গোরা

অবিনাশের মালা সবলে প্রত্যাখ্যান করিয়া গোরা অবরুদ্ধ ক্রোধের কণ্ঠে কহিল, “এখন বুঝি তোমাদের অভিনয় শুরু হল? আজ রাস্তার ধারে আমাকে তোমাদের যাত্রার দলে সঙ সাজাবার জন্যে বুঝি এই এক মাস ধরে মহলা দিচ্ছিলে?”

অনেক দিন হইতে অবিনাশ এই প্ল্যান করিয়াছিল–সে ভাবিয়াছিল, ভারি একটা তাক লাগাইয়া দিবে। আমরা যে সময়ের কথা বলিতেছি তখন এরূপ উপদ্রব প্রচলিত ছিল না। অবিনাশ বিনয়কেও মন্ত্রণার মধ্যে লয় নাই, এই অপূর্ব ব্যাপারের সমস্ত বাহাদুরি সে নিজেই লইবে বলিয়া লুব্ধ হইয়াছিল। এমন-কি, খবরের কাগজের জন্য ইহার বিবরণ সে নিজেই লিখিয়া ঠিক করিয়া রাখিয়াছিল, ফিরিয়া গিয়াই তাহার দুই-একটা ফাঁক পূরণ করিয়া পাঠাইয়া দিবে স্থির ছিল।

গোরার তিরস্কারে অবিনাশ ক্ষুব্ধ হইয়া কহিল, “আপনি অন্যায় বলছেন। আপনি কারাবাসে যে দুঃখ ভোগ করেছেন আমরা তার চেয়ে কিছুমাত্র কম সহ্য করি নি। এই এক-মাস-কাল প্রতিমুহূর্ত তুষানলে আমাদের বক্ষের পঞ্জর দগ্ধ হয়েছে।”

গোরা কহিল, “ভুল করছ অবিনাশ, একটু তাকিয়ে দেখলেই দেখতে পাবে তুষগুলো এখনো সমস্তই গোটা আছে, বক্ষের পঞ্জরেও মারাত্মক রকম লোকসান হয় নি।”

অবিনাশ দমিল না; কহিল, “রাজপুরুষ আপনার অপমান করেছে, কিন্তু আজ সমস্ত ভারতভূমির মুখপাত্র হয়ে আমরা এই সম্মানের মাল্য–”

গোরা বলিয়া উঠিল, “আর তো সহ্য হয় না।”

অবিনাশ ও তাহার দলকে এক পাশে সরাইয়া দিয়া গোরা কহিল, “পরেশবাবু, গাড়িতে উঠুন।”

পরেশবাবু গাড়িতে উঠিয়া হাঁপ ছাড়িয়া বাঁচিলেন। গোরা ও বিনয় তাঁহার অনুসরণ করিল।

স্টীমারযোগে যাত্রা করিয়া পরদিন প্রাতঃকালে গোরা বাড়ি আসিয়া পৌঁছিল। দেখিল বাহির-বাড়িতে তাহার দলের বিস্তর লোক জটলা করিয়াছে। কোনোক্রমে তাহাদের হাত হইতে নিষ্কৃতি লইয়া গোরা অন্তঃপুরে আনন্দময়ীর কাছে গিয়া উপস্থিত হইল; তিনি আজ সকাল-সকাল স্নান সারিয়া প্রস্তুত হইয়া বসিয়া ছিলেন। গোরা আসিয়া তাঁহার পায়ে পড়িয়া প্রণাম করিতেই আনন্দময়ীর দুই চক্ষু দিয়া জল পড়িতে লাগিল। এতদিন যে অশ্রু তিনি অবরুদ্ধ রাখিয়াছিলেন আজ আর কোনোমতেই তাহা বাধা মানিল না।

কৃষ্ণদয়াল গঙ্গাস্নান করিয়া ফিরিয়া আসিতেই গোরা তাঁহার সহিত দেখা করিল। দূর হইতেই তাঁহাকে প্রণাম করিল, তাঁহার পাদস্পর্শ করিল না। কৃষ্ণদয়াল সসংকোচে দূরে আসনে বসিলেন। গোরা কহিল, “বাবা, আমি একটা প্রায়শ্চিত্ত করতে চাই।”

কৃষ্ণদয়াল কহিলেন, “তার তো কোনো প্রয়োজন দেখি নে।”

