গোরা

“মাসিমা আপনার সঙ্গে দেখা করবার জন্যে অনেক দিন থেকে ব্যস্ত হয়ে রয়েছেন, তাঁকে খবর দিই গে” বলিয়া সুচরিতা ঘরে প্রবেশ করিয়াই চলিয়া গেল– সে একলা গোরার সঙ্গে আলাপ করিবার মতো জোর পাইল না।

কিছুক্ষণ পরে সুচরিতা হরিমোহিনীকে সঙ্গে করিয়া লইয়া আসিল। কিছুকাল হইতে হরিমোহিনী বিনয়ের কাছ হইতে গোরার মত বিশ্বাস ও নিষ্ঠা এবং তাহার জীবনের কথা শুনিয়া আসিতেছেন। প্রায় মাঝে মাঝে তাঁহার অনুরোধে সুচরিতা মধ্যাহ্নে তাঁহাকে গোরার লেখা পড়িয়া শুনাইয়াছে। যদিও সে-সব লেখা তিনি যে সমস্তই ঠিক বুঝিতে পারিতেন তাহা নহে এবং তাহাতে তাঁহার নিদ্রাকর্ষণেরই সুবিধা করিয়া দিত তবু এটুকু মোটামুটি বুঝিতে পারিতেন যে, শাস্ত্র ও লোকাচারের পক্ষ লইয়া গোরা এখনকার কালের আচারহীনতার বিরুদ্ধে লড়াই করিতেছে। আধুনিক ইংরেজি-শেখা ছেলের পক্ষে ইহা অপেক্ষা আশ্চর্য এবং ইহা অপেক্ষা গুণের কথা আর কী হইতে পারে! ব্রাহ্মপরিবারের মধ্যে প্রথম যখন বিনয়কে দেখিয়াছিলেন তখন বিনয়ই তাঁহাকে যথেষ্ট তৃপ্তিদান করিয়াছিল। কিন্তু ক্রমে সেটুকু অভ্যাস হইয়া যাওয়ার পর নিজের বাড়িতে যখন তিনি বিনয়কে দেখিতে লাগিলেন তখন তাহার আচারের ছিদ্রগুলিই তাঁহাকে বেশি করিয়া বাজিতে লাগিল। বিনয়ের উপর তিনি অনেকটা নির্ভর স্থাপন করিয়াছিলেন বলিয়াই, তাহার প্রতি ধিক্কার তাঁহার প্রতিদিন বাড়িয়া উঠিতেছে। সেইজন্যই অত্যন্ত উৎসুকচিত্তে তিনি গোরার প্রতীক্ষা করিতেছিলেন।

গোরার দিকে নেত্রপাত করিয়াই হরিমোহিনী একেবারে আশ্চর্য হইয়া গেলেন। এই তো ব্রাহ্মণ বটে! যেন একেবারে হোমের আগুন। যেন শুভ্রকায় মহাদেব। তাঁহার মনে এমন একটি ভক্তির সঞ্চার হইল যে, গোরা যখন তাঁহাকে প্রণাম করিল তখন সে প্রণাম গ্রহণ করিতে হরিমোহিনী কুণ্ঠিত হইয়া উঠিলেন।

হরিমোহিনী কহিলেন, “তোমার কথা অনেক শুনেছি বাবা! তুমিই গৌর? গৌরই বটে! ঐ-যে কীর্তনের গান শুনেছি–

চাঁদের অমিয়া-সনে চন্দন বাঁটিয়া গো

কে মাজিল গোরার দেহখানি–

আজ তাই চক্ষে দেখলুম। কোন্‌ প্রাণে তোমাকে জেলে দিয়েছিল আমি সেই কথাই ভাবি।”

গোরা হাসিয়া কহিল, “আপনারা যদি ম্যাজিস্ট্রেট হতেন তা হলে জেলখানায় ইঁদুর বাদুড়ের বাসা হত।”

হরিমোহিনী কহিলেন, “না বাবা, পৃথিবীতে চোর-জুয়াচোরের অভাব কী? ম্যাজিস্ট্রেটের কি চোখ ছিল না? তুমি যে যে-সে কেউ নও, তুমি যে ভগবানের লোক, সে তো মুখের দিকে তাকালেই টের পাওয়া যায়। জেলখানা আছে বলেই কি জেলে দিতে হবে! বাপ রে! এ কেমন বিচার!”

