গোরা

সুচরিতা বসিলে তিনি কহিলেন, “তোমার মাসির এখানে কষ্ট হচ্ছে সে কথা আমি চিন্তা করেছি। তাঁর ধর্মবিশ্বাস ও আচরণ লাবণ্যর মার সংস্কারে যে এত বেশি আঘাত দেবে তা আমি আগে ঠিক জানতে পারি নি। যখন দেখছি তাঁকে পীড়া দিচ্ছে তখন এ বাড়িতে তোমার মাসিকে রাখলে তিনি সংকুচিত হয়ে থাকবেন।”

সুচরিতা কহিল, “আমার মাসি এখান থেকে যাবার জন্যেই প্রস্তুত হয়েছেন।”

পরেশবাবু কহিলেন, “আমি জানতুম যে তিনি যাবেন। তোমরা দুজনেই তাঁর একমাত্র আত্মীয়– তোমরা তাঁকে এমন অনাথার মতো বিদায় দিতে পারবে না সেও আমি জানি। তাই আমি এ কয়দিন এ সম্বন্ধে ভাবছিলুম।”

তাহার মাসি কী সংকটে পড়িয়াছেন পরেশবাবু যে তাহা বুঝিয়াছেন ও তাহা লইয়া ভাবিতেছেন এ কথা সুচরিতা একেবারেই অনুমান করে নাই। পাছে তিনি জানিতে পারিয়া বেদনা বোধ করেন এই ভয়ে সে এতদিন অত্যন্ত সাবধানে চলিতেছিল– আজ পরেশবাবুর কথা শুনিয়া সে আশ্চর্য হইয়া গেল এবং তাহার চোখের পাতা ছল্‌ছল্‌ করিয়া আসিল।

পরেশবাবু কহিলেন, “তোমার মাসির জন্যে আমি একটি বাড়ি ঠিক করে রেখেছি।”

সুচরিতা কহিল, “কিন্তু, তিনি তো–”

পরেশবাবু। ভাড়া দিতে পারবেন না। ভাড়া তিনি কেন দেবেন? তুমি ভাড়া দেবে।

সুচরিতা অবাক হইয়া পরেশবাবুর মুখের দিকে চাহিয়া রহিল। পরেশবাবু হাসিয়া কহিলেন, “তোমারই বাড়িতে থাকতে দিয়ো, ভাড়া দিতে হবে না।”

সুচরিতা আরো বিস্মিত হইল। পরেশবাবু কহিলেন, “কলকাতায় তোমাদের দুটো বাড়ি আছে জান না! একটি তোমার, একটি সতীশের। মৃত্যুর সময়ে তোমার বাবা আমার হাতে কিছু টাকা দিয়ে যান। আমি তাই খাটিয়ে বাড়িয়ে তুলে কলকাতায় দুটো বাড়ি কিনেছি। এতদিন তার ভাড়া পাচ্ছিলুম, তাও জমছিল। তোমার বাড়ির ভাড়াটে অল্পদিন হল উঠেও গেছে– সেখানে তোমার মাসির থাকবার কোনো অসুবিধা হবে না।”

সুচরিতা কহিল, “সেখানে তিনি কি একলা থাকতে পারবেন?”

পরেশবাবু কহিলেন, “তোমরা তাঁর আপনার লোক থাকতে তাঁকে একলা থাকতে হবে কেন?”

সুচরিতা কহিল, “সেই কথাই তোমাকে বলবার জন্যে আজ এসেছিলুম। মাসি চলে যাবার জন্যে প্রস্তুত হয়েছেন, আমি ভাবছিলুম আমি একলা কী করে তাঁকে যেতে দেব। তাই তোমার উপদেশ নেব বলে এসেছি। তুমি যা বলবে আমি তাই করব।”

পরেশবাবু কহিলেন, “আমাদের বাসার গায়েই এই-যে গলি, এই গলির দুটো-তিনটে বাড়ির পরেই তোমার বাড়ি– ঐ বারান্দায় দাঁড়ালে সে বাড়ি দেখা যায়। সেখানে তোমরা থাকলে নিতান্ত অরক্ষিত অবস্থায় থাকতে হবে না। আমি তোমাদের দেখতে শুনতে পারব।”

সুচরিতার বুকের উপর হইতে একটা মস্ত পাথর নামিয়া গেল। “বাবাকে ছাড়িয়া কেমন করিয়া যাইব’ এই চিন্তার সে কোনো অবধি পাইতেছিল না। কিন্তু যাইতেই হইবে ইহাও তাহার কাছে নিশ্চিত হইয়া উঠিয়াছিল।

