গোরা

বিরুদ্ধপক্ষের সহিত তর্ক করিবার সময় গোরার মনে কোনদিন এতটুকু দয়ার সঞ্চার হয় নাই। বরঞ্চ এ সম্বন্ধে শিকারি জন্তুর মতো তাহার মনে একটা কঠোর হিংস্রতা ছিল। কিন্তু সুচরিতার নিরুত্তর পরাভবে আজ তাহার মন কেমন ব্যথিত হইতে লাগিল। সে কণ্ঠস্বরকে কোমল করিয়া কহিল, “তোমাদের ধর্মমতের বিরুদ্ধে আামি কোনো কথা বলতে চাই নে। আমার কথাটুকু কেবল এই, তুমি যাকে ঠাকুর বলে নিন্দা করছ সেই ঠাকুরটি যে কী তা শুধু চোখে দেখে জানাই যায় না; তাতে যার মন স্থির হয়েছে, হৃদয় তৃপ্ত হয়েছে, যার চরিত্র আশ্রয় পেয়েছে, সেই জানে সে ঠাকুর মৃন্ময় কি চিন্ময়, সমীম কি অসীম। আমি তোমাকে বলছি, আমাদের দেশের কোনো ভক্তই সসীমের পূজা করে না–সীমার মধ্যে সীমাকে হারিয়ে ফেলা ঐ তো তাদের ভক্তির আনন্দ।”

সুচরতা কহিল, “কিন্তু সবাই তো ভক্ত নয়।”

গোরা কহিল, “যে ভক্ত নয় সে কিসের পূজা করে তাতে কার কী আসে যায়? ব্রাহ্মসমাজে যে লোক ভক্তিহীন সে কী করে? তার সমস্ত পূজা অতলস্পর্শ শূন্যতার মধ্যে গিয়ে পড়ে। না, শূন্যতার চেয়ে ভয়ানক– দলাদলিই তার দেবতা, অহংকারই তার পুরোহিত। এই রক্তপিপাসু দেবতার পূজা তোমাদের সমাজে কি কখনো দেখ নি?”

এই কথার কোনো উত্তর না দিয়া সুচরতা গোরাকে জিজ্ঞাসা করিল, “ধর্মসম্বন্ধে আপনি এই যা-সব বলছেন এ কি আপনি নিজের অভিজ্ঞতার থেকে বলছেন?”

গোরা ঈষৎ হাসিয়া কহিল, “অর্থাৎ, তুমি জানতে চাও, আমি কোনোদিনই ঈশ্বরকে চেয়েছি কি না। না, আমার মন ও দিকেই যায় নি।”

সুচরিতার পক্ষে এ কথা খুশি হইবার কথা নহে, কিন্তু তবু তাহার মন যেন হাঁপ ছাড়িয়া বাঁচিল। এইখানে জোর করিয়া কোনো কথা বলিবার অধিকার যে গোরার নাই ইহাতে সে একপ্রকার নিশ্চিন্ত হইল।

গোরা কহিল, “কাউকে ধর্মশিক্ষা দিতে পারি এমন দাবি আামার নেই। কিন্তু আমাদের দেশের লোকের ভক্তিকে তোমার যে উপহাস করবে এও আমি কোনোদিন সহ্য করতে পারব না। তুমি তোমার দেশের লোককে ডেকে বলছ–তোমরা মূঢ়, তোমরা পৌত্তলিক। আমি তাদের সবাইকে আহ্বান করে জানাতে চাই–না, তোমরা মূঢ় নও, তোমরা পৌত্তলিক নও, তোমরা জ্ঞানী, তোমরা ভক্ত। আমাদের ধর্মতত্ত্বে যে মহত্ত্ব আছে, ভক্তিতত্ত্বে যে গভীরতা আছে, শ্রদ্ধাপ্রকাশের দ্বারা সেইখানেই আমার দেশের হৃদয়কে আমি জাগ্রত করতে চাই। যেখানে তার সম্পদ আছে সেইখানে তার অভিমানকে আমি উদ্যত করে তুলতে চাই। আমি তার মাথা হেঁট করে দেব না ; নিজের প্রতি তার ধিক্কার জন্মিয়ে নিজের সত্যের প্রতি তাকে অন্ধ করে তুলব না, এই আমার পণ। তোমার কাছেও আজ আমি এইজন্যেই এসেছি। তোমাকে দেখে অবধি একটি নূতন কথা দিনরাত্রি আমার মাথায় ঘুরছে। এতদিন সে কথা আমি ভাবি নি। কেবলই আমার মনে হচ্ছে–কেবল পুরুষের দৃষ্টিতেই তো ভারতবর্ষ সম্পূর্ণ প্রত্যক্ষ হবেন না। আমাদের মেয়েদের চোখের সামনে যেদিন আবির্ভূত হবেন সেইদিনই তাঁর প্রকাশ পূর্ণ হবে। তোমার সঙ্গে একসঙ্গে একদৃষ্টিতে আমি আমার দেশকে সন্মুখে দেখব এই একটি আকাঙক্ষা যেন আমাকে দগ্ধ করছে। আমার ভারতবর্ষের জন্য আমি পুরুষ তো কেবলমাত্র খেটে মরতে পারি–কিন্তু তুমি না হলে প্রদীপ জ্বেলে তাঁকে বরণ করবে কে? ভারতবর্ষের সেবা সুন্দর হবে না, তুমি যদি তাঁর কাছ থেকে দূরে থাক।”

