গোরা

হরিমোহিনীর কণ্ঠ শুনিয়া গোরা চমকিয়া উঠিয়া মুখ ফিরাইল।

“বাবা, কিছু মিষ্টিমুখ করে যাও।”

গোরা তাড়াতাড়ি বলিয়া উঠিল, “আজ কিন্তু নয়। আজ আমাকে মাপ করতে হবে–আমি এখনই যাচ্ছি।”

বলিয়া গোরা আর-কোনো কথার অপেক্ষা না করিয়া দ্রুতবেগে বাহির হইয়া চলিয়া গেল।

হরিমোহিনী বিস্মিত হইয়া সুচরিতার মুখের দিকে চাহিলেন। সুচরিতা ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল। হরিমোহিনী মাথা নাড়িয়া ভাবিতে লাগিলেন– এ আাবার কী কাণ্ড!

অনতিকাল পরেই পরেশবাবু আসিয়া উপস্থিত হইলেন। সুচরিতার ঘরে সুচরিতাকে দেখিতে না পাইয়া হরিমোহিনীকে গিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “রাধারানী কোথায়?”

হরিমোহিনী বিরক্তির কণ্ঠে কহিলেন, “কি জানি, এতক্ষণ তো গৌরমোহনের সঙ্গে বসবার ঘরে আলাপ চলছিল, তার পরে এখন বোধ হয় ছাতে একলা পায়চারি হচ্ছে।”

পরেশ আশ্চর্য হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, ” এই ঠাণ্ডায় এত রাত্রে ছাতে?”

হরিমোহিনী কহিলেন, “একটু ঠাণ্ডা হয়েই নিক। এখনকার মেয়েদের ঠাণ্ডায় অপকার হবে না।”

হরিমোহিনীর মন আজ খারাপ হইয়া গিয়াছে বলিয়া তিনি রাগ করিয়া সুচরিতাকে খাইতে ডাকেন নাই। সুচরিতারও আজ সময়ের জ্ঞান ছিল না।

হঠাৎ স্বয়ং পরেশবাবুকে ছাতে আসিতে দেখিয়া সুচরিতা অত্যন্ত লজ্জিত হইয়া উঠিল। কহিল, “বাবা, চলো, নীচে চলো, তোমার ঠাণ্ডা লাগবে।”

ঘরে আসিয়া প্রদীপের আালোকে পরেশের উদ্‌বিগ্ন মুখ দেখিয়া সুচরিতার মনে খুব একটা ঘা লাগিল। এতদিন যিনি পিতৃহীনার পিতা এবং গুরু ছিলেন, আশৈশবের সমস্ত বন্ধন বিচ্ছিন্ন করিয়া তাঁহার কাছ হইতে কে আজ সুচরিতাকে দূরে টানিয়া লইয়া যাইতেছে? সুচরিতা কিছুতেই যেন নিজেকে ক্ষমা করিতে পারিল না। পরেশ ক্লান্তভাবে চৌকিতে বসিলে পর দুর্নিবার অশ্রুকে গোপন করিবার জন্য সুচরিতা তাঁহার চৌকির পশ্চাতে দাঁড়াইয়া ধীরে ধীরে তাঁহার পক্ককেশের মধ্যে অঙ্গুলি চালনা করিয়া দিতে লাগিল।

পরেশ কহিলেন, “বিনয় দীক্ষা গ্রহণ করতে অসম্মত হয়েছেন।”

সুচরিতা কোনো উত্তর করিল না। পরেশ কহিলেন, “বিনয়ের দীক্ষাগ্রহণের প্রস্তাবে আমার মনে যথেষ্ট সংশয় ছিল, সেইজন্যে আমি এতে বিশেষ ক্ষূণ্ন হই নি–কিন্তু ললিতার কথার ভাবে বুঝতে পারছি দীক্ষা না হলেও বিনয়ের সঙ্গে বিবাহে সে কোনো বাধা অনুভব করছে না।”

সুচরিতা হঠাৎ খুব জোরের সহিত বলিয়া উঠিল, “না বাবা, সে কখনোই হতে পারবে না। কিছুতেই না।”

সুচরিতা সচরাচর এমন অনাবশ্যক ব্যগ্রতা প্রকাশ করিয়া কথা কয় না, সেইজন্য তাহার কণ্ঠস্বরে এই আকস্মিক আবেগের প্রবলতায় পরেশ মনে মনে একটু আশ্চর্য হইলেন এবং জিজ্ঞাসা করিলেন, “কী হতে পারবে না?”

সুচরিতা কহিল, “বিনয় ব্রাহ্ম না হলে কোন্‌ মতে বিয়ে হবে?”

