গোরা

বলিয়া কোণের টেবিল হইতে সযত্নরক্ষিত গোরার রচনাগুলি আনিয়া হারানবাবুর সম্মুখে রাখিয়া দ্রুতপদে ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল।

হরিমোহিনী বিনয়কে পাইয়া অত্যন্ত আনন্দ অনুভব করিলেন। কেবল যে এই প্রিয়দর্শন যুবকের প্রতি স্নেহবশত তাহা নহে। এ বাড়িতে বাহিরের লোক যে-কেহ হরিমোহিনীর কাছে আসিয়াছে সকলেই তাঁহাকে যেন কোনো এক ভিন্ন শ্রেণীর প্রাণীর মতো দেখিয়াছে। তাহারা কলিকাতার লোক, প্রায় সকলেই ইংরেজি ও বাংলা লেখাপড়ায় তাঁহার অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ– তাহাদের দূরত্ব ও অবজ্ঞার আঘাতে তিনি অত্যন্ত সংকুচিত হইয়া পড়িতেছিলেন। বিনয়কে তিনি আশ্রয়ের মতো অনুভব করিলেন। বিনয়ও কলিকাতার লোক, হরিমোহিনী শুনিয়াছেন লেখাপড়াতেও সে বড়ো কম নয়– অথচ এই বিনয় তাঁহাকে কিছুমাত্র অশ্রদ্ধা করে না, তাঁহাকে আপন লোকের মতো দেখে, ইহাতে তাঁহার আত্মসম্মান একটা নির্ভর পাইল। বিশেষ করিয়া এইজন্যই অল্প পরিচয়েই বিনয় তাঁহার নিকট আত্মীয়ের স্থান লাভ করিল। তাঁহার মনে হইতে লাগিল, বিনয় তাঁহার বর্মের মতো হইয়া অন্য লোকের ঔদ্ধত্য হইতে তাঁহাকে রক্ষা করিবে। এ বাড়িতে তিনি অত্যন্ত বেশি প্রকাশ্য হইয়া পড়িয়াছিলেন– বিনয় যেন তাঁহার আবরণের মতো হইয়া তাঁহাকে আড়াল করিয়া রাখিবে।

হরিমোহিনীর কাছে বিনয় যাওয়ার অল্পক্ষণ পরেই ললিতা সেখানে কখনোই সহজে যাইত না– কিন্তু আজ হারানবাবুর গুপ্ত বিদ্রূপের আঘাতে সে সমস্ত সংকোচ ছিন্ন করিয়া যেন জোর করিয়া উপরের ঘরে গেল। শুধু গেল তাহা নহে, গিয়াই বিনয়ের সঙ্গে অজস্র কথাবার্তা আরম্ভ করিয়া দিল। তাহাদের সভা খুব জমিয়া উঠিল; এমন-কি, মাঝে মাঝে তাহাদের হাসির শব্দ নীচের ঘরে একাকী আসীন হারানবাবুর কানের ভিতর দিয়া মরমে পশিয়া বিদ্ধ করিতে লাগিল। তিনি বেশিক্ষণ একলা থাকিতে পারিলেন না, বরদাসুন্দরীর সঙ্গে আলাপ করিয়া মনের আক্ষেপ নিবৃত্ত করিতে চেষ্টা করিলেন। বরদাসুন্দরী শুনিলেন যে, সুচরিতা হারানবাবুর সঙ্গে বিবাহে অসম্মতি জ্ঞাপন করিয়াছে। শুনিয়া তাঁহার পক্ষে ধৈর্য রক্ষা করা একেবারে অসম্ভব হইল। তিনি কহিলেন, “পানুবাবু, আপনি ভালোমানষি করলে চলবে না। ও যখন বার বার সম্মতি প্রকাশ করেছে এবং ব্রাহ্মসমাজ-সুদ্ধ সকলেই যখন এই বিয়ের জন্য অপেক্ষা করে আছে তখন ও আজ মাথা নাড়ল বলেই যে সমস্ত উল্‌টে যাবে এ কখনোই হতে দেওয়া চলবে না। আপনার দাবি আপনি কিছুতেই ছাড়বেন না বলে রাখছি, দেখি ও কী করতে পারে।”

এ সম্বন্ধে হারানবাবুকে উৎসাহ দেওয়া বাহুল্য– তিনি তখন কাঠের মতন শক্ত হইয়া বসিয়া মাথা তুলিয়া মনে মনে বলিতেছিলেন– “অন প্রিন্সিপ্‌ল্‌ এ দাবি ছাড়া চলিবে না– আমার পক্ষে সুচরিতাকে ত্যাগ করা বেশি কথা নয়, কিন্তু ব্রাহ্মসমাজের মাথা হেঁট করিয়া দিতে পারিব না।’

