পথের পাঁচালী

হারান কাকা বাঁশের বাঁশি বেচিবার জন্য আনিয়া বাজাইতেছে…ভারি চমৎকার বাজায়! সে বাবাকে বলিল—এক পয়সার বাঁশের বাঁশি কিনবো বাবা, একটা পয়সা দেবে?…

তাহার বাবা তাহার বড় বড় চুল কানের পাশে তুলিয়া দিতে দিতে আদর করিয়া বলিতেছে–বেশ হয়েচে তোর গল্পটা, ছাপিয়ে এলে আমায় দেখতে দিস খোকা?

সে বলিতেছে-কোকেন কি বাবা? গিরিশ সরকার বলেচে। আমি নাকি কোকেন খাবো—

বাবার গলায় পদ্মবীজের মালা। সেই কথকঠাকুরের মতো।

তাহদের মাঝেরপাড়ার ইস্টিশন। কাঠের বড় তক্তাটায় লেখা আছে, মা-ঝে-র-পা-ড়া। সে আগে আগে ভারী বোঁচকাটা পিঠে, মা পিছনে পিছনে। তাহার গায়ে রাঙা পাঞ্জাবিটা। কেমন ছায়া সারাপথে। আকাশে সন্ধ্যাতারা উঠিয়াছে। পাকা বটফলের গন্ধে-ভরা বাতাসটা।

নিশ্চিন্দিপুরের পথ যেন ফুরাইতেছে না…সে চলিয়াছে…চলিয়াছে..চলিয়াছে…সে আর মা…এ পথে একা কখনও আসে নাই, পথ সে চিনিতে পারিতেছে না…ও কাস্তে হাতে কাকা, শুনচো, নিশ্চিন্দিপুরের পথটা এটু বলে দ্যাও না আমাদের? যশড়া-নিশ্চিন্দিপুর, বেত্ৰবতীর ওপারে?

তাহার মা ঘরে ঢুকিয়া বলিল-হ্যাঁরে ওঠ, ও অপু, বেলা যে আর নেই, বললি যে কোথায় খেলতে যাবি?-ওঠ-ওঠ।

সে মায়ের ডাকে ধড়মড় করিয়া বিছানার উপর উঠিয়া বসিয়া চারিদিকে চাহিল-উঃ কি বেলাই গিয়াছো… রোদ একেবারে কোথায় উঠিয়া গিয়াছে? তাহার মা বলিল-বললি যে কোথায় খেলতে যাবি, তা গেলি কই? অবেলায় পড়ে পড়ে কি ঘুমটাই দিলি? দেবো তোর সেই বাঁশিটা বের করে?

তোরঙ্গ হইতে বাহির করিয়া বাঁশিটিা মা বিছানার কোণে রাখিয়া দিল বটে, সে কিন্তু রেফারিগিরি করিতে যাওয়ার কোনো উৎসাহ দেখাইল না। ঘরের ভিতর এরই মধ্যে অন্ধকার! উঠিয়া আসিয়া জানালার কাছে অন্যমনস্কভাবে চুপ করিয়া দাঁড়াইয়া বাহিরের দিকে চাহিয়া রহিল। বেলা একেবারে নাই। এক অসহ্য গুমোট! আস্তাবলের ড্রেনের গন্ধটা যেন আরও বাড়িয়াছে। ফটকের পেটাঘাঁড়িতে ঠং ঠাং করিয়া বোধ হয় ছটা বাজাইতেছে।

ওই আস্তাবলের মাথাব্য যে আকাশটা, ওরই ওপারে পূর্বদিকে বহুদূরে তাঁহাদের নিশ্চিন্দিপুর।

আজ কতদিন সে নিশ্চিন্দিপুর দেখে নাই-তি-ন বৎসর! কতকাল!

সে জানে নিশ্চিন্দিপুর তাহাকে দিন রাতে সব সময় ডাকে, শাঁখারিপুকুর ডাক দেয়, বাঁশবনটা ডাক দেয়, সোনাডাঙার মাঠ ডাক দেয়, কদমতলার সায়েবের ঘাট ডাক দেয়, দেবী বিশালাক্ষী ডাক দেয়।

পোড়ো ভিটার মিষ্ট লেবু ফুলের গন্ধে সজনেতলার ছায়ায় ছায়ায় আবার কবে গতিবিধি? আবার কবে তাহদের বাড়ির ধারের শিরীষ সৌদালি বনে পাখির ডাক?

