গোরা

কিন্তু সেই আঘাতের প্রথম সংকোচটা কাটিয়া গেছে; ললিতার প্রসঙ্গ লইয়া গোরার সঙ্গে একটা স্পষ্ট কথা হইয়া যাওয়াতে বিনয় জোর পাইল। ফোড়া কাটাইবার পূর্বে রোগীর ভয় ও ভাবনার অবধি ছিল না; কিন্তু অস্ত্র যখন পড়িল তখন রোগী দেখিল বেদনা আছে বটে, কিন্তু আরামও আছে, এবং জিনিসটাকে কল্পনায় যত সাংঘাতিক বলিয়া মনে হইয়াছিল ততটাও নহে।

এতক্ষণ বিনয় নিজের মনের সঙ্গে তর্কও করিতে পারিতেছিল না, এখন তাহার তর্কের দ্বারও খুলিয়া গেল। এখন মনে মনে গোরার সঙ্গে তাহার উত্তর-প্রত্যুত্তর চলিতে লাগিল। গোরার দিক হইতে যে-সকল যুক্তিপ্রয়োগ সম্ভব সেইগুলি মনের মধ্যে উত্থাপিত করিয়া তাহাদিগকে নানা দিক হইতে খণ্ডন করিতে লাগিল। যদি গোরার সঙ্গে মুখে মুখে সমস্ত তর্ক চলিতে পারিত তাহা হইলে উত্তেজনা যেমন জাগিত তেমনি নিবৃত্ত হইয়াও যাইত; কিন্তু বিনয় দেখিল, এ বিষয়ে গোরা শেষ পর্যন্ত তর্ক করিবে না। ইহাতেও বিনয়ের মনে একটা উত্তাপ জাগিল; সে ভাবিল– গোরা বুঝিবে না, বুঝাইবে না, কেবলই জোর করিবে। “জোর! জোরের কাছে মাথা হেঁট করিতে পারিব না।’ বিনয় কহিল, “যাহাই ঘটুক আমি সত্যের পক্ষে।’ এই বলিয়া “সত্য’ বলিয়া একটি শব্দকে দুই হাতে সে বুকের মধ্যে আঁকড়িয়া ধরিল। গোরার প্রতিকূলে একটি খুব প্রবল পক্ষকে দাঁড় করানো দরকার– এইজন্য, সত্যই যে বিনয়ের চরম অবলম্বন ইহাই সে বার বার করিয়া নিজের মনকে বলিতে লাগিল। এমন-কি, সত্যকেই সে যে আশ্রয় করিতে পারিয়াছে ইহাই মনে করিয়া নিজের প্রতি তাহার ভারি একটা শ্রদ্ধা জন্মিল। এইজন্য বিনয় অপরাহ্নে সুচরিতার বাড়ির দিকে যখন গেল তখন বেশ একটু মাথা তুলিয়া গেল। সত্যের দিকেই ঝুঁকিয়াছে বলিয়া তাহার এত জোর, না, ঝোঁকটা আর-কিছুর দিকে সে কথা বিনয়ের বুঝিবার অবস্থা ছিল না।

হরিমোহিনী তখন রন্ধনের উদ্‌যোগ করিতেছিলেন। বিনয় সেখানে রন্ধনশালার দ্বারে ব্রাহ্মণতনয়ের মধ্যাহ্নভোজনের দাবি মঞ্জুর করাইয়া উপরে চলিয়া গেল।

সুচরিতা একটা সেলাইয়ের কাজ লইয়া সেই দিকে চোখ নামাইয়া অঙ্গুলিচালনা করিতে করিতে আলোচ্য কথাটা পাড়িল। কহিল, “দেখুন বিনয়বাবু, ভিতরকার বাধা যেখানে নেই সেখানে বাইরের প্রতিকূলতাকে কি মেনে চলতে হবে?”

গোরার সঙ্গে যখন তর্ক হইয়াছিল তখন বিনয় বিরুদ্ধ যুক্তি প্রয়োগ করিয়াছে। আবার সুচরিতার সঙ্গে যখন আলোচনা হইতে লাগিল তখনো সে উলটা পক্ষের যুক্তি প্রয়োগ করিল। তখন গোরার সঙ্গে তাহার যে কোনো মতবিরোধ আছে এমন কথা কে মনে করিতে পারিবে!

বিনয় কহিল, “দিদি, বাইরের বাধাকে তোমরাও তো খাটো করে দেখছ না!”

সুচরিতা কহিল, “তার কারণ আছে বিনয়বাবু! আমাদের বাধাটা ঠিক বাইরের বাধা নয়। আমাদের সমাজ যে আমাদের ধর্মবিশ্বাসের উপরে প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু আপনি যে সমাজে আছেন সেখানে আপনার বন্ধন কেবলমাত্র সামাজিক বন্ধন। এইজন্যে যদি ললিতাকে ব্রাহ্মসমাজ পরিত্যাগ করে যেতে হয় তার সেটাতে যত গুরুতর ক্ষতি, আপনার সমাজত্যাগে আপনার ততটা ক্ষতি নয়।”

ধর্ম মানুষের ব্যক্তিগত সাধনার জিনিস, তাহাকে কোনো সমাজের সঙ্গে জড়িত করা উচিত নহে এই বলিয়া বিনয় তর্ক করিতে লাগিল।

