গোরা

সতীশ লজ্জিতভাবে কোনোমতে প্রণামটা সারিয়া লইল।

এমন সময়ে বরদাসুন্দরী উপরে আসিয়া হরিমোহিনীর দিকে দৃক্‌পাতমাত্র না করিয়া আনন্দময়ীকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “আপনি কি আমাদের এখানে কিছু খাবেন?

আনন্দময়ী কহিলেন, “খাওয়াছোঁওয়া নিয়ে আমি কিছু বাছ-বিচার করি নে। কিন্তু আজকে থাক্‌– গোরা ফিরে আসুক, তার পরে খাব।”

আনন্দময়ী গোরার অসাক্ষাতে গোরার অপ্রিয় কোনো আচরণ করিতে পারিলেন না।

বরদাসুন্দরী বিনয়ের দিকে তাকাইয়া কহিলেন, “এই যে বিনয়বাবু এখানে! আমি বলি আপনি আসেন নি বুঝি।”

বিনয় তৎক্ষণাৎ বলিল, “আমি যে এসেছি সে বুঝি আপনাকে না জানিয়ে যাব ভেবেছেন?”

বরদাসুন্দরী কহিলেন, “কাল তো নিমন্ত্রণের খাওয়া ফাঁকি দিয়েছেন, আজ নাহয় বিনা নিমন্ত্রণের খাওয়া খাবেন।”

বিনয় কহিল, “সেইটেতেই আমার লোভ বেশি। মাইনের চেয়ে উপরি-পাওনার টান বড়ো।”

হরিমোহিনী মনে মনে বিস্মিত হইলেন। বিনয় এ বাড়িতে খাওয়া-দাওয়া করে– আনন্দময়ীও বাছ-বিচার করেন না। ইহাতে তাঁহার মন প্রসন্ন হইল না।

বরদাসুন্দরী চলিয়া গেলে হরিমোহিনী সসংকোচে জিজ্ঞাসা করিলেন, “দিদি, তোমার স্বামী কি–”

আনন্দময়ী কহিলেন, “আমার স্বামী খুব হিন্দু।”

হরিমোহিনী অবাক হইয়া রহিলেন। আনন্দময়ী তাঁহার মনের ভাব বুঝিতে পারিয়া কহিলেন, “বোন, যতদিন সমাজ আমার সকলের চেয়ে বড়ো ছিল ততদিন সমাজকেই মেনে চলতুম, কিন্তু একদিন ভগবান আমার ঘরে হঠাৎ এমন করে দেখা দিলেন যে আমাকে আর সমাজ মানতে দিলেন না। তিনি নিজে এসে আমার জাত কেড়ে নিয়েছেন, তখন আমি আর কাকে ভয় করি।”

হরিমোহিনী এ কৈফিয়তের অর্থ বুঝিতে না পারিয়া কহিলেন, “তোমার স্বামী–”

আনন্দময়ী কহিলেন, “আমার স্বামী রাগ করেন।”

হরিমোহিনী। ছেলেরা?

আনন্দময়ী। ছেলেরাও খুশি নয়। কিন্তু তাদের খুশি করেই কি বাঁচব? বোন, আমার এ কথা কাউকে বোঝাবার নয়– যিনি সব জানেন তিনিই বুঝবেন।

বলিয়া আনন্দময়ী হাত জোড় করিয়া প্রণাম করিলেন।

হরিমোহিনী ভাবিলেন হয়তো কোনো মিশনারির মেয়ে আসিয়া আনন্দময়ীকে খৃস্টানি ভজাইয়া গেছে। তাঁহার মনের মধ্যে অত্যন্ত একটা সংকোচ উপস্থিত হইল।