গোরা কহিল, “মানুষের মুখের দিকে তাকালে পাছে ভগবানের রূপ চোখে পড়ে তাই ম্যাজিস্ট্রেট কেবল আইনের বইয়ের দিকে তাকিয়ে কাজ করে। নইলে মানুষকে চাবুক জেল দ্বীপান্তর ফাঁসি দিয়ে কি তাদের চোখে ঘুম থাকত, না মুখে ভাত রুচত?”

হরিমোহিনী কহিলেন, “যখনই ফুরসত পাই রাধারানীর কাছ থেকে তোমার বই পড়িয়ে শুনি। কবে তোমার নিজের মুখ থেকে ভালো ভালো সব কথা শুনতে পাব মনে এই প্রত্যাশা করে এতদিন ছিলুম। আমি মূর্খ মেয়েমানুষ, আর বড়ো দুঃখিনী, সব কথা বুঝিও নে, আবার সব কথায় মনও দিতে পারি নে। কিন্তু বাবা, তোমার কাছ থেকে কিছু জ্ঞান পাব এ আমার খুব বিশ্বাস হয়েছে।”

গোরা বিনয়সহকারে এ কথার কোনো প্রতিবাদ না করিয়া চুপ করিয়া রহিল।

হরিমোহিনী কহিলেন, “বাবা, তোমাকে কিছু খেয়ে যেতে হবে। তেমার মতো ব্রাহ্মণের ছেলেকে আমি অনেক দিন খাওয়াই নি। আজকের যা আছে তাই দিয়ে মিষ্টিমুখ করে যাও, কিন্তু আর-এক দিন আমার ঘরে তোমার নিমন্ত্রণ রইল।”

এই বলিয়া হরিমোহিনী যখন আহারের ব্যবস্থা করিতে গেলেন তখন সুচরিতার বুকের ভিতর তোলপাড় করিতে লাগিল।

গোরা একেবারে আরম্ভ করিয়া দিল, “বিনয় আজ আপনার এখানে এসেছিল?”

সুচরিতা কহিল, “হাঁ।”

গোরা কহিল, “তার পরে বিনয়ের সঙ্গে আমার দেখা হয় নি, কিন্তু আমি জানি কেন সে এসেছিল।”

গোরা একটু থামিল, সুচরিতাও চুপ করিয়া রহিল।

গোরা কহিল, “আপনারা ব্রাহ্মমতে বিনয়ের বিবাহ দেবার চেষ্টা করছেন। এটা কি ভালো করছেন?”

এই খোঁচাটুকু খাইয়া সুচরিতার মন হইতে লজ্জা-সংকোচের জড়তা একেবারে দূর হইয়া গেল। সে গোরার মুখের দিকে চোখ তুলিয়া কহিল, “ব্রাহ্মমতে বিবাহকে ভালো কাজ বলে মনে করব না এই কি আপনি আমার কাছ থেকে প্রত্যাশা করেন?”

গোরা কহিল, “আপনার কাছে আমি কোনোরকম ছোটো প্রত্যাশা করি নে, এ আপনি নিশ্চয় জানবেন। সম্প্রদায়ের লোকের কাছ থেকে মানুষ যেটুকু প্রত্যাশা করতে পারে আমি আপনার কাছ থেকে তার চেয়ে অনেক বেশি করি। কোনো একটা দলকে সংখ্যায় বড়ো করে তোলাই যে-সমস্ত কুলির সর্দারের কাজ আপনি সে শ্রেণীর নন, এ আমি খুব জোর করে বলতে পারি। আপনি নিজেও যাতে নিজেকে ঠিকমত বুঝতে পারেন এইটে আমার ইচ্ছা। অন্য পাঁচজনের কথায় ভুলে আপনি নিজেকে ছোটো বলে জানবেন না। আপনি কোনো একটি দলের লোকমাত্র নন, এ কথাটা আপনাকে নিজের মনের মধ্যে থেকে নিজে স্পষ্ট বুঝতে হবে।”

সুচরিতা মনের সমস্ত শক্তিকে জাগাইয়া সতর্ক হইয়া শক্ত হইয়া বসিল। কহিল, “আপনিও কি কোনো দলের লোক নন?”

গোরা কহিল, “আমি হিন্দু। হিন্দু তো কোনে দল নয়। হিন্দু একটা জাতি। এ জাতি এত বৃহৎ যে কিসে এই জাতির জাতিত্ব তা কোনো সংজ্ঞার দ্বারা সীমাবদ্ধ করে বলাই যায় না। সমুদ্র যেমন ঢেউ নয়, হিন্দু তেমনি দল নয়।”

0 Shares