সুচরিতা আবেগপরিপূর্ণ হৃদয় লইয়া চুপ করিয়া পরেশবাবুর কাছে বসিয়া রহিল। পরেশবাবুও স্তব্ধ হইয়া নিজের অন্তঃকরণের মধ্যে নিজেকে গভীরভাবে নিহিত করিয়া বসিয়া রহিলেন। সুচরিতা শিষ্যা, তাঁহার কন্যা, তাঁহার সুহৃদ। সে তাঁহার জীবনের, এমন-কি, তাঁহার ঈশ্বরোপাসনার সঙ্গে জড়িত হইয়া গিয়াছিল। যেদিন সে নিঃশব্দে আসিয়া তাঁহার উপাসনার সহিত যোগ দিত সেদিন তাঁহার উপাসনা যেন বিশেষ পূর্ণতা লাভ করিত। প্রতিদিন সুচরিতার জীবনকে মঙ্গলপূর্ণ স্নেহের দ্বারা গড়িতে গড়িতে তিনি নিজের জীবনকে একটি বিশেষ পরিণতি দান করিতেছিলেন। সুচরিতা যেমন ভক্তি যেমন একান্ত নম্রতার সহিত তাঁহার কাছে আসিয়া দাঁড়াইয়াছিল এমন করিয়া আর-কেহ তাঁহার কাছে আসে নাই; ফুল যেমন করিয়া আকাশের দিকে তাকায় সে তেমনি করিয়া তাঁহার দিকে তাহার সমস্ত প্রকৃতিকে উন্মুখ এবং উদ্‌ঘাটিত করিয়া দিয়াছিল। এমন একাগ্রভাবে কেহ কাছে আসিলে মানুষের দান করিবার শক্তি আপনি বাড়িয়া যায়– অন্তঃকরণ জলভারনম্র মেঘের মতো পরিপূর্ণতার দ্বারা নত হইয়া পড়ে। নিজের যাহা-কিছু সত্য, যাহা-কিছু শ্রেষ্ঠ তাহা কোনো অনুকূল চিত্তের নিকট প্রতিদিন দান করিবার সুযোগের মতো এমন শুভযোগ মানুষের কাছে আর কিছু হইতেই পারে না; সেই দুর্লভ সুযোগ সুচরিতা পরেশকে দিয়াছিল। এজন্য সুচরিতার সঙ্গে তাঁহার সম্বন্ধ অত্যন্ত গভীর হইয়াছিল। আজ সেই সুচরিতার সঙ্গে তাঁহার বাহ্য সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করিবার সময় উপস্থিত হইয়াছে– ফলকে নিজের জীবনরসে পরিপক্ক করিয়া তুলিয়া তাহাকে নিজের নিকট হইতে মুক্ত করিয়া দিতে হইবে। এজন্য তিনি মনের মধ্যে যে বেদনা অনুভব করিতেছিলেন সেই নিগূঢ় বেদনাটিকে তিনি অন্তর্যামীর নিকট নিবেদন করিয়া দিতেছিলেন। সুচরিতার পাথেয় সঞ্চয় হইয়াছে, এখন নিজের শক্তিতে প্রশস্ত পথে সুখে দুঃখে আঘাতে-প্রতিঘাতে নূতন অভিজ্ঞতা লাভের দিকে যে তাহার আহ্বান আসিয়াছে তাহার আয়োজন কিছুদিন হইতেই পরেশ লক্ষ করিতেছিলেন; তিনি মনে মনে বলিতেছিলেন, “বৎসে, যাত্রা করো– তোমার চিরজীবন যে কেবল আমার বুদ্ধি এবং আমার আশ্রয়ের দ্বারাই আচ্ছন্ন করিয়া রাখিব এমন কখনোই হইতে পারিবে না– ঈশ্বর আমার নিকট হইতে তোমাকে মুক্ত করিয়া বিচিত্রের ভিতর দিয়া তোমাকে চরম পরিণামে আকর্ষণ করিয়া লইয়া যান–তাঁহার মধ্যে তোমার জীবন সার্থক হউক।’ এই বলিয়া আশৈশব-স্নেহপালিত সুচরিতাকে তিনি মনের মধ্যে নিজের দিক হইতে ঈশ্বরের দিকে পবিত্র উৎসর্গসামগ্রীর মতো তুলিয়া ধরিতেছিলেন। পরেশ বরদাসুন্দরীর প্রতি রাগ করেন নাই, নিজের সংসারের প্রতি মনকে কোনোপ্রকার বিরোধ অনুভব করিতে প্রশ্রয় দেন নাই। তিনি জানিতেন সংকীর্ণ উপকূলের মাঝখানে নূতন বর্ষণের জলরাশি হঠাৎ আসিয়া পড়িলে অত্যন্ত একটা ক্ষোভের সৃষ্টি হয়– তাহার একমাত্র প্রতিকার তাহাকে প্রশস্ত ক্ষেত্রে মুক্ত করিয়া দেওয়া। তিনি জানিতেন অল্পদিনের মধ্যে সুচরিতাকে আশ্রয় করিয়া এই ছোটো পরিবারটির মধ্যে যে-সকল অপ্রত্যাশিত সমাবেশ ঘটিয়াছে তাহা এখানকার বাঁধা সংস্কারকে পীড়িত করিতেছে, তাহাকে এখানে ধরিয়া রাখিবার চেষ্টা না করিয়া মুক্তিদান করিলেই তবেই স্বভাবের সহিত সামঞ্জস্য ঘটিতে পারে নীরবে তাহারই আয়োজন করিতেছিলেন।

0 Shares