পথের পাঁচালী

মাসিমা রুটির ঘরে আসিয়া চুপি চুপি বলিলেন-পয়সা রে বাপু, দেখলে তো পয়সার আদরটা? নিজেরই মস্ত জমিদারি, দুলাখ টাকা দান করেছেন, বাঙাল দেশের কোথাকার কলেজের জন্যে—পয়সারই আদর—আর এই তো আমিও আছি…ওদের তো আপনার লোক…গেরাজ্জি করে কেউ!

সর্বজয়ার কিন্তু সেদিকে মন ছিল না। এই মাত্র তাহার মনে পড়িয়াছে; অনেকটা এই রকম চেহারার ও এইরকম বয়সের–সেই তাহার বুড়ি ঠাকুরঝি ইন্দির ঠাকরুন, সেই ছেড়া কাপড় গেরো দিয়া পরা, ভাঙা পাথরে আমড়া ভাতে ভাত, তুচ্ছ একটা নোনাফলের জন্য কত অপমান, কেউ পোঁছে মা, কেউ মানে না, দুপুর বেলায়, সেই বাড়ি হইতে বিদায় করিয়া দেওয়া, পথে পড়িয়া সেই দীন মৃত্যু…

সর্বজয়ার অশ্রু বাধা মানিল না।

মানুষের অন্তর-বেদনা মৃত্যুর পরপারে পৌঁছায় কিনা সর্বজয়া জানে না, তবু সে আজ বার বার মনে মনে ক্ষমা চাহিয়া অপরিণত বয়সের অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত করিতে চাহিল।

চতুস্ত্রিংশ পরিচ্ছেদ

কয়েকদিন পরে অপু দালান দিয়া যাইতেছে, উপরের সিঁড়ি বাহিয়া মেজ বৌ-রানীর মেয়ে লীলা নামিতেছিল। তাহাকে দেখিতে পাইয়া বলিল–দাঁড়াও না? তোমার নাম কি-অপু না কি?

অপু বলিল-অপু বলে মা ডাকে–ভালো নাম শ্ৰীঅপূর্বকুমার রায়…

সে একটু অবাক হইল। এ বাড়ির ছেলেমেয়েরা কখনও ডাকিয়া তাহার সঙ্গে কথা কহে নাই। লীলা কাছে আসিয়া দাঁড়াইল। কি সুন্দর মুখ। রানুদি, অতসীদি, অমলাদি, সকলেই দেখিতে ভালো বটে। কিন্তু তখন সে তাহাদের চেয়ে ভালো কাহাকেও দেখে নাই। এ বাড়ি আসিয়া পর্যন্ত তাহার পূর্বেকার ধারণা একেবারে বদলাইয়া গিয়াছে। বিশেষ করিয়া মেজ বৌ-রানীর মতো সুন্দর কোনো মেয়ে কল্পনাও সে করে নাই। লীলাও মায়ের মতো সুন্দরী-সেদিন যখন লীলা মেয়ের মজলিশে হাসির কবিতা বলিতেছিল, তখন অপু একদৃষ্টি তাহার মুখের দিকে চাহিয়া ছিল, কবিতা সে ভালো শোনে নাই।

লীলা বলিল-তোমরা কতদিন এসেচ আমাদের বাড়ি? সেবার এসে তো দেখিনি?

-আমরা ফাল্লুন মাসে এইচি, এই ফাল্লুন মাসে–

–কোথেকে এসেচ তোমরা?

–কাশী থেকে। আমার বাবা সেইখানেই মারা গেলেন কিনা-তাই–

অপুর যেন বিশ্বাস হইতেছিল না। সারা ঘটনাটা এখনও যেন অবাস্তব, অসম্ভব ঠেকিতেছিল। লীলা, মেজ বৌ-রানীর মেয়ে লীলা তাহাকে ডাকিয়া যাচিয়া তাহার সঙ্গে কথা কহিতেছে! খুশিতে তাহার সারা গা কেমন করিতে লাগিল!

লীলা বলিল-চলো, আমার পড়ার ঘরে গিয়ে বসি, মাস্টার মশায়ের আসবার সময় হয়েচে—এসো–

অপু জিজ্ঞাসা করিল-আমি যাবো?

