পথের পাঁচালী

ছোট মোক্ষদা বলিল–তা বসবার কি এই জায়গা নাকি? বলে আমাদেরই তাই মাথা ধরে–তাই কি ওই আস্তাবলের খোট্টা মিন্সেরা ঘোড়ার জায়গাগুলো ঝাঁট দেয়, না ধোয়? উহু-হু, কি গন্ধ আসছে দ্যাখো-এসো দিদিমণি, শিগগির–

লীলা বলিল—যাবে না। যাঃ, আমি আজ পড়বো না, যা বলগে যা—কে তোকে বলেছে এখানে বকবক করতে? যা মাকে বলগে যা–

ছোট মোক্ষদা থর্‌ থর্‌ করিয়া চলিয়া গেল। অপু বলিল–তোমার মা বকবেন না? কেন ওকে ওরকম বল্লে?

পরদিন দুপুরে সে নিজেব ঘরে ঘুমাইতেছিল। কাহার ঠেলায় ঘুম ভাঙিয়া চোখ চাহিয়াই দেখিল-লীলা হাসিমুখে বিছানার পাশে। সে মেঝেতে মাদুর পাতিয়া ঘুমাইতেছিল, লীলা হাঁটু গাড়িয়া বসিয়া তাহাকে ঠেলা মারিয়া উঠাইয়াছে, এখনও সেই ভাবেই কৌতুকপূৰ্ণ ডাগর চোখে তাহার দিকে চাহিয়া আছে। হাসিমুখে বলিল-বেশ তো, দুপুর বেলায় বুঝি এমন ঘুমোয়? আমি বা’র থেকে ডাক দিলাম, এসে দেখি খুব ঘুম–

অপু কোঁচার খুঁটে চোখ মুছিতে মুছিতে তাড়াতাড়ি উঠিয়া বসিল। বলিল-সকালবেলা পড়তে আসোনি? আমি তো পড়ার ঘর-টর সব খুঁজে দেখি কেউ কোথাও নেই–

লীলা অপুর স্কুলের সেই কাগজখানা অপুর হাতে দিয়া বলিল-মাকে পড়ে শোনালাম কাল রাত্রে, মা নিজেও পড়ে দেখলেন।

অপুর সারা গা খুশিতে কেমন করিয়া উঠিল। অত্যন্ত লজ্জা ও সংকোচ বোধ হইল। মেজ বৌ-রানী তাহার লেখা পড়িয়াছেন।

লীলা বলিল-এসো আমার পড়ার ঘরে, ‘সখা-সখী’ বাঁধানো এনে রেখেচি তোমার জন্যে–

অপু আলনার দিকে চাহিল। তাহারা ভালো কাপড়খানা এখনও শুকায় নাই, যেখানা পরিয়া আছে সেখানা পরিয়া বাহিরে যাওয়া যায় না। বলিল-এখন যাবো না–

লীলা বিস্ময়ের সুরে বলিল-কেন?

অপু ঠোঁট চাপিয়া সকৌতুক হাসিমুখে ঘাড় নাড়িল। সে জানে না তাহার মুখ কি অপূর্ব সুন্দর দেখায় এই ভঙ্গিতে।

লীলা মিনতির সুরে বলিল—এসো এসো–

অপু আবার মুখ টিপিয়া হাসিল।

-বাবা, কি একগুঁয়ে ছেলে যে তুমি! না বল্পে আর হ্যাঁ হবার জো নেই বুঝি? আচ্ছা দাঁড়াও, বইটা এখানে–

অপু হাসি চাপিতে না পারিয়া খিলখিল করিয়া হাসিয়া ফেলিল।

লীলা বলিল-অত হাসি কেন? কি হয়েছে বলো-না বলতেই হবে–বলো ঠিক–

অপু আলনার দিকে হাসি ভরা চোখের ইঙ্গিত করিল মাত্র, কিছু বলিল না।

এবার লীলা বুঝিল। আলনার কাছে গিয়া হাত দিয়া বলিল—একটুখানি শুকিয়েছে, তুমি বসো, আমি বইখানা আনি-ফাউন্টেন পেনে লিখচো? কেমন, বেশ ভালো লেখা হয় তো?

তাহার পর অনেকক্ষণ ধরিয়া লীলার আনা বই দুজনে দেখিল। বই মাদুরে পাতিয়া দুইজনে পাশাপাশি হাঁটু গাড়িয়া বসিয়া উপুড় হইয়া বই-এর উপর ঝুঁকিয়া বই দেখিতেছিল। লীলার রেশমের মতো চিকন নরম চুলগুলি অপুর খোলা গায়ে লাগিয়া যেন গা সির সির করে। হঠাৎ লীলা বই হইতে মুখ তুলিয়া বলিল—তুমি গান জানো?

অপু ঘাড় নাড়িল।

–তবে একটা গাও—

—তুমি জানো?

-একটু একটু, কেন বিয়ের দিন শোনোনি?

