গোরা

ছাতে কাপড় শুকাইতে দিয়াছিলেন, অপরাহ্নে রৌদ্র পড়িয়া আসিলে আনন্দময়ী যখন তুলিতে আসিলেন তখন গোরার ঘরে বিনয়কে দেখিয়া তিনি আশ্চর্য হইয়া গেলেন। তাড়াতাড়ি তাহার পাশে আসিয়া তাহার গায়ে হাত দিয়া কহিলেন, “বিনয়, কী হয়েছে বিনয়? তোর মুখ অমন সাদা হয়ে গেছে কেন?”

বিনয় উঠিয়া বসিল; কহিল, “মা, আমি পরেশবাবুদের বাড়িতে প্রথম যখন যাতায়াত করতে আরম্ভ করি, গোরা রাগ করত। তার রাগকে আমি তখন অন্যায় মনে করতুম– কিন্তু অন্যায় তার নয়, আমারই নির্বুদ্ধিতা।”

আনন্দময়ী একটুখানি হাসিয়া কহিলেন, “তুই যে আমাদের খুব সুবুদ্ধি ছেলে তা আমি বলি নে, কিন্তু এ ক্ষেত্রে তোর বুদ্ধির দোষ কিসে প্রকাশ পেলে?”

বিনয় কহিল, “মা, আমাদের সমাজ যে একেবারেই ভিন্ন সে কথা আমি একেবারেই বিবেচনা করি নি। ওঁদের বন্ধুত্বে ব্যবহারে দৃষ্টান্তে আমার খুব আনন্দ এবং উপকার বোধ হচ্ছিল, তাতেই আমি আকৃষ্ট হয়েছিলুম, আর-কোনো কথা যে চিন্তা করবার আছে এক মুহূর্তের জন্য সে আমার মনে উদয় হয় নি।”

আনন্দময়ী কহিলেন, “তোর কথা শুনে এখনো তো আমার মনে উদয় হচ্ছে না।”

বিনয় কহিল, “মা, তুমি জান না, সমাজে আমি তাঁদের সম্বন্ধে ভারি একটা অশান্তি জাগিয়ে দিয়েছি– লোকে এমন-সব নিন্দা করতে আরম্ভ করেছে যে আমি আর সেখানে–”

আনন্দময়ী কহিলেন, “গোরা একটা কথা বার বার বলে, সেটা আমার কাছে খুব খাঁটি মনে হয়। সে বলে, যেখানে ভিতরে কোথাও একটা অন্যায় আছে সেখানে বাইরে শান্তি থাকাটাই সকলের চেয়ে অমঙ্গল। ওঁদের সমাজে যদি অশান্তি জেগে থাকে তা হলে তোর অনুতাপ করবার কোনো দরকার দেখি নে, দেখবি তাতে ভালোই হবে। তোর নিজের ব্যবহারটা খাঁটি থাকলেই হল।”

ঐখানেই তো বিনয়ের মস্ত খটকা ছিল। তাহার নিজের ব্যবহারটা অনিন্দনীয় কি না সেইটে সে কোনোমতেই বুঝিয়া উঠিতে পারিতেছিল না। ললিতা যখন ভিন্নসমাজভুক্ত, তাহার সঙ্গে বিবাহ যখন সম্ভবপর নহে, তখন তাহার প্রতি বিনয়ের অনুরাগটাই একটা গোপন পাপের মতো তাহাকে ক্লিষ্ট করিতেছিল এবং এই পাপের নিদারুণ প্রায়শ্চিত্তকাল যে উপস্থিত হইয়াছে এই কথাই স্মরণ করিয়া সে পীড়িত হইতেছিল।

বিনয় হঠাৎ বলিয়া উঠিল, “মা, শশিমুখীর সঙ্গে আমার বিবাহের যে প্রস্তাব হয়েছিল সেটা হয়ে চুকে গেলেই ভালো হত। আমার যেখানে ঠিক জায়গা সেইখানেই কোনোমতে আমার বদ্ধ হয়ে থাকা উচিত– এমন হওয়া উচিত যে, কিছুতেই সেখান থেকে আর নড়তে না পারি।”

আনন্দময়ী হাসিয়া কহিলেন, “অর্থাৎ, শশিমুখীকে তোর ঘরের বউ না করে তোরা ঘরের শিকল করত চাস– শশীর কী সুখেরই কপাল!”