লীলা হাসিয়া বলিল-বারে, বলচি তো চলো, তুমি তো ভারি লাজুক?—এসো-তুমি দেখোনি আমার পড়ার ঘর? ওই পশ্চিমের দালানের কোণে?…

ঘর বেশি বড় নয়। কিন্তু বেশ সাজানো। একটি ছোট পাথরের টেবিলের দুপাশে দুখানা চামড়ার গদি-আঁটা চেয়ার পাতা। একখানা বড় ছবিওয়ালা ক্যালেন্ডার। সবুজ কাঁচকড়ার খোলে একটা ছোট টাইমপিস ঘড়ি। একটা বই রাখিবার ছোট দেরাজ। চার-পাঁচখানা বাঁধানো ফটোগ্রাফ এ দেওয়ালে, ও দেওয়ালে। লীলা একটা চামড়ার অ্যাটাশি কেস খুলিয়া বলিল—এই দ্যাখো আমার জলছবি, মাস্টার মশায় কিনে দিয়েছেন, ভাগ শিখলে আরও দেবেন, জলছবি ওঠাতে জানো?

অপু বলিল-তুমি ভাগ জানো না??

—তুমি জানো? ভাগ কষেচ?

অপু তাচ্ছিল্যের সহিত ঠোঁট উলটাইয়া বলিল-কবে!…

এই ভঙ্গিতে অপুর সুন্দর মুখখানি আরও ভারি সুন্দর দেখাইল।

লীলা হাসিয়া উঠিয়া বলিল-তুমি বেশ মজার কথা বলতে পারো তো? পরে সে অপুর ঠোঁটের নিচে হাত দিয়া বলিল-এটা কি? তিল? বেশ দেখায় তো তোমার মুখে, তিলে বেশ মানিয়েচে, তোমার বয়স কত? তেরো? আমার এগারো–তোমার চেয়ে দু’বছরের ছোট–

অপু বলিল-তুমি সেদিন মুখস্ত বলেছিলে, সেই একটা হাসির ছড়া, বেশ লেগেচে আমার–

–তুমি জানো কবিতা?

-জানি-বাবার একখানা বই আছে, তা থেকে শিখিচি—

–বলো দিকি?

লীলার গলার সুর কি মিষ্টি, এমন সুর সে কোনো মেয়ের এ পর্যন্ত শোনে নাই।

অপু ঘাড় দুলাইয়া বলিল–

যে জনের খড় পেতে খেজুর চেটায় ঘুমিয়ে কাল কাটে, ।

তাকে খাট-পালঙ্ক থাসা মশারি খাটিয়ে দিলে কি খাটে?

কথার শেষে সে জিজ্ঞাসার ভঙ্গিতে ঘাড় নাড়ে। বলিল-দাশু রায়ের পাঁচালীর ছড়া, আমার কাছে বই আছে–

লীলা হাসিয়া গড়াইয়া পড়ে আর কি। বলিল-তুমি ভারি মজার কথা জানো তো? এমন হাসাতে পারো তুমি!…

লীলার মুখের প্রশংসায় অপুর মনে আহ্লাদ ধরে না। সে উৎসাহের সুরে বলিল—আর একটা বলবো? আমি আরও জানি-পরে সে কড়িকাঠের দিকে চোখ তুলিয়া একটুখানি ভাবিয়া লইয়া পরে আবার ঘাড় দুলাইয়া আরম্ভ করে–

মুনির চিন্তা চিন্তামণি নাই অন্য আশা

নিষ্কৰ্মা লোকের চিন্তা তাস আর পাশা।

ধনীর চিন্তা ধন আর নিরেনব্বই এর ধাক্কা

যোগীর চিন্তা জগন্নাথ, ফকিরের চিন্তা মক্কা,

গৃহস্থের চিন্তা বজায় রাখতে চারি চালের ঠাট্‌টা,

শিশুর চিন্তা সদাই মাকে, পশুর চিন্তা পেট্‌টা।

এ ছড়ার সকল কথার অর্থ লীলা বুঝিতে পারিল না। কিন্তু আবার হাসিয়া গড়াইয়া পড়িবার জোগাড় করিল। বলিল, দাঁড়াও লিখে নেবো–

লীলা অ্যাটাশি কেসটা হইতে একটা কলম বাহির করিয়া বলিল-বলো দিকি?

অপু আবার বলিতে শুরু করিল। খানিকটা পরে একটু অবাক হইয়া বলিল-কালি নেওনি তো লিখচো কেমন করে?

লীলা বলিল—এ তো ফাউন্টেন পেন-কালি তো লাগে না, এর মধ্যে ভরা আছে-জানো না?

অপুর হাতে লীলা কলামটা তুলিয়া দিল। অপু উলটাইয়া-পালটাইয়া দেখিয়া বলিল-এ তো বেশ, কালিতে মোটে ডোবাতে হয় না!

–তা নয়, কালি ভরা থাকে, ভরে নিতে হয়-এই দ্যাখো, দেখিয়ে দি–

–বাঃ বেশ তো! দেখি একবারটি—

লীলা কলমটা অপুর হাতে দিয়া হাসিমুখে বলিল—তোমায় দিয়ে দিলাম একেবারে—

অপু অবাক হইয়া লীলার দিকে চাহিল। পরে লজ্জিতমুখে বলিল-না। আমি নেবো না—

লীলা বলিল—কেন?