বিনয় হরিমোহিনীর সহিত আত্মীয়তাকে পাকা করিয়া লইবার অভিপ্রায়ে আহারের আবদার করিয়া বসিয়াছিল। হরিমোহিনী তৎক্ষণাৎ ব্যস্ত হইয়া একটি ছোটো থালায় কিছু ভিজানো ছোলা, ছানা, মাখন, একটু চিনি, একটি কলা, এবং কাঁসার বাটিতে কিছু দুধ আনিয়া সযত্নে বিনয়ের সম্মুখে ধরিয়া দিয়াছেন। বিনয় হাসিয়া কহিল, “অসময়ে ক্ষুধা জানাইয়া মাসিকে বিপদে ফেলিব মনে করিয়াছিলাম, কিন্তু আমি ঠকিলাম”– এই বলিয়া খুব আড়ম্বর করিয়া বিনয় আহারে বসিয়াছে এমন সময় বরদাসুন্দরী আসিয়া উপস্থিত হইলেন। বিনয় তাহার থালার উপরে যথাসম্ভব নত হইয়া নমস্কারের চেষ্টা করিয়া কহিল, “অনেকক্ষণ নীচে ছিলুম; আপনার সঙ্গে দেখা হল না।” বরদাসুন্দরী তাহার কোনো উত্তর না করিয়া সুচরিতার প্রতি লক্ষ করিয়া কহিলেন, “এই-যে ইনি এখানে! আমি যা ঠাউরেছিলুম তাই। সভা বসেছে। আমোদ করছেন। এ দিকে বেচারা হারানবাবু সক্কাল থেকে ওঁর জন্যে অপেক্ষা করে বসে রয়েছেন, যেন তিনি ওঁর বাগানের মালী। ছেলেবেলা থেকে ওদের মানুষ করলুম– কই বাপু, এত দিন তো ওদের এরকম ব্যবহার কখনো দেখি নি। কে জানে আজকাল এ-সব শিক্ষা কোথা থেকে পাচ্ছে। আমাদের পরিবারে যা কখনো ঘটতে পারত না আজকাল তাই আরম্ভ হয়েছে– সমাজের লোকের কাছে যে আমাদের মুখ দেখাবার জো রইল না। এত দিন ধরে এত করে যা শেখানো গেল সে সমস্তই দু দিনে বিসর্জন দিলে। এ কী সব কাণ্ড!”

হরিমোহিনী শশব্যস্ত হইয়া উঠিয়া সুচরিতাকে কহিলেন, “নীচে কেউ বসে আছেন আমি তো জানতেম না। বড়ো অন্যায় হয়ে গেছে তো। মা, যাও তুমি শীঘ্র যাও। আমি অপরাধ করে ফেলেছি।”

অপরাধ যে হরিমোহিনীর লেশমাত্র নহে ইহাই বলিবার জন্য ললিতা মুহূর্তের মধ্যে উদ্যত হইয়া উঠিয়াছিল। সুচরিতা গোপনে সবলে তাহার হাত চাপিয়া ধরিয়া তাহাকে নিরস্ত করিল এবং কোনো প্রতিবাদমাত্র না করিয়া নীচে চলিয়া গেল।

পূর্বেই বলিয়াছি বিনয় বরদাসুন্দরীর স্নেহ আকর্ষণ করিয়াছিল। বিনয় যে তাঁহাদের পরিবারের প্রভাবে পড়িয়া ক্রমে ব্রাহ্মসমাজে প্রবেশ করিবে এ সম্বন্ধে তাঁহার সন্দেহ ছিল না। বিনয়কে তিনি যেন নিজের হাতে গড়িয়া তুলিতেছেন বলিয়া একটা বিশেষ গর্ব অনুভব করিতেছিলেন; সে গর্ব তিনি তাঁহার বন্ধুদের মধ্যে কারো কারো কাছে প্রকাশও করিয়াছিলেন। সেই বিনয়কে আজ শত্রুপক্ষের শিবিরের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত দেখিয়া তাঁহার মনের মধ্যে যেন একটা দাহ উপস্থিত হইল এবং নিজের কন্যা ললিতাকে বিনয়ের পুনঃপতনের সহায়কারী দেখিয়া তাঁহার চিত্তজ্বালা যে আরো দ্বিগুণ বাড়িয়া উঠিল সে কথা বলা বাহুল্য। তিনি রুক্ষস্বরে কহিলেন, “ললিতা, এখানে কি তোমার কোনো কাজ আছে?”

0 Shares