৪৩

পরেশবাবুর বাসার কাছেই সর্বদা তাঁহার তত্ত্বাবধানে থাকিয়া বাস করিতে পাইবে এই কথা শুনিয়া সুচরিতা অত্যন্ত আরামবোধ করিয়াছিল। কিন্তু যখন তাহার নূতন বাড়ির গৃহসজ্জা সমাপ্ত এবং সেখানে উঠিয়া যাইবার সময় নিকটবর্তী হইল তখন সুচরিতার বুকের ভিতর যেন টানিয়া ধরিতে লাগিল। কাছে থাকা না-থাকা লইয়া কথা নয়, কিন্তু জীবনের সঙ্গে জীবনের যে সর্বাঙ্গীণ যোগ ছিল তাহাতে এত দিন পরে একটা বিচ্ছেদ ঘটিবার কাল আসিয়াছে, ইহা আজ সুচরিতার কাছে যেন তাহার এক অংশের মৃত্যুর মতো বোধ হইতে লাগিল। এই পরিবারের মধ্যে সুচরিতার যেটুকু স্থান ছিল, তাহার যে-কিছু কাজ ছিল, প্রত্যেক চাকরটির সঙ্গেও তাহার যে সম্বন্ধ ছিল, সমস্তই সুচরিতার হৃদয়কে ব্যাকুল করিয়া তুলিতে লাগিল।

সুচরিতার যে নিজের কিছু সংগতি আছে এবং সেই সংগতির জোরে আজ সে স্বাধীন হইবার উপক্রম করিতেছে এই সংবাদে বরদাসুন্দরী বার বার করিয়া প্রকাশ করিলেন যে, ইহাতে ভালোই হইল, এতদিন এত সাবধানে যে দায়িত্বভার বহন করিয়া আসিতেছিলেন তাহা হইতে মুক্ত হইয়া তিনি নিশ্চিন্ত হইলেন। কিন্তু মনে মনে সুচরিতার প্রতি তাঁহার যেন একটা অভিমানের ভাব জন্মিল; সুচরিতা যে তাঁহাদের কাছ হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়া আজ নিজের সম্বলের উপর নির্ভর করিয়া দাঁড়াইতে পারিতেছে এ যেন তাহার একটা অপরাধ। তাঁহারা ছাড়া সুচরিতার অন্য কোনো গতি নাই ইহাই মনে করিয়া অনেক সময় সুচরিতাকে তিনি আপন পরিবারের একটা আপদ বলিয়া নিজের প্রতি করুণা অনুভব করিয়াছেন, কিন্তু সেই সুচরিতার ভার যখন লাঘব হইবার সংবাদ হঠাৎ পাইলেন তখন তো মনের মধ্যে কিছুমাত্র প্রসন্নতা অনুভব করিলেন না। তাঁহাদের আশ্রয় সুচরিতার পক্ষে অত্যাবশ্যক নহে ইহা জানিয়া সে যে গর্ব অনুভব করিতে পারে, তাঁহাদের আনুগত্য স্বীকারে বাধ্য না হইতে পারে, এই কথা মনে করিয়া তিনি আগে হইতেই তাহাকে অপরাধী করিতে লাগিলেন। এ কয়দিন বিশেষভাবে তাহার প্রতি দূরত্ব রক্ষা করিয়া চলিলেন। পূর্বে তাহাকে ঘরের কাজ-কর্মে যেমন করিয়া ডাকিতেন এখন তাহা একেবারে ছাড়িয়া দিয়া গায়ে পড়িয়া তাহাকে অস্বাভাবিক সম্ভ্রম দেখাইতে লাগিলেন। বিদায়ের পূর্বে সুচরিতা ব্যথিতচিত্তে বেশি করিয়াই বরদাসুন্দরীর গৃহকার্যে যোগ দিতে চেষ্টা করিতেছিল, নানা উপলক্ষে তাঁহার কাছে কাছে ফিরিতেছিল, কিন্তু বরদাসুন্দরী যেন পাছে তাহার অসম্মান ঘটে এইরূপ ভাব দেখাইয়া তাহাকে দূরে ঠেকাইয়া রাখিতেছিলেন। এতকাল যাঁহাকে মা বলিয়া যাঁহার কাছে সুচরিতা মানুষ হইয়াছে আজ বিদায় লইবার সময়ও তিনি যে তাহার প্রতি চিত্তকে প্রতিকূল করিয়া রহিলেন, এই বেদনাই সুচরিতাকে সব চেয়ে বেশি করিয়া বাজিতে লাগিল।

লাবণ্য ললিতা লীলা সুচরিতার সঙ্গে সঙ্গেই ফিরিতে লাগিল। তাহারা অত্যন্ত উৎসাহ করিয়া তাহার নূতন বাড়ির ঘর সাজাইতে গেল, কিন্তু সেই উৎসাহের ভিতরেও অব্যক্ত বেদনার অশ্রুজল প্রচ্ছন্ন হইয়া ছিল।

0 Shares