হায়, কোথায় ছিল ভারতবর্ষ! কোন্‌ সুদূরে ছিল সুচরিতা! কোথা হইতে আসিল ভারতবর্ষের এই সাধক, এই ভাবে-ভোলা তাপস! সকলকে ঠেলিয়া কেন সে তাহারই পাশে আসিয়া দাঁড়াইল! সকলকে ছাড়িয়া কেন সে তাহাকেই আহ্বান করিল! কোনো সংশয় করিল না, বাধা মানিল না। বলিল–“তোমাকে নহিলে চলিবে না, তোমাকে লইবার জন্য আসিয়াছি, তুমি নির্বাসিত হইয়া থাকিলে যজ্ঞ সম্পূর্ণ হইবে না।’ সুচরিতার দুই চক্ষু দিয়া ঝর্‌ ঝর্‌ করিয়া জল পড়িতে লাগিল, কেন তাহা সে বুঝিতে পারিল না।

গোরা সুচরিতার মুখের দিকে চাহিল। সেই দৃষ্টির সন্মুখে সুচরিতা তাহার আশ্রুবিগলিত দুই চক্ষু নত করিল না। চিন্তাবিহীন শিশিরমণ্ডিত ফুলের মতো তাহা নিতান্ত আত্মবিস্মৃতভাবে গোরার মুখের দিকে ফুটিয়া রহিল।

সুচরিতার সেই সংকোচবিহীন অশ্রুধারাপ্লাবিত দুই চক্ষুর সন্মুখে, ভূমিকম্পে পাথরের রাজপ্রাসাদ যেমন টলে তেমনি করিয়া গোরার সমস্ত প্রকৃতি যেন টলিতে লাগিল। গোরা প্রাণপণ বলে আপনাকে সংবরণ করিয়া লইবার জন্য মুখ ফিরাইয়া জানালার বাহিরের দিকে চাহিল। তখন সন্ধ্যা হইয়া গিয়াছে। গলির রেখা সংকীর্ণ হইয়া যেখানে বড়ো রাস্তায় পড়িয়াছে সেখানে খোলা আাকাশে কালো পাথরের মতো অন্ধকারের উপর তারা দেখা যাইতেছে। সেই আকাশখণ্ড, সেই ক’টি তারা গোরার মনকে আজ কোথায় বহন করিয়া লইয়া গেল–সংসারের সমস্ত দাবি হইতে, এই অভ্যস্ত পৃথিবীর প্রতিদিনের সুনির্দিষ্ট কর্মপদ্ধতি হইতে কত দূরে! রাজ্যসাম্রাজ্যের কত উত্থানপতন, যুগযুগান্তরের কত প্রয়াস ও প্রার্থনাকে বহুদূরে অতিক্রম করিয়া ঐটুকু আকাশ এবং ঐ ক’টি তারা সম্পূর্ণ নির্লিপ্ত হইয়া অপেক্ষা করিয়া আছে; অথচ, অতলস্পর্শ গভীরতার মধ্য হইতে এক হৃদয় যখন আর-এক হৃদয়কে আহ্বান করে তখন নিভৃত জগৎপ্রান্তের সেই বাক্যহীন ব্যাকুলতা যেন ঐ দূর আকাশ এবং দূর তারাকে স্পন্দিত করিতে থাকে। কর্মরত কলিকাতার পথে গাড়িঘোড়া ও পথিকের চলাচল এই মুহূর্তে গোরার চক্ষে ছায়াছবির মতো বস্তুহীন হইয়া গেল– নগরের কোলাহল কিছুই তাহার কাছে আর পৌঁছিল না। নিজের হৃদয়ের দিকে চাহিয়া দেখিল–সেও ঐ আকাশের মতো নিস্তব্ধ, নিভৃত, অন্ধকার, এবং সেখানে জলে-ভরা দুইটি সরল সকরুণ চক্ষু নিমেষ হারাইয়া যেন অনাদিকাল হইতে অনন্তকালের দিকে তাকাইয়া আছে।

0 Shares