পথের পাঁচালী

লীলা হাসিয়া বলিল-আমার বড় মামাতো ভাইকে কুস্তি শেখায় একজন পালোয়ান আছে, তার কাছে শেখা-বেশ ভালো না? সেরেচে তো?

দিনকতক পরেই লীলারা পুনরায় কলিকাতায় চলিয়া গেল।

অপু মাকে বলিয়া কহিয়া একটা ছোট স্কুলে যায়। যে বড় রাস্তার ধারে ইঁহাদের বাড়ি, সেখান হইতে কিছুদূর গিয়া বঁ-ধারে ছোট গলির মধ্যে একতলা বাড়িতে স্কুল। জনপাঁচেক মাস্টার, ভাঙা বেঞ্চি, হাতল-ভাঙা চেয়ার, তেলকালি ওঠা ব্ল্যাকবোর্ড, পুরানো ম্যাপ খানকতক-ইহাই স্কুলের আসবাব। স্কুলের সামনেই খোলা ড্রেন, অপুদের ক্লাস হইতে জানালা দিয়া বাহিরে চাহিলে পাশের বাড়ির চুনবালির কাজ-বিরহিত নগ্ন ইটের দেওয়াল নজরে পড়ে। সে স্কুলে যাইতে যাইতে দেখে ধাঙড়ে ড্রেন সাফ করিতে করিতে চলিয়াছে, স্থানে স্থানে ময়লা জড়ো করা। সারাদিন স্কুলের মধ্যে কেমন একটা বদ্ধ বাতাসের গন্ধ, পাশের এক হিন্দুস্থানী ভুজাওয়ালা দুপুরের পর কয়লার আঁচ দেয়, কাঁচা কয়লার ধোঁয়ার মিষ্টি মিষ্টি গন্ধ বাহির হয়, অপুর মাথার মধ্যে কেমন করে, স্কুলের বাহিরে আসিয়া যেন সেটা কাটিতে চায় না।

তাহার ভালো লাগে না, মোটেই ভালো লাগে না, শহরের এই সব ইট-সিমেন্টের কাণ্ড-কারখানায় তাহার হাঁফ ধরে, কেমন যেন দম আটকাইয়া আসে। কিসের অভাবে প্ৰাণটা যেন আকুলি-বিকুলি করে, সে বুঝিতে পারে না কিসের অভাবে।

পথে ঘাস খুব কম, গাছপালা বেশি নাই, দু’একটা এখানে ওখানে। সুরকির পথ, পাকা ড্রেন, দুই বাড়ির মাঝখানের ফাঁকে আবর্জনা, ময়লা জল, ছেঁড়া কাপড়, কাগজ। একদিন সে এক সহপাঠীর সঙ্গে তাহদের বাড়িতে গিয়াছিল। একতলা খোলার ঘর। অপরিসর উঠানের চারিধারের ঘরগুলিতে এক-একঘর গৃহস্থ ভাড়াটে থাকে। দোরের গায়ে পুরানো চটের পর্দা। ঘরের মেঝে উঠান হইতে বিঘাতের বেশি উঁচু নয়, কাজেই আদ্রতা কাটে না। ঘরের মধ্যে আলো-হাওয়ার বালাই নাই। উঠান বিশ্ৰী নোংরা, সকল গৃহস্থই একসঙ্গে কয়লার আঁচ দিয়াছে, আবার সেই মিষ্টি মিষ্টি গন্ধটা। সবসুদ্ধ মিলিয়া অপুর অত্যন্ত খারাপ লাগে, মন যেন ছোট এতটুকু হইয়া যায়, সেদিন তাহারা উহাকে বসিতে বলিলেও সে বেশিক্ষণ থাকিতে পারে নাই, সদর রাস্তায় আসিয়া তবুও অনেকটা স্বস্তি বোধ করিয়াছিল।