এতদিনে তাহদের সেখানে ইছামতীতে বর্ষার ঢল নামিয়াছে। ঘাটের পথে শিমুল তলায় জল উঠিয়াছে। ঝোপে ঝোপে নাটা-কাঁটা, বনকলমির ফুল ধরিয়াছে। বন অপরাজিতার নীল ফুলে বনের মাথা ছাওয়া।

তাহাদের গ্রামের ঘাটটাতে কুঁচ-ঝোপের পাশে রাজুকাকা হয়তো এতক্ষণে তাহার অভ্যাসমতো

মাছ ধরিবার দোয়াড়ি পাতিয়াছে, আজ সেখানকার হাট-বার, ঠাকুরঝি-পুকুরের সেই বটগাছটার পিছনে দিগন্তের কোলে রাঙা আগুনে, এফনার মতো সূর্য অস্ত যাইতেছে, আর তাহারই তলাকার মেঠোপথ বাহিয়া গ্রামের ছেলে পটু, নীলু, তিনু, ভোলা সব হাট করিয়া ফিরিতেছে।

এতক্ষণে তাদের বনে-ঘেরা বাড়িটার উঠানটাতে ঘন ছায়া পড়িয়া আসিতেছে, কিচ্‌ কিচ্‌ করিয়া পাখি ডাকিতেছে, সেই মিষ্ট নিঃশব্দ শান্ত বৈকাল-সেই হলদে পাখিটা আজও আসিয়া পাচিলের উপরের কঞ্চির ডালটাতে সেই রকমই বসে, মায়ের হাতে পোতা লেবুচারাটাতে হয়তো এতদিনে লেবু ফলিতেছে।.

আরও কিছুক্ষণ পরে তাহাদের সে ভিটায় সন্ধ্যার অন্ধকার হইয়া যাইবে, কিন্তু সে সন্ধ্যায় সেখানে কেহ সঁজ জ্বলিবে না, প্ৰদীপ দেখাইবে না, রূপকথা বলিবে না। জনহীন ভিটার উঠানভরা কালমেঘের জঙ্গলে বিঝি পোকা ডাকিবে, গভীর রাত্রে পিছনের ঘন বনে জগড়ুমুর গাছে লক্ষ্মীপেচার রব শোনা যাইবে…কেহ কোনোদিন সেদিক মাড়াইবে না, গভীর জঙ্গলে চাপা-পড়া মায়ের সে লেবুগাছটার সন্ধান কেহ কোনোদিন জানিবে না, ওড়া-কলমির ফুল ফুটিয়া আপনাআপনি ঝরিয়া পড়িবে, কুল নোনা মিথ্যাই পাকিবে, হলদে।-ডানা তেড়ো পাখিটা কাঁদিয়া কাঁদিয়া ফিরিবে।

বনের ধারে সে অপূর্ব মায়াময় বৈকালগুলি মিছামিছিই নামিবে চিরদিন।

ওবেলা এক উঠান লোকের সম্মুখে বিনাবিচারে মারা খাইয়াও তাহার চোখ দিয়া এক ফেঁটা জল বাহির হয় নাই, কিন্তু এখন নির্জন ঘরের জানালোটাতে এক-একা দাঁড়াইয়া হঠাৎ সে কাঁদিয়া আকুল হইল, উচ্ছ্বসিত চোখের জল ঝর-ঝর করিয়া পড়িয়া তাহার সুন্দর কপোল ভাসাঁইয়া দিতেই চোখ মুছিতে হাত উঠাইয়া আকুল সুরে মনে মনে বলিল-আমাদের যেন নিশ্চিন্দিপুর ফেরা হয়ভগবান-তুমি এই কোরো, ঠিক যেন নিশ্চিন্দিপুর যাওয়া হয়-নইলে বাঁচবো না-পায়ে পড়ি তোমার–

পথের দেবতা প্রসন্ন হাসিয়া বলেন-মুৰ্থ বালক, পথ তো আমার শেষ হয়নি তোমাদের গ্রামের বাঁশের বনে, ঠ্যাঙাড়ে বীরু রায়ের বটতলায় কি ধলচিতের খেয়াঘাটের সীমানায়? তোমাদের সোনাডাঙা মাঠ ছাড়িয়ে, ইছামতী পার হয়ে, পদ্মফুলে ভরা মধুখালি বিলের পাশ কাটিয়ে, বোত্রাবতীর খেয়ায় পাড়ি দিয়ে, পথ আমার চলে গেল সামনে, সামনে, শুধুই সামনে…দেশ ছেড়ে বিদেশের দিকে, সূর্যোদয় ছেড়ে সূর্যাস্তের দিকে, জানার গণ্ডী এড়িয়ে অপরিচয়ের উদ্দেশে…

দিন রাত্রি পার হয়ে, জন্ম মরণ পার হয়ে, মাস, বর্ষ, মন্বস্তর, মহাযুগ পার হয়ে চলে যায়… তোমাদের মর্মর জীবন-স্বপ্ন শ্যাওলা-ছাতার দলে ভরে আসে, পথ আমার তখনও ফুরোয় না…চলে…চলে…চলে…এগিয়েই চলে…

অনিৰ্বাণ তার বীণা শোনে শুধু অন্যস্ত কাল আর অনন্ত আকাশ….

সে পথের বিচিত্র আনন্দ-যাত্রার অদৃশ্য তিলক তোমার ললাটে পরিয়েই তো তোমায় ঘরছাড়া করে এনেছি!…

চল এগিয়ে যাই।

(সমাপ্ত)

175 Shares