এমন সময় সতীশ একখানি চিঠি ও একটি ইংরাজি কাগজ লইয়া ঘরে প্রবেশ করিল। বিনয়কে দেখিয়া সে অত্যন্ত উত্তেজিত হইয়া উঠিল– শুক্রবারকে কোনো উপায়ে রবিবার করিয়া তুলিবার জন্য তাহার মন ব্যস্ত হইতে লাগিল। দেখিতে দেখিতে বিনয়ে এবং সতীশে মিলিয়া সভা জমিয়া গেল। এ দিকে ললিতার চিঠি এবং তৎসহ প্রেরিত কাগজখানি সুচরিতা পড়িতে লাগিল।

এই ব্রাহ্ম কাগজটিতে একটি খবর ছিল যে, কোনো বিখ্যাত ব্রাহ্মপরিবারে হিন্দু- সমাজের সহিত বিবাহ-সম্বন্ধ ঘটিবার যে আশঙ্কা হইয়াছিল তাহা হিন্দুযুবকের অসম্মতিবশত কাটিয়া গিয়াছে। এই উপলক্ষে উক্ত হিন্দুযুবকের নিষ্ঠার সহিত তুলনা করিয়া ব্রাহ্মপরিবারের শোচনীয় দুর্বলতা সম্বন্ধে আক্ষেপ প্রকাশ করা হইয়াছে।

সুচরিতা মনে মনে কহিল, যেমন করিয়া হউক, বিনয়ের সহিত ললিতার বিবাহ ঘটাইতেই হইবে। কিন্তু সে তো এই যুবকের সঙ্গে তর্ক করিয়া হইবে না। ললিতাকে সুচরিতা তাহার বাড়িতে আসিবার জন্য চিঠি লিখিয়া দিল, তাহাতে বলিল না যে, বিনয় এখানে আছে।

কোনো পঞ্জিকাতেই কোনো গ্রহনক্ষত্রের সমাবেশে শুক্রবারে রবিবার পড়িবার ব্যবস্থা না থাকায় সতীশকে ইস্কুলে যাইতে প্রস্তুত হইবার জন্য উঠিতে হইল। সুচরিতাও স্নান করিতে যাইতে হইবে বলিয়া কিছুক্ষণের জন্য অবকাশ প্রার্থনা করিয়া চলিয়া গেল।

তর্কের উত্তেজনা যখন কাটিয়া গেল তখন সুচরিতার সেই একলা ঘরটিতে বসিয়া বিনয়ের ভিতরকার যুবাপুরুষটি জাগিয়া উঠিল। বেলা তখন নয়টা সাড়ে-নয়টা। গলির ভিতরে জনকোলাহল নাই। সুচরিতার লিখিবার টেবিলের উপর একটি ছোটো ঘড়ি টিক্‌ টিক্‌ করিয়া চলিতেছে। ঘরের একটি প্রভাব বিনয়কে আবিষ্ট করিয়া ধরিতে লাগিল। চারি দিকের ছোটোখাটো গৃহসজ্জাগুলি বিনয়ের সঙ্গে যেন আলাপ জুড়িয়া দিল। টেবিলের উপরকার পারিপাট্য, সেলাইয়ের কাজ-করা চৌকি-ঢাকাটি, চৌকির নীচে পাদস্থানের কাছে বিছানো একটা হরিণের চামড়া, দেয়ালে ঝোলানো দুটি-চারটি ছবি, পশ্চাতে লাল সালু দিয়া মোড়া বই-সাজানো বইয়ের ছোটো শেল্‌ফ্‌টি, সমস্তই বিনয়ের চিত্তের মধ্যে একটি গভীরতর সুর বাজাইয়া তুলিতে লাগিল। এই ঘরের ভিতরটিতে একটি কী সুন্দর রহস্য সঞ্চিত হইয়া আছে। এই ঘরে নির্জন মধ্যাহ্নে সখীতে সখীতে যে-সকল মনের কথা আলোচনা হইয়া গেছে তাহাদের সলজ্জ সুন্দর সত্তা এখনো যেন ইতস্তত প্রচ্ছন্ন হইয়া আছে; কথা আলোচনা করিবার সময় কোন্‌খানে কে বসিয়াছিল, কেমন করিয়া বসিয়াছিল, তাহা বিনয় কল্পনায় দেখিতে লাগিল। ঐ-যে সেদিন বিনয় পরেশবাবুর কাছে শুনিয়াছিল “আমি সুচরিতার কাছে শুনিয়াছি ললিতার মন তোমার প্রতি বিমুখ নহে’, এই কথাটিকে সে নানাভাবে নানারূপে নানাপ্রকার ছবির মতো করিয়া দেখিতে পাইল। একটা অনির্বচনীয় আবেগ বিনয়ের মনের মধ্যে অত্যন্ত করুণ উদাস রাগিণীর মতো বাজিতে লাগিল। যে-সব জিনিসকে এমনতরো নিবিড় গভীররূপে মনের গোপনতার মধ্যে ভাষাহীন আভাসের মতো পাওয়া যায় তাহাদিগকে কোনোমতে প্রত্যক্ষ করিয়া তুলিবার ক্ষমতা নাই বলিয়া, অর্থাৎ বিনয় কবি নয়, চিত্রকর নয় বলিয়া, তাহার সমস্ত অন্তঃকরণ চঞ্চল হইয়া উঠিল। সে যেন কী একটা করিতে পারিলে বাঁচে, অথচ সেটা করিবার কোনো উপায় নাই, এমনি তাহার মনে হইতে লাগিল। যে-একটা পর্দা তাহার সম্মুখে ঝুলিতেছে, যাহা অতি নিকটে তাহাকে নিরতিশয় দূর করিয়া রাখিয়াছে, সেই পর্দাটাকে কি এই মুহূর্তে উঠিয়া দাঁড়াইয়া জোর করিয়া ছিঁড়িয়া ফেলিবার শক্তি বিনয়ের নাই!

0 Shares