বাড়ি ফিরিয়াও সেই বদ্ধতা। বরং যেন আরও বেশি। এখানে ইট-সিমেন্ট আর মার্বেল পাথরে চারিধার মায় উঠান পর্যন্ত বাঁধানো। অপু মাটি দেখিতে না পাইলে থাকিতে পারে না, এখানে যা মাটি আছে, তাও যেন অন্যরকম। যে মাটির সঙ্গে তার পরিচয় এ যেন সে মাটি নয়। তাহা ছাড়া ইহাদের বাড়ি চলিবার ফিরিবার স্বাধীনতা কই? থাকিতে হয় ভয়ে ভয়ে চোরের মতো। কে কি বলিবে, উঁচু গলায় কথা কওয়া যায় না, ভয় করে।

এক-একদিন অপু দপ্তরখানায় গিয়া দেখিয়াছে বুড়ো খাতাঞ্জি একটা লোহার সিক বসানো খাঁচার মতো ঘরে অন্ধকারের মধ্যে বসিয়া থাকে। অনেকগুলি খেরো বাঁধানো হিসাবের খাতা একদিকে স্তুপীকৃত করা। ছোট্ট কাঠের হাতবাক্স সামনে করিয়া বুড়া সারাদিন ঠায় একটা ময়লা চিট তাকিয়া হেলান দিয়া আছে। ঘরে এত অন্ধকার যে, দিনমানেও মাঝে মাঝে ছোট্ট একটা রেড়ির তেলের প্রদীপ জ্বলে। গিরিশ গোমস্ত জমা-সেরেস্তায় বসে। নিচু তক্তাপোশের উপর ময়লা চাদর পাতা-চারিধারে দু’কোণে কাপড়ে বাধা রাশি রাশি দপ্তর। সে ঘরটা খাতাঞ্জিখানার মতো অত অন্ধকার নয়, দু’তিনটি বড় বড় জানালাও আছে, কিন্তু তক্তপোশের নিচে রাশীকৃত তামাকের গুল ও ছেড়া কাগজ এবং কড়িকাঠে মাকড়সার জাল ও কেরোসিন আলোর ঝুল। যখন বীরু মুকুরি হ্যাঁকিয়া বলে-ওহে রামদায়াল, দেখো তো গত তৌজিতে বাদ্যকর খাতে কত খরচ লেখা আছে?… তখনই কি জানি কেন অপুর মনে দারুণ বিতৃষ্ণা আবার জাগিয়া উঠে।

সকালবেলা। অপু দেউড়ির কাছটায় আসিয়া দেখিল বাড়ির ছেলেরা চেয়ার-গাড়িটা ঠেলিয়া খেলিতেছে। গাড়িটা নূতন তৈয়ারি হইয়া আসিয়াছে, ডাণ্ডালাগানো লোহার চেয়ার, উপরে চামড়ার গদি, বড় বড় চাকা-ঝকঝকে দেখিতে। সে কাছে আসিয়া দাঁড়াইয়া দাঁড়াইয়া দেখিতেছে, রমেন বলিল-এই এসে ঠেল তো একবার আমাদের–

এই গাড়িটা আসা অবধি অপুর মনে মনে ইহার উপর লোভ আছে, খুশি হইয়া বলিল–ঠেলচি, আমায় একবার চড়তে দেবেন তো?

রমেন বলল-আচ্ছা হবে, ঠেল। তো-খুব জোরে দিবি—

খুব খানিকক্ষণ খেলা হইবার পর রমেন হঠাৎ বলিল-আচ্ছা খুব হয়েচে এবেলা-থায় আর নয়–

পরে গাড়ি লইয়া সকলে চলিয়া যাইতেছে দেখিয়া অপু বলিল-আমি এটু চড়বো না?

রমেন বলিল-আচ্ছা যা যা, এ কেলা আর চড়ে না, বেশি চড়লে আবার ভেঙে যাবে-দেখা যাবে ওবেলা–

ক্ষোভে অপুর চোখে জল আসিল। সে এতক্ষণ ধরিয়া আশায় আশায় ইহাদের সকলকে প্ৰাণপণে ঠেলিয়াছে।

বলিল-বা, আপনি যে বল্লেন আমাকে একবার চড়তে দেবেন আমার পালায়? আমি সকলকে ঠেললাম-বেশ তো! সেদিনও ওইরকমই চড়ালেন না শেষকালে–

রমেন বলিল-ঠেললি কেন তুই, না ঠেলিলেই পাত্তিস-যা-কে বলেচে তোকে চড়তে দেবে? গাড়ি কিনতে পয়সা লাগে না?

সে বলিল-কেন আপনিও বল্লেন, ওই সন্তুও তো বল্লে-ঠেলে ঠেলে আমার হাত গিয়েছে।–আর আমি বুঝি একবারটি-বেশ তো আপনি—

রমেন গরম হইয়া বলিল-আমি বলিনি। যা—

সন্তু বলিল-ফু-র্‌-র্‌-র্‌,-বক দেখেচ?

কোনও কিছু না, হঠাৎ বড়বাবুর ছেলে টেবু আসিয়া তাহার গলায় হাত দিয়া ঠেলিতে ঠেলিতে বলিল—যা যা—আমরা চড়াবো না আমাদের খুশি—তোর নিজের ঘরের দিকে যা–এদিকে আসিস কেন খেলতে?

টেবু অপুর অপেক্ষা বয়সে ছোট বলিয়া তাহার কৃত অপমানের দরুনই হউক বা সকলের ঠাট্টা বিদ্রুপের জন্যই হউক–অপুর মাথা কেমন বেঠিক হইয়া গেল-সে বাঁকুনি দিয়া ঘাড় ছিনাইয়া লইয়া টেবুকে এক ধাক্কা মারিতেই টেবু ঘুরিয়া গিয়া দেওয়ালের উপর পড়িয়া গেল-কপালটা দেওয়ালে লাগিয়া খানিকটা কাটিয়া রক্তপাত হইতে টেবু সঙ্গে সঙ্গে বিকট চিৎকার করিয়া কাঁদিয়া উঠিল।

ঝি-চাকর ছুটিয়া আসিল, খানসামা দারোয়ান ছুটিয়া আসিল—উপরের বৈঠকখানায় বড়বাবু সকালবেলা কাছারি করিতেছিলেন, তিনি সদলবলে নিচে নামিয়া আসিলেন। দশ দিক হইতে দশ ঘটি জল…বাতাস…জলপটি, হৈ হৈ কাণ্ড।

গোলমাল একটু কমিলে বড়বাবু বলিলেন–কই, কে মেরেচে দেখি?

রামনিহোরা সিং দারোয়ান পিছন হইতে ঠেলিয়া অপুকে বড়বাবুর সামনে দাঁড় করাইয়া দিল।

বড়বাবু বলিলেন—এ কে? ওই সেই কাশীর বামুনঠাকরুনের ছেলে না?

গিরিশ সরকার আগাইয়া আসিয়া বলিল-ভারি বদ ছোকরা—আবার জ্যাঠামি ওর যদি শোনেন বাবু, সেই সেবার থিয়েটারের দিন, বসেচে একেবারে সকলের মুখের সামনে বাবুদের জায়গায়, সরে বসতে বলেচি, মুখোমুখি তর্ক কি? সেদিন আবার দেখি ওই শেঠেদের বাড়ির মোড়ে রাস্তায় একটা লাল পাঞ্জাবি গায়ে দিয়ে বার্ডসাই খেতে খেতে আসচে–এই বয়সেই তৈরি–

বড়বাবু রমেনকে বলিলেন–সকলে আজ তোমাদের মাস্টার আসেনি? পড়াশুনো ছিল না? এই, আমার বেতের ছড়িটা নিয়ে এসো তো কেউ? ওর সঙ্গে মিশে খেলা কর্তে কে বলে দিয়েচে তোমাদের?

রমেন কঁদো কঁদো মুখে বলিল-ও-ই তো আমাদের খেলার সময় আসে, আমরা কেন যাবো, জিজ্ঞেস করুন, বরং সন্তুকে-আপনার সেই ছবিওয়ালা ইংরাজি ম্যাগাজিনগুলোর ছবি দেখতে চায়-আবার বড় বৈঠকখানায় ঢুকে এটা সেটা নেড়েচেড়ে দেখে–

গিরিশ সরকার বলিল-দেখুন, শখটা দেখুন আবার—

এবার অপুর পালা। বড়বাবু বলিলেন।–সরে এসে এদিকে-টেবুকে মেরেছ কেন?

ভয়ে অপুর প্রাণ ইতিপূর্বেই উড়িয়া গিয়াছিল, সে রাগের মাথায় ধাক্কা দিয়াছিল বটে। কিন্তু এত কাণ্ডের জন্য প্রস্তুত ছিল না। সে আড়ষ্ট জিহ্বা দ্বারা অতি কষ্টে উচ্চারণ করিল-টেবু আমাকে আগে তো—আমাকে–

বড়বাবু কথা শেষ করিতে না দিয়াই বলিলেন-টেবুর বয়স কত আর তোমার বয়স কত জানো?

গুছাইয়া বলিতে জানিলে অপুর পক্ষ হইতেও একথা বলা চলিত যে টেবুর বয়স কিছু কম হইলেও কার্যে সে অপুর জেঠামশাই নীলমণি রায় অপেক্ষাও পাকা। বলা চলিতে পারিত যে, টেবু ও এ-বাড়ির সব ছেলেই বিনা কারণে যখন তখন তাহাকে বাঙাল বলিয়া খোপায়, বক দেখায়, পিছন হইতে মাথায় ঠোকর মারে-সে না হয় একটু খেলা করিতে যায়। এই তো তাহার অপরাধ। কিন্তু উঠানভরা লোকারণ্যের কৌতূহলী দৃষ্টির সম্মুখে বিশেষ করিয়া বড়বাবুর সঙ্গে কথা কহিতে জিহ্বা তাহার তালুর সঙ্গে জুড়িয়া গিয়াছিল-সে শুধু বলিল-টেবুও-আমাকে-শুধু শুধু-আমাকে এসে–

বড়বাবু গর্জন করিয়া বলিলেন-স্টুপিড, ডেঁপো ছোকরা-কে তোমাকে বলে দিয়েচে এদিকে এসে ওদের সঙ্গে মিশতে-এই দাও তো বেতোটা-এগিয়ে এসো-এসো–

সপাং করিয়া এক ঘা সজোরে পিঠে পড়িবার সঙ্গে সঙ্গে সে কেমন বিস্ময়ের চোখে বড়বাবু ও তাঁহার পুনর্বার উদ্যত বেতের ছড়িটার দিকে চাহিল-জীবনে সে কখনও ইহার পূর্বে মার খায় নাই, বাবার কাছেও নয়।–তাহার বিভ্রান্ত মন যেন প্রথমটা প্রহার খাওয়ার সত্যটাকে গ্ৰহণ করিতে পারিতেছিল না-পরে সে কতকটা নিজের অজ্ঞাতসারেই বেতোটা ঠেকাইবার জন্য হাত দুখানা উঠাইল। কিন্তু এবার আর তাহার দুঃখ করিবার কিছু রহিল না যে, সে তাহার পালার বেলা ফাঁকে পড়িল। বেতের সপাসপ শব্দে টেবুকেও কপালের ব্যথা ভুলিয়া চাহিয়া দেখিতে হইল। রাঁধুনীর ছেলের যাহাতে স্পর্ধা আর না হয়, বড়বাবু এ বিষয়ে তাহাকে সুশিক্ষাই দিলেন। অন্য বেত হইলে ভাঙিয়া যাইত, এ বেতটা বোধ হয় খুব দামি।

175 Shares