গোরা কহিল, “জেলে আমি আর-কোনো কষ্ট গণ্যই করি নি, কেবল নিজেকে অত্যন্ত অশুচি বলে মনে হত, সেই গ্লানি এখনো আমার যায় নি–প্রায়শ্চিত্ত করতেই হবে।”

কৃষ্ণদয়াল ব্যস্ত হইয়া কহিলেন, “না না, তোমার অত বাড়াবাড়ি করতে হবে না। আমি তো ওতে মত দিতে পারছি নে।”

গোরা কহিল, “আচ্ছা, আমি নাহয় এ সম্বন্ধে পণ্ডিতদের মত নেব।”

কৃষ্ণদয়াল কহিলেন, “কোনো পণ্ডিতের মত নিতে হবে না। আমি তোমাকে বিধান দিচ্ছি, তোমার প্রায়শ্চিত্তের প্রয়োজন নেই।”

কৃষ্ণদয়ালের মতো অমন আচারশুচিবায়ুগ্রস্ত লোক গোরার পক্ষে কোনোপ্রকার নিয়মসংযম যে কেন স্বীকার করিতে চান না–শুধু স্বীকার করেন না তা নয়, একেবারে তাহার বিরুদ্ধে জেদ ধরিয়া বসেন, আজ পর্যন্ত গোরা তাহার কোনো অর্থই বুঝিতে পারে নাই।

আনন্দময়ী আজ ভোজনস্থলে গোরার পাশেই বিনয়ের পাত করিয়াছিলেন। গোরা কহিল, “মা, বিনয়ের আসনটা একটু তফাত করে দাও।”

আনন্দময়ী আশ্চর্য হইয়া কহিলেন, “কেন, বিনয়ের অপরাধ কী হল?”

গোরা কহিল, “বিনয়ের কিছু হয় নি, আমারই হয়েছে। আমি অশুদ্ধ আছি।”

আনন্দময়ী কহিলেন, “তা হোক, বিনয় অত শুদ্ধাশুদ্ধ মানে না।”

গোরা কহিল, “বিনয় মানে না, আমি মানি।”

আহারের পর দুই বন্ধু যখন তাহাদের উপরের তলের নিভৃত ঘরে গিয়া বসিল তখন তাহারা কেহ কোনো কথা খুঁজিয়া পাইল না। এই এক মাসের মধ্যে বিনয়ের কাছে যে একটিমাত্র কথা সকলের চেয়ে বড়ো হইয়া উঠিয়াছে সেটা আজ কেমন করিয়া যে গোরার কাছে পাড়িবে তাহা সে ভাবিয়াই পাইতেছিল না। পরেশবাবুর বাড়ির লোকদের সম্বন্ধে গোরার মনেও একটা জিজ্ঞাসা জাগিতেছিল, কিন্তু সে কিছুই বলিল না। বিনয় কথাটা পাড়িবে বলিয়া সে অপেক্ষা করিতেছিল। অবশ্য বাড়ির মেয়েরা সকলে কেমন আছেন সে কথা গোরা পরেশবাবুকে জিজ্ঞাসা করিয়াছিল, কিন্তু সে তো কেবল ভদ্রতার প্রশ্ন। তাহারা সকলে ভালো আছে এইটুকু খবরের চেয়েও আরো বিস্তারিত বিবরণ জানিবার জন্য তাহার মনের মধ্যে ঔৎসুক্য ছিল।

এমন সময় মহিম ঘরের মধ্যে আসিয়া আসন গ্রহণ করিয়া সিঁড়ি উঠার শ্রমে কিছুক্ষণ হাঁপাইয়া লইলেন। তাহার পরে কহিলেন, “বিনয়, এতদিন তো গোরার জন্যে অপেক্ষা করা গেল। এখন আর তো কোনো কথা নেই। এবার দিন ক্ষণ ঠিক করে ফেলা যাক। কী বল গোরা? বুঝেছ তো কী কথাটা হচ্ছে?”

গোরা কোনো কথা না বলিয়া একটুখানি হাসিল।

মহিম কহিলেন, “হাসছ যে! তুমি ভাবছ আজও দাদা সে কথাটা ভোলে নি। কিন্তু কন্যাটি তো স্বপ্ন নয়, স্পষ্টই দেখতে পাচ্ছি সে একটি সত্য পদার্থ–ভোলবার জো কী! হাসি নয় গোরা, এবারে যা হয় ঠিক করে ফেলো।”

গোরা কহিল, “ঠিক করবার কর্তা যিনি তিনি তো স্বয়ং উপস্থিত রয়েছেন।”

0 Shares