পরেশ কহিলেন, “হিন্দুমতে।”

সুচরিতা সবেগে ঘাড় নাড়িয়া কহিল, ” না না, আজকাল এ-সব কী কথা হচ্ছে? এমন কথা মনেও আনা উচিত নয়। শেষকালে ঠাকুরপুজো করে ললিতার বিয়ে হবে! এ কিছুতেই হতে দিতে পারব না!”

গোরা নাকি সুচরিতার মন টানিয়া লইয়াছে, তাই সে আজ হিন্দুমতে বিবাহের কথায় এমন একটা অস্বাভাবিক আক্ষেপ প্রকাশ করিতেছে। এই আক্ষেপের ভিতরকার আসল কথাটা এই যে, পরেশকে সুচরিতা এক জায়গায় দৃঢ় করিয়া ধরিয়া বলেতেছে–“তোমাকে ছাড়িব না, আমি এখনো তোমার সমাজের, তোমার মতের, তোমার শিক্ষার বন্ধন কোনোমতেই ছিঁড়িতে দিব না।’

পরেশ কহিলেন, “বিবাহ-অনুষ্ঠানে শালগ্রামের সংস্রব বাদ দিতে বিনয় রাজি হয়েছে।”

সুচরিতা চৌকির পিছন হইতে আসিয়া পরেশের সম্মুখে চৌকি লইয়া বসিল। পরেশ তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “এতে তুমি কী বল?”

সুচরিতা একটু চুপ করিয়া কহিল, “আমাদের সমাজ থেকে ললিতাকে তা হলে বেরিয়ে যেতে হবে।”

পরেশ কহিলেন, “এই কথা নিয়ে আমাকে অনেক চিন্তা করতে হয়েছে। কোনো মানুষের সঙ্গে সমাজের যখন বিরোধ বাধে তখন দুটো কথা ভেবে দেখবার আাছে, দুই পক্ষের মধ্যে ন্যায় কোন্‌ দিকে এবং প্রবল কে? সমাজ প্রবল তাতে সন্দেহ নেই, অতএব বিদ্রোহীকে দুঃখ পেতে হবে। ললিতা বাবংবার আমাকে বলছে, দুঃখ স্বীকার করতে সে যে শুধু প্রস্তুত তা নয়, এতে সে আনন্দ বোধ করছে। এ কথা যদি সত্য হয় তা হলে অন্যায় না দেখলে আমি তাকে বাধা দেব কী করে?”

সুচরিতা কহিল, “কিন্তু বাবা, এ কী রকম হবে!”

পরেশ কহিলেন, “জানি এতে একটা সংকট উপস্থিত হবে। কিন্তু ললিতার সঙ্গে বিনয়ের বিবাহে যখন দোষ কিছু নেই, এমন-কি, সেটা উচিত, তখন সমাজে যদি বাধে তবে সে বাধা মানা কর্তব্য নয় বলে আমার মন বলছে। মানুষকেই সমাজের খাতিরে সংকুচিত হয়ে থাকতে হবে এ কথা কখনোই ঠিক নয়–সমাজকেই মানুষের খাতিরে নিজেকে কেবলই প্রশস্ত করে তুলতে হবে। সেজন্যে যারা দুঃখ স্বীকার করতে রাজি আছে আমি তো তাদের নিন্দা করতে পারব না।”

সুচরিতা কহিল, “বাবা, এতে তোমাকেই সব চেয়ে বেশি দুঃখ পেতে হবে।”

পরেশ কহিলেন, ” সে কথা ভাবার কথাই নয়।”

সুচরিতা জিজ্ঞাসা করিল, “বাবা, তুমি কি সম্মতি দিয়েছ?”

পরেশ কহিলেন, ” না, এখনো দিই নি। কিন্তু দিতেই হবে। ললিতা যে পথে যাচ্ছে সে পথে আমি ছাড়া কে তাকে আশীর্বাদ করবে আর ঈশ্বর ছাড়া কে তার সহায় আছেন?”

পরেশবাবু যখন চলিয়া গেলেন তখন সুচরিতা স্তম্ভিত হইয়া বসিয়া রহিল। সে জানিত পরেশ ললিতাকে মনে মনে কত ভালোবাসেন, সেই ললিতা বাঁধা পথ ছাড়িয়া দিয়া এতবড়ো একটা অনির্দেশ্যের মধ্যে প্রবেশ করিতে চলিয়াছে, ইহাতে তাঁহার মন যে কত উদ্‌বিগ্ন তাহা তাহার বুঝিতে বাকি ছিল না–তৎসত্ত্বে এই বয়সে তিনি এমন একটা বিপ্লবে সহায়তা করিতে চলিয়াছেন, অথচ ইহার মধ্যে বিক্ষোভ কতই অল্প! নিজের জোর তিনি কোথাও কিছুমাত্র প্রকাশ করেন নাই, কিন্তু তাঁর মধ্যে কতবড়ো একটা জোর অনায়াসেই আত্মগোপন করিয়া আছে!

0 Shares