ছোট মোক্ষদা ঝি ঘরে উঁকি মারিয়া কহিল–এই যে দিদিমণি এখানে। আমিও মনে ভেবেচি তাই, উপরে নেই, পড়ার ঘরে নেই, তবে ঠিক-এসো দিকি, এই দুধ টুকু খেয়ে যাও, জুড়িয়ে গেলা-হাতে করে খুঁজে খুঁজে হয়রান—

রূপার ছোট গ্লাসে এক গ্লাস দুধ! লীলা বলিল-রেখে যা-এসে এর পর গ্লাস নিয়ে যাস–

ঝি চলিয়া গেল। আরও খানিকটা বইয়ের ছবি দেখা চলিল। এক ফাঁকে লীলা দুধের গ্লাস হাতে তুলিয়া বলিল-তুমি খেয়ে নাও আদ্ধেকটা–

অপু লজ্জিত সুরে বলিল-না।

–তোমাকে ভারি খোশামোদ কর্তে হয় সব তাতে-কেন ওরকম? আমাদের মুলতানী গরুর দুধ-খেয়ে নাও-ক্ষীরের মতো দুধ, লক্ষ্মী ছেলে–

অপু চোখ কুচকাইয়া বলিল-ইঃ লক্ষ্মী ছেলে? ভারি ইয়ে কি না? উনি আবার–

লীলা দুধের গ্লাস অপুর মুখে তুলিয়া দিয়া ঘাড় নাড়িয়া বলিল-আর লজ্জায় কোজ নেই–আমি চোখ বুজে আছি, নাও–

অপু এক চুমুকে খানিকটা দুধ খাইয়া-ফেলিয়া মুখ নামাইয়া লইল ও ঠোঁটের উপরের দুধের দাগ তাড়াতাড়ি কোঁচার খুঁটে মুছিতে মুছিতে হাসিয়া ফেলিল।

লীলা গ্লাসে চুমুক দিয়া বাকি দুধ টুকু শেষ করিল, পরে সেও খিলখিল করিয়া হাসিয়া উঠিল।

বেশ মিষ্টি দুধ, না?

–আমার এঁটো খেলে কেন? খেতে আছে পরের এঁটো?

-আমার ইচ্ছে-একটুখানি থামিয়া কহিল-তুমি বল্লে জলছবি তুলতে জানো, ছাই জানো, দাও তো আজ আমার ক’খানা জলছবি তুলে?

পঞ্চত্রিংশ পরিচ্ছেদ

জ্যৈষ্ঠ মাসের মাঝামাঝি সর্বজয়া চাহিয়া-চিন্তিয়া কোনো রকমে অপুর উপনয়নের ব্যবস্থা করিল। পরের বাড়ি, ঠাকুর-দালানের রোয়াকের কোণে ভয়ে ভয়ে কাজ সারিতে হইল। বাম্‌নী মাসি নাড়ু ভাজিতে সাহায্য করিল, দু’একজন রাঁধুনী-বামুনঠাকুরকে নিমন্ত্ৰণ করিয়া আসিল, বাহিরের সম্ভ্রান্ত লোকের মধ্যে বীবু গোমস্তা ও দীনু খাতাঞ্জি। উপনয়ন মিটিয়া যাওয়ার দিনকতক পরে অপু নিজের ঘরটিতে বসিয়া বসিয়া লীলার দেওয়া বাঁধানো ‘মুকুল’ পড়িতেছিল। খোলা দরজা দিয়া কে ঘরে ঢুকিল। অপু যেন নিজের চোখকে বিশ্বাস করিতেই পারিল না, তাহার পরই বলিয়া উঠিল-এ কি, বাঃ—কখন—

লীলা কৌতুক ও হাসিভরা চোখে দাঁড়াইয়া। অপু বলিল-বাঃ,  বেশ তো তুমি। বলে গেলে সোমবারে আসবো কলকাতা থেকে, কত সোমবার হয়ে গেল-ফিরবার নামও নেই–

লীলা হাসিয়া মেজেতে বসিয়া পড়িল। বলিল-আসবো কি করে? স্কুলে ভর্তি হয়েচি, বাবা দিয়েছেন ভর্তি করে, বাবার শরীর খারাপ, এখন আমরা কলকাতার বাড়িতেই থাকবো কি না? এখন ক’দিন ছুটি আছে তাই মার সঙ্গে এলাম-আবার বুধবার যাবো।

অপুর মুখ হইতে হাসি মিলাইয়া গেল। বলিল-থাকবে না। আর তোমরা এখানে?

লীলা বলিল-বাবার শরীর ভালো হলে আবার আসবো–

পরে সে হাসিমুখে বলিল-চোখ বুজে থাকো তো একটু?

অপু বলিল-কেন?

–থাকো না?

