিভূতের মতো আসরের বাহির হইয়া আসিল। হঠাৎ তাহার মনে হইল আসরের সকলের চোখ তাহার দিকে, সকলেই কৌতূহলের সহিত তাহার দিকে চাহিয়া আছে! প্রথমটা ভাবিল হঠাৎ এক দৌড় দিয়া সে এখনই এক আসর লোকের চোখের আড়ালে যে কোনো জায়গায় ছুটিয়া পলায়। তাহার পর সে গিয়া এক থামের আড়ালে দাঁড়াইল। তাহার গা ঠকঠক করিয়া কাঁপিতেছিল ভয়ে; অপমানে, লজ্জায়, তাহার সূক্ষ্ম অনুভূতির পর্দাগুলিতে হঠাৎ বেখাপ্পা গোছের কাঁপুনি লাগিয়াছিল। একটু সামলাইয়া লইয়া থামের আড়াল হইতে উঁকি মারিয়া দেখিল. কিন্তু চারিধারে চাকর-বাকর, ওপরের বারান্দায় চিকের আড়ালে মেয়েরা, বিরাঁধুনীরা নিচের বারান্দায় দাঁড়াইয়া আছে-তাহারা তো সকলেই ব্যাপারটা দেখিয়াছে, কি মনে করিতেছে। উহারা! না জানিয়া কি কাণ্ডই করিয়া বসিয়াছে! সে তো জানে না। ওটা বাবুদের জায়গা! সে বার বার মনকে বুঝাইতে চেষ্টা করিল। তাহাকে সম্ভবত কেহ চিনিতে পারে নাই। কে না কে, কত তো বাইরের লোক আসিয়াছো-কে তাহকে চিনিয়াছে?

তাহার পর থিয়েটার আরম্ভ হইয়া গেল। সেদিকে তাহার লক্ষ্যই রহিল না। সম্মুখের এই লোকের ভিড়, বদ্ধ বায়ু, আলোর মেলা, দারোয়ান চাকরের হৈচৈ-কোনোদিকে তাহার খেয়াল রহিল না! ছটু খানসামা একটা রূপার হাঁসের পানদান লইয়া নিমন্ত্রিত ব্যক্তিদের সারিতে পান বিলি করিতেছিল-সেইটার দিকে চাহিয়া অপুর গা যেন কেমন করিয়া উঠিল। ওপরের ঘেরা বারান্দার দিকে চাহিয়া ভাবিল, ওদিকে মা নাই তো? যদি মা একথা জানিতে পারে? কিন্তু অপুর ভয় সম্পূর্ণ অমূলক, তাহার মা তখন সে অঞ্চলেও ছিল না, এসব কথা তাহার কানেও যায় নাই।

ত্রয়স্ত্রিংশ পরিচ্ছেদ

পরের বাড়ি নিতান্ত পরাধীন অবস্থায় চোরের মতো থাকা সর্বজয়ার জীবনে এই প্রথম। সুখে হৌক, দুঃখে হৌক, সে এতদিন এক ঘরের এক গৃহিণী ছিল। দরিদ্র সংসারের রাজরানী—সেখানে তাহার হুকুম এই এত বড় বাড়ির গৃহিণী, বৌ-রানীদের চেয়ে কম কার্যকরী ছিল না। এ যেন সর্বদা জুজু হইয়া থাকা, সর্বদা মন যোগাইয়া চলা, আর একজনের মুখের দিকে চাহিয়া পথ হাঁটা, পান থেকে চুন না খসে!-ছোেটর ছোট তস্য ছোট!”. এ তাহার অসহ্য হইয়া উঠিতেছিল। খাটিতে খাটিতে মুখে রক্ত ওঠে-কিন্তু এখানে খাটার মূল্য নাই। প্রাণপণে খাটো-কেহ নাম করিবার নাই। উহারা যখন দিবে তখন গর্বের সঙ্গে তাচ্ছিল্যের সঙ্গে ছুঁড়িয়া ফেলিয়া দিবে—তোমার খাটার মূল্য দিতেছে বলিয়া সমানে সমানে দিবে না। তোমাকে হাঁটু গাড়িয়া লইতে হইবেই।

175 Shares