পথের পাঁচালী

বড়বাবু হাঁপ জিরাইয়া লইয়া বলিলেন-বুড়ো ধাড়ি বয়াটে ছোকরা কোথাকার, আজ তোমাকে সাবধান করে দিচ্চি, ফের যদি শুনি এ বাড়ির কোনো ছেলের সঙ্গে মিশেচ, কান ধরে তক্ষুনি বাড়ি থেকে বিদেয করে দেবো-পরে কাহার দিকে চাহিয়া কহিলেন-দেখুন না ধীরেনবাবু, বিধবা মা, সতীশবাবু ম্যানেজার কাশী থেকে আনলেন, ভাবলাম জাতের মেয়ে থাকুক-দেখুন কাণ্ড, মা ভাত রাঁধে-উনি পাঞ্জাবি গায়ে দিয়ে সিগারেট খেয়ে বেড়ান–

ধীবেনবাবু বলিলেন-ওসব ওই রকমই হয়ে থাকে-এরপর কোকেন খাবে-মা’র বাক্স ভাঙবে-ওর নিয়মই ওই-তার ওপর আবার কাশীর ছেলে–

বাড়ির মধ্যে সব কথা গিয়া পৌঁছায় না, অপুর মার খাওয়ার কথা কিন্তু সর্বজয়া শুনিল। একটু ভালো করিয়াই শুনিল। গৃহিণী বলিলেন-ওরকম যদি গুণ্ডে ছেলে হয় তা হলে বাছা-ইত্যাদি।

রুটির ঘর হইতে আসিয়া দেখিল অপু স্কুলে গিয়াছে, মাকে কিছু বলে নাই, এসব কথা সে কখনও মাকে বলেও না। রাগে দুঃখে, ক্ষোভে সর্বজয়ার গা ঝিম ঝিম করিতে লাগিল, সর্বাঙ্গ হইতে যেন ঝাল বাহির হইতে থাকিল, ঘরে না থাকিতে পারিয়া সে বাহিরের অপরিসর বারান্দাটাতে আসিয়া দাঁড়াইল।

তাহার অপুর গায়ে হাত! সে যে এখনও বলে, মা সিঁড়ির ঘর দিয়ে যখন তুমি রান্নাবাড়ি থেকে আসবে তখন রাত্রে তোমায় একদিন এমন ভয় দেখাবো?…তাহার কি কোনো বুদ্ধি আছে? কত লাগিয়াছিল, কে তাহাকে বুঝিয়াছে সেখানে, কে শুনিয়াছে তাহার কান্না?

সর্বজয়ার বুক ফাটিয়া কান্না আসিল।….

অন্ধকার রাত, আকাশে দু’একটা তারা জ্বল জ্বল করে-আস্তাবলের মাথায় আমলকি গাছের ডালে বাতাস বাধে, দালানের কোণের লোহার ফুটা চৌবাচ্চার পাশে বসিয়া কথাটা ভাবিতে ভাবিতে কান্নার বেগে তাহার সর্বশরীর কাঁপিতে লাগিল–

-ঠাকুর, ঠাকুর, ও আমার বড় আদরের ধন, তুমি তো জানো ও একদণ্ড চোখের আড়াল থেকে সরলে আমি স্থির থাকতে পারি নে, যা কিছু শাস্তি দেবার আমার ওপর দিয়ে দাও, ঠাকুর ওকে কিছু বোলো না, আমার বুক ফেটে যায় ঠাকুর, তা আমি সইতে পারবো না—

সকাল সকাল অপুদের স্কুলের ছুটি হইয়া গেল। তাহার ক্লাসের ছেলেরা ধরিলে তাহদের ফুটবল খেলায় অপুকে রেফারি হইতে হইবে। অপু ভারি খুশি হইল, ফুটবল খেলা সে এ শহরে আসিবার পূর্বে কোনোদিন দেখে নাই, সে খুব ভালো খেলিতেও পারে না, তবুও কিন্তু ক্লাসের ছেলেরা তাহাকেই সকলের চেয়ে পছন্দ করে, খেলায় রেফারি হইতে প্রায়ই তাহার ডাক পড়ে।

সে বলিল-সেই বড় হুইসিলটা বাড়ি থেকে নিয়ে আসি ভাই, বাক্সে পড়ে রয়েচে, আমি ঠিক চারটের সময় মাঠে যাবো এখন–