অপু চক্ষু বুজিল ও সঙ্গে সঙ্গে হাতে কি একটা ভারী জিনিসের স্পর্শ অনুভব করিল। চোখ খুলিতেই লীলা খিলখিল করিয়া হাসিয়া উঠিল। একটা কার্ড বোর্ডের বাক্স তাহার কোলের উপর। বাক্সটা খুলিয়া ফেলিয়া লীলা দেখাইল ভালো দেশী ধুতি চাদর ও রাঙা সিস্কের একটা পাঞ্জাবি। লীলা হাসিমুখে বলিল-মা দিয়েছেন।–কেমন হয়েচে? তোমার পৈতের জন্যে–

ধুতি-চাদর বিশেষ করিয়া পাঞ্জাবিটা দরের জিনিস, ব্যবহার করা দূরের কথা। এ বাড়িতে পা দিবার পূর্বে অপু চক্ষেও কখনও দেখে নাই।

লীলা অপুর মুখের দিকে চাহিয়া বলিল—এক মাসে তোমার মুখ বদলে গিয়েছে? আরও বড় দেখাচ্চে, দেখি নতুন বামুনের পৈতো?–তারপর কান বিঁধতে লাগলো না? আমার ছোট মামাতো ভাইয়েরও পৈতে হল কিনা, সে কেঁদে ফেলেছিল–

হঠাৎ অপু একখণ্ড ‘মুকুল’ দেখাইয়া বলিল-পড়েচো এ গল্পটা?

লীলা বলিল—কি দেখি?

অপু পড়িয়া শোনাইল। সমুদ্রের তলায় কোন স্থানে স্পেনদেশের এক ধনরত্নপূর্ণ জাহাজ দুই তিনশত বৎসর পূর্বে ড়ুবিয়া যায়-আজ পর্যন্ত অনেকে খোঁজ করিয়াছে, কেহ স্থানটা নির্ণয় করিতে পারে নাই। গল্পটা এইমাত্র পড়িয়া সে ভারি খুশি হইয়াছে।

বলিল-কেউ বার কর্তে পারেনি-কত টাকা আছে জানো? একক, দশক, শতক, সহস্ৰ, অযুত, লক্ষ-পঞ্চাশ লক্ষ পাউন্ডের সোনা-রুপো… এক পাউন্ডে তেরো টাকা-গুণ করো দিকি?* তাহার পরে সে তাড়াতাড়ি একটু কাগজে আঁকটা কষিয়া দেখাইয়া বলিল-এই দ্যাখো এত টাকা!…আগেও সে আঁকটা একবার কষিয়াছে। উজ্জ্বলমুখে বলিল-আমি বড় হলে যাবো-দেখবো গিয়ে-ঠিক বার করবো দেখো-কেউ সন্ধান পায়নি এখনও সেখেনে–

লীলা সন্দিগ্ধ হইয়া বলিল-তুমি যাবে? কোন জায়গায় আছে তুমি বার করবে কি করে?

-এই দ্যাখো লিখেচে ‘পোর্তে প্লাতার সন্নিহিত সমুদ্র গর্ভে’-খুঁজে বার করবো।….

সে গল্পটি পড়িয়াই ভাবিয়াছে, ভালেই হইয়াছে কেহ বাহির করিতে পারে নাই। সবাই সব বাহির করিয়া লইলে তাহার জন্য কি থাকিবে? সে বড় হইয়া। তবে কি তুলিবে? এখন সে যাওয়া পর্যন্ত থাকিলে হয়!…

লীলার বয়স কম হইলেও খুব বুদ্ধিমতী। ভাবিয়া ভাবিয়া বলিল-ওদের মতো জাহাজ পাবে কোথায়? তোমার একখানা আলাদা জাহাজ চাই-ওদের মতন–

-সে হয়ে যাবে, কিনবো, বড় হলে আমার টাকা হবে না বুঝি?

এবার বোধ হয় লীলার অনেকটা বিশ্বাস হইল। সে এ লইয়া আর কোনও তর্ক উঠাইল না।

খানিকটা পরে বলিল-তুমি কলকাতা গিয়েচ?

অপু ঘাড় নাড়িয়া বলিল-আমি দেখিনি কখখনো-খুব বড় শহর?—এর চেয়ে বড়?

লীলা হাসিয়া বলিল—ঢের ঢের–

–কাশীর চেয়েও বড়?

–কাশী আমি দেখিনি—

তারপর সে অপুকে নিজের পড়ার ঘরে লইয়া আসিল। একখানা খাতা দেখাইয়া বলিল–দ্যাখো তো কেমন ফুলগাছ এঁকেচি, কি রকম ড্রইংটা?

অপু খানিকটা পরে বলিল-আমি শুইগে, মাথাটা বড় ধরেচে—

লীলা বলিল-দাঁড়াও আমি একটা মন্তর জানি মাথা-ধরা সারাবার-দেখি? পরে সে দুহাতের আঙুল দিয়া কপাল এমনভাবে টিপিয়া দিতে লাগিল যে অপু হাসিয়া উঠিয়া বলিল-উঃ বড় সুড়সুড়ি লাগচে।

175 Shares