এমন সময় বেহারা আসিয়া খবর দিল, পরেশবাবুর বাড়ির দুই মেয়ে আসিয়াছেন। শুনিয়া বিনয়ের বুকের মধ্যে ধড়াস করিয়া উঠিল। তাহার মনে হইল, বিনয়কে সতর্ক করিয়া দিবার জন্য তাহারা আনন্দময়ীর কাছে নালিশ জানাইতে আসিয়াছে। সে একেবারে দাঁড়াইয়া উঠিয়া কহিল, “আমি যাই মা!”

আনন্দময়ী উঠিয়া দাঁড়াইয়া তাহার হাত ধরিয়া কহিলেন, “একেবারে বাড়ি ছেড়ে যাস নে বিনয়! নীচের ঘরে একটু অপেক্ষা কর্‌।”

নীচে যাইতে যাইতে বিনয় বার বার বলিতে লাগিল, “এর তো কোনো দরকার ছিল না। যা হয়ে গেছে তা হয়ে গেছে, কিন্তু আমি তো মরে গেলেও আর সেখানে যেতুম না। অপরাধের শাস্তি আগুনের মতো যখন একবার জ্বলে ওঠে তখন অপরাধী দগ্ধ হয়ে ম’লেও সেই শাস্তির আগুন যেন নিবতেই চায় না।’

একতলায় রাস্তার ধারে গোরার যে ঘর ছিল সেই ঘরে বিনয় যখন প্রবেশ করিতে যাইতেছে এমন সময় মহিম তাঁহার স্ফীত উদরটিকে চাপকানের বোতাম-বন্ধন হইতে মুক্তি দিতে দিতে আপিস হইতে বাড়ি ফিরিয়া আসিলেন। বিনয়ের হাত ধরিয়া কহিলেন, “এই-যে বিনয়! বেশ! আমি তোমাকে খুঁজছি।”

বলিয়া বিনয়কে গোরার ঘরের মধ্যে লইয়া গিয়া একটা চৌকিতে বসাইয়া নিজেও বসিলেন এবং পকেট হইতে ডিবা বাহির করিয়া বিনয়কে একটি পান খাইতে দিলেন।

“ওরে তামাক নিয়ে আয় রে” বলিয়া একটা হুংকার দিয়া তিনি একেবারেই কাজের কথা পাড়িলেন। জিজ্ঞাসা করিলেন, “সেই বিষয়টার কী স্থির হল? আর তো–”

দেখিলেন বিনয়ের ভাবখানা পূর্বের চেয়ে অনেকটা নরম। খুব যে একটা উৎসাহ তাহা নয় বটে, কিন্তু ফাঁকি দিয়া কোনোমতে কথাটাকে এড়াইবার চেষ্টাও দেখা যায় না। মহিম তখনই দিন-ক্ষণ একেবারে পাকা করিতে চান; বিনয় কহিল, “গোরা ফিরে আসুক-না।”

মহিম আশ্বস্ত হইয়া কহিলেন, “সে তো আর দিন কয়েক আছে। বিনয়, কিছু জলখাবার আনতে বলে দিই– কী বল? তোমার মুখ আজ ভারি শুকনো দেখাচ্ছে যে! কিছু অসুখ-বিসুখ করে নি তো?”

জলখাবারের দায় হইতে বিনয় নিষ্কৃতি লাভ করিলে মহিম নিজের ক্ষুধানিবৃত্তির অভিপ্রায়ে বাড়ির ভিতর গমন করিলেন। বিনয় গোরার টেবিলের উপর হইতে যে-কোনো একখানা বই টানিয়া লইয়া পাতা উলটাইতে লাগিল, তাহার পরে বই ফেলিয়া ঘরের এক ধার হইতে আর-এক ধার পর্যন্ত পায়চারি করিতে থাকিল।

বেহারা আসিয়া কহিল, “মা ডাকছেন।”

বিনয় জিজ্ঞাসা করিল, “কাকে ডাকছেন?”

বেহারা কহিল, “আপনাকে।”

বিনয় জিজ্ঞাসা করিল, “আর-সকলে আছেন?”

বেহারা কহিল, “আছেন।”

পরীক্ষাঘরের মুখে ছাত্র যেমন করিয়া যায় বিনয় তেমনি করিয়া উপরে চলিল। ঘরের দ্বারের কাছে আসিয়া একটু ইতস্তত করিতেই সুচরিতা পূর্বের মতোই তাহার সহজ সৌহার্দ্যের স্নিগ্ধকণ্ঠে কহিল, “বিনয়বাবু, আসুন।” সেই স্বর শুনিয়া বিনয়ের মনে হইল যেন সে একটা অপ্রত্যাশিত ধন পাইল।

0 Shares