–উঁহু—

–কেন?

–নাঃ!

লীলা একটু দুঃখিত হইল। বলিল-নাও না?…আমি আর একটা বাবার কাছ থেকে নেবো, নাও তুমি এটা, দেখি তোমার হাত? বাস!… আর ফেরত দিতে পারবে না।

ব্যাপারটা অপুর সম্পূর্ণ অবাস্তব ঠেকিল। সে বলিল—কিন্তু তোমায় যদি কেউ বকে?

লীলা বলিল-ফাউন্টেন পেন দেবার জন্যে? কেউ বকবে না, আমি মাকে বলবো অপূর্বকে দিয়ে দিলাম-বাবার কাছ থেকে আর একটা নেবো-বাবার ফটো দেখবো?…ওই ক্যালেন্ডারের পাশে টাঙানো-দাঁড়াও পাড়ি–

তাহার পর লীলা আরও দু’তিনখানি ফটো দেখাইল। আলমারি হইতে খানকতক বই বাহির করিয়া বলিল-মাস্টার মশায় কিনে দিয়েছেন—তুমি কোন স্কুলে পড়ো?

অপু কাশীতে সেই যা দিনকতক স্কুলে পড়িয়াছিল, আর ঘটে নাই। বলিল-কাশীতে পড়তাম এখন আর পড়ি না-কথাটা বলিতে সে সংকোচ বোধ করিতেছিল বলিয়াই শেষের কথাটা এমন সুরে বলিল, যেন না পড়িয়া খুব একটা বাহাদুরি করিতেছে। একখানা বইয়ে অনেক ছবি। অপু বলিল-বইখানা পড়তে দেবে একবারটি?

লীলা বলিল-নাও না? আমার আরও অনেক ছবির বই আছে, তিন বছরের বাধানো মুকুল আছে, মায়ের ঘরের আলমারিতে, এনে দেবো, পড়ো—

অপু বলিল–আমার কাছেও বই আছে, আনবো?

লীলা বলিল-চলো, তোমাদের ঘরে যাই—

লীলাকে নিজেদের ঘরে লইয়া যাইতে অপুর লজ্জা করিতে লাগিল। আসবাবপত্র কিছু নাই, ছেড়া বালিশের ওয়াড়, আলনায় গায়ে দেওয়ার কাঁথা। লীলা তবুও গেল। অপু নিজের টিনের বাক্সটা খুলিয়া একখানা কি বই হাসি-হাসি মুখে দেখাইয়া গর্বের সুরে বলিল-আমার লেখা, এই দ্যাখো, ছাপার অক্ষরে লেখা আছে আমার নাম–

লীলা তাড়াতাড়ি হাত হইতে লইয়া বলিল – দেখি দেখি?

সেই কাশীর স্কুলের ম্যাগাজিনখানা। হরিহর ছেলের গল্প ছাপানো দেখিয়া যাইতে পারে নাই, তাহার মৃত্যুর তিন দিন পরে কাগজ বাহির হয়। লীলা পড়িতে লাগিল, অপু তাহার পাশে বসিয়া উৎফুল্ল মুখে লীলার চোখের দৃষ্টি অনুসরণ করিয়া পঠিত লাইনগুলি নিজেও মনে মনে একবার করিয়া পড়িয়া যাইতেছিল। শেষ করিয়া লীলা প্রশংসমান চোখে অপুর মুখের দিকে খানিকটা চাহিয়া থাকিয়া বলিল-বেশ তো হয়েছে, আমি এখানা নিয়ে যাই, মাকে দেখাবো।–

অপুর ভারি লজ্জা হইল। বলিল-না—

লীলা শুনিল না। কাগজখানা হাতে করিয়া রাখিল। বলিল–নিশ্চিন্দিপুর লেখা আছে, নিশ্চিন্দিপুর কোথায়?

–নিশ্চিন্দিপুর যে আমাদের গাঁ-সেইখানেই তো আমাদের আসল বাড়ি – কাশীতে তো মোটে বছর খানেক হল আমরা–

এমন সময় ছোট মোক্ষদা দুয়ারের কাছে আসিয়া ঘরের মধ্যে মুখ বাড়াইয়া কহিল – -ওমা দিদিমণি, তুমি এখানে বসে? আমার পোড়ানি! ওদিকে মাস্টারবাবু বসে বসে হয়রান, আমি ওপর নিচে সব ঘর খুঁজে খুঁজে।–তা কে জানে তুমি এঁদো-পড়া কুঠুরিতে–এসো এসো–

লীলা বলিল—যা তুই, আমি যাচ্ছি, যা—

175 Shares