গোরা

সে বলিয়া উঠিল, “ভাই গোরা, তুমি আমাকে ভুল বুঝো না। জীবনে অনেক পরিবর্তন ঘটে, অনেক জিনিস ত্যাগ করতে হয়, কিন্তু তাই বলে বন্ধুত্ব কেন ত্যাগ করব।”

গোরা কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া কহিল, “বিনয়, তুমি কি ব্রাহ্মসমাজে দীক্ষা গ্রহণ করেছ?”

বিনয় কহিল, “না গোরা, করি নি, এবং করবও না। কিন্তু সেটার উপর আমি কোনো জোর দিতে চাই নে।”

গোরা কহিল, “তার মানে কী?”

বিনয় কহিল, “তার মানে এই যে, আমি ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষা নিলুম কি না-নিলুম, সেই কথাটাকে অত্যন্ত তুমুল করে তোলবার মতো মনের ভাব আমার এখন আর নেই।”

গোরা জিজ্ঞাসা করিল, “পূর্বেই বা মনের ভাব কী রকম ছিল আর এখনই বা কী রকম হয়েছে জিজ্ঞাসা করি।”

গোরার কথার সুরে বিনয়ের মন আবার একবার যুদ্ধের জন্য কোমর বাঁধিতে বসিল। সে কহিল, “আগে যখন শুনতুম কেউ ব্রাহ্ম হতে যাচ্ছে মনের মধ্যে খুব একটা রাগ হত, সে যেন বিশেষরূপ শাস্তি পায় এই আমার ইচ্ছা হত। কিন্তু এখন আমার তা হয় না। আমার মনে হয় মতকে মত দিয়ে যুক্তিকে যুক্তি দিয়েই বাধা দেওয়া চলে, কিন্তু বুদ্ধির বিষয়কে ক্রোধ দিয়ে দণ্ড দেওয়া বর্বরতা।”

গোরা কহিল, “হিন্দু ব্রাহ্ম হচ্ছে দেখলে এখন আর রাগ হবে না, কিন্তু ব্রাহ্ম প্রায়শ্চিত্ত করে হিন্দু হতে যাচ্ছে দেখলে রাগে তোমার অঙ্গ জ্বলতে থাকবে, পূর্বের সঙ্গে তোমার এই প্রভেদটা ঘটেছে।”

বিনয় কহিল, “এটা তুমি আমার উপর রাগ করে বলছ, বিচার করে বলছ না।”

গোরা কহিল, “আমি তোমার ‘পরে শ্রদ্ধা করেই বলছি, এইরকম হওয়াই উচিত ছিল– আমি হলেও এইরকম হত। বহুরূপী যেরকম রঙ বদলায় ধর্মমত গ্রহণ ও ত্যাগ যদি সেইরকম আমাদের চামড়ার উপরকার জিনিস হত তা হলে কোনো কথাই ছিল না, কিন্তু সেটা মর্মের জিনিস বলেই সেটাকে হালকা করতে পারি নি। যদি কোনোরকম বাধা না থাকে, যদি দণ্ডের মাশুল না দিতে হয়, তা হলে গুরুতর বিষয়ে একটা মত গ্রহণ বা পরিবর্তনের সময় মানুষ নিজের সমস্ত বুদ্ধিকে জাগাবে কেন? সত্যকে যথার্থ সত্য বলেই গ্রহণ করছি কি না মানুষকে তার পরীক্ষা দেওয়া চাই। দণ্ড স্বীকার করতেই হবে। মূল্যটা এড়িয়ে রত্নটুকু পাবে সত্যের কারবার এমন শৌখিন কারবার নয়।”

তর্কের মুখে আর কোনো বল্‌গা রহিল না। কথার উপরে কথা বাণের উপরে বাণের মতো আসিয়া পড়িয়া পরস্পর সংঘাতে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ বর্ষণ করিতে লাগিল।

অবশেষে অনেকক্ষণ বাগ্‌যুদ্ধের পর বিনয় উঠিয়া দাঁড়াইয়া কহিল, “গোরা, তোমার এবং আমার প্রকৃতির মধ্যে একটা মূলগত প্রভেদ আছে। সেটা এতদিন কোনোমতে চাপা ছিল–যখনই মাথা তুলতে চেয়েছে আমিই তাকে নত করেছি, কেননা আমি জানতুন যেখানে তুমি কোনো পার্থক্য দেখ সেখানে তুমি সন্ধি করতে জান না, একেবারে তলোয়ার হাতে ছুটতে থাক। তাই তোমার বন্ধুত্বকে রক্ষা করতে গিয়ে আমি চিরদিনই নিজের প্রকৃতিকে খর্ব করে এসেছি। আজ বুঝতে পারছি এতে মঙ্গল হয় নি এবং মঙ্গল হতে পারে না।”

গোরা কহিল, “এখন তোমার অভিপ্রায় কী আমাকে খুলো বলো।”

বিনয় কহিল, “আজ আমি একলা দাঁড়ালুম। সমাজ বলে রাক্ষসের কাছে প্রতিদিন মানুষ-বলি দিয়ে কোনোমতে তাকে ঠাণ্ডা করে রাখতে হবে এবং যেমন করে হোক তারই শাসনপাশ গলায় বেঁধে বেড়াতে হবে, তাতে প্রাণ থাক্‌ আর না-থাক্‌, এ আমি কোনোমতেই স্বীকার করতে পারব না।”

গোরা কহিল, “মহাভারতের সেই ব্রাহ্মণশিশুটির মতো খড়কে নিয়ে বকাসুর বধ করতে বেরোবে না কি?”

বিনয় কহিল, “আমার খড়কেতে বকাসুর মরবে কি না তা জানি নে, কিন্তু আমাকে চিবিয়ে খেয়ে ফেলবার অধিকার যে তার আছে এ কথা আমি কোনোমতেই মানব না–যখন সে চিবিয়ে খাচ্ছে