পথে আসিতে আসিতে অপুর সকালের কথাটা মনে উঠিল। আজ সারা দিনটাই সে সে-কথা ভাবিয়াছে। বার্ডসাই খাইতে গিয়া সেদিন গিরিশ সরকারের সামনে পড়িয়া গিয়াছিল একথা ঠিক কিন্তু বার্ডসাই কি সে রোজ খায়? সেদিন মেজ বৌরানীর দেওয়া রাঙা পাঞ্জাবিটা গায়ে দিয়া স্কুল হইতে ফিরিবার-পথে তাহার হঠাৎ শখ হইয়াছিল, এই রকম পাঞ্জাবি গায়ে দিয়া বাবুরা বার্ডসাই খায়, সেও একবার খাইবে। তাই খাবারের পয়সাটায় বার্ডসাই কিনিয়া সে ধরাইয়া খাইতেছিল, কিন্তু সেই একদিন নিশ্চিন্দিপুরে লুকাইয়া খাইতে গিয়াও ভালো লাগে নাই, সেদিনও লাগিল না। তাহার মনে হইয়াছিল-দূর! এ না কিনে এক পয়সার ছোলাভাজা কিনলে বেশ হত! এ যে কেন লোকে কিনে খায়, কিন্তু গিরিশ সরকার না জানিয়া-শুনিয়া তাহাকে যা-তা বলিল কেন?

ভাগ্যিস লীলা এখানে নাই। থাকিলে সে দেখিলে বড় লজ্জার কথা হইত। মাও বোধ হয় টের পায় নাই। পাছে মা টের পায় এই জন্যই তো সে ওবেলা তাড়াতাড়ি স্কুলে চলিয়া আসিয়াছিল!

লীলা কতদিন এখানে আসে নাই! সেই আর বছর গিয়াছে আর আসে নাই। এখন আসিলেই কি আর উহারা তাহার সহিত কথা কহিতে দিবে?

বাড়ি ফিরিতেই দেউড়ির কাছটায় আসিয়া শুনিল উপরের বৈঠকখানায় কলের গান হইতেছে। শব্দটা কানে যাইতেই সে খুশি-ভরা উৎসুক চোখে মুখ উঁচু করিয়া দোতলার জানলার নিচে রাস্তার উপর দাঁড়াইয়া গেল। রাস্তা হইতে গানের কথা সব ভালো বোঝা যায় না। কিন্তু সুরটি ভারি চমৎকার, শুনিতে শুনিতে-স্কুল, খেলা, রেফারিগিরি, ওবেলা মারা-খাওয়া, মন হইতে সব একেবারে মুছিয়া গেল।

গানের সুরে তাহার মনটা আপনা-আপনি কোথায় উড়িয়া যায়-সেই তখন তখন নিশ্চিন্দিপুরের নদীর ধারে বেড়াইতে গিয়া কতদিন দেখিত, ওপারে উলুখড়েব মাঠে ছোট রাঙা ফুলে-ভরা শিমুল চারা, তাহাদের পিছনে কত দূরে নীল আকাশের পট-খড়ের মাঠ যেন আঁকা, রাঙা-ফুল শিমুলচারা যেন আঁকা, শুকনো ডালে কি পাখি বসিয়া থাকিত-সব যেন আঁকা। তাঁহাদের সকলের পিছনে সেই দেশটা, ব-হু-উ-দূরের দেশটা-কোন দেশ তাহার জানা নাই, মাত্র মনের খুশিতে সেটা ধরা দিত।

কে যেন ডাকে, কতদূর হইতে উচ্ছ্বসিত আনন্দভরা পরিচিত সুরের ডাক আসে-অপু-উ-উ-উ-উー

মন খুশিতে ভরিয়া উঠিয়া সাড়া দেয়-যা—আ-আ-ই-ই-ই-

তাহদের ছোট ঘরটাতে ফিরিতে তাহার মা জিজ্ঞাসা করিল–সকাল সকাল এলি যে?

সে বলিল-ওপর ক্লাসের ছেলেরা বল খেলায় জিতেছে তাই হাফ স্কুল—

তাহার মা বলিল-আয় বোস এখানে। খানিকক্ষণ পরে গায়ে হাত বুলাইতে বুলাইতে একটু ইতস্তত করিয়া বলিল-আজ তোকে ওরা কি জন্যে নাকি ডেকে নিয়ে গিয়ে নাকি-বকেচে?

–নাঃ, ওই টেবুর একটুখানি লেগেচে। তাই বড় বাবু ডেকে বলছিলেন কি হয়েচে-তাই-

-বকে-টকে নি তো?

–নাঃ–

তাহার মা খানিকক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া বলিল-একটা কথা ভাবচি, এখান থেকে চলে যাবি?

সে আশ্চর্য হইয়া মায়ের মুখের দিকে চাহিল। পরে হঠাৎ খুশি হইয়া বলিয়া উঠিল–কোথায়

মা, নিশ্চিন্দিপুর? সেই বেশ তো, চলো, আমি সেখানে ঠাকুর-পূজো করবো-পৈতেটা তো হয়ে গিয়েচে-নিজেদের দেশ, বেশ হবে-এখানে আর থাকবো না–

সর্বজয়া বলিল-সে কথাও তো ভাবচি আজি দু’বছর। সেখানে যাবি বলচিস, কি আর আছে বল দিকি সেখানে? এক বাড়িখানা, তাও আজ তিন বছর বর্ষার জল পাচ্চে, তার কিছু কি আছে অ্যাদ্দিন? মান্ধাতার আমলের পুরোনো বাড়ি-ছিল একটু ধানের জমি, তাও তো-গিয়ে মাথা গোঁজবার জায়গাটুকু নেই-শত্তুর হাসাতে যাওয়া… খানিকক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া বলিল—একটা কাজ কল্লে হয়, চল বরং-আচ্ছা কাশী যাবি?

বিশেষ কিছু ঠিক হইল না। তাহার মায়ের তখনও খাওয়া হয় নাই। স্নান সারিয়া পুনরায় রান্নাবাড়ি চলিয়া গেল। অপুর একটা কথা মনে হইল। তাহার গানের গলা আছে, দিদি বলিত, যাত্ৰাদলের বন্ধুও সেবার বলিয়াছিল। সে যদি কোনো যাত্ৰাদলে যায়, তাহাকে নেয় না? এখানে মা’র বড় কষ্ট। এখান হইতে সে মাকে লইয়া যাইবে!

উঃ কি গরম! রান্নাবাড়ির নলের মুখে ধোঁয়া কুণ্ডলী পাকাইয়া উঠিতেছে, কার্নিসের গায়ে রোদ, ঘরের ভিতরটা এরই মধ্যে অন্ধকার, আস্তাবলে মাতাবিয়া সহিস কি হিন্দি বুলি বলিতেছে. পাথর-বাঁধানো মেজেতে ঘোড়ার খুর ঠুকিবার খট্‌ খট্‌ আওয়াজ, ড্রেনের সেই গন্ধ… তাহার মাথাটা এমন ধরিয়াছে যেন ছিঁড়িয়া পড়িতেছে। সে ভাবিল … এখন একটু শুয়ে নিই, এরপর উঠে খেলার মাঠে যাবো–মোটে তিনটে বেজেছে-এখন বড় রোদটা।

বিছানায় শুইয়া একটা কথাই বার বার তাহার মনে আসিতে লাগিল। এ কথাটা এতদিন এভাবে সে ভাবিয়া দেখে নাই। এতদিন যেন তাহার মনের কোন কোণে সব সময়ই স্পষ্টভাবে জাগিয়া থাকিত যে, এ সবের শেষে যেন তাহদের গ্রাম অপেক্ষা করিয়া আছে–তাহদের জন্য! যদিও সেখান হইতে চলিয়া আসিবার সময় ফিরিবার কোনো কথাই ছিল না-সে জানে, তবুও এ মোহটুকু তার একেবারে কাটে নাই।

কিন্তু আজকার সমুদয় ব্যাপারে বিশেষ করিয়া মাযেব ও বড়বাবুব কথায় তাহাদের নিরাশ্রয়তা ও গৃহহীনতার দিকটা তাহার কাছে বেশ স্পষ্ট হইয়া উঠিল। আর কি কখনও সে তাহাদের গায়ে ফিরিতে পাইবে না?–কখনও না?–কখনও না?

এই বিদেশ, এই গিরিশ সরকার, এই চোর হইয়া থাকা-না হয় মায়ে ছেলে হাত ধরিয়া ছন্নছাড়া পথে পথে চিরকাল-এরাই কি কায়েম হইতে আসিয়াছে?

আস্তাবলে দুই সহিসে বাগড়া বাধাইয়াছে, রান্নাবাড়ির ছাদে কাকের দল ভাতের লোভে দলে দলে জুটিতেছে-একটু পরে তাহার মনে হইল, একই কি কথা অনেকক্ষণ ধরিয়া ভাবিতেছে, একই কি কথা। আস্তাবলে ঘোড়ার খুরের আওয়াজ থামে নাই.. সে যেন মাটির ভিতর কোথায় সেঁধিয়া যাইতেছে… খুব, খুব মাটির ভিতর. নিচের দিকে কে যেন টানিতেছে… বেশ আরাম…মাথা ধরা নাই, বেশ আরাম…

উঃ—কি রোদটাই ঝাঁ-ঝাঁ করিতেছে! দিদির যা কাণ্ড—এত রোদ্দুরে চড়ুইভাতি! সে বলিতেছে—দিদি শুয়ে নে, এত রোদ্দুরে চড়ুইভাতি?

রানুদি কানের কাছে বসিয়া কি সব কথা, অনেক কি সব কথা বলিয়া যাইতেছে। রানুদির ছলছল ডাগর চোখ দুটি অভিমান-ভরা! সে কি করিবে? নিশ্চিন্দিপুরে তাদের চলে না যে? রানুদি না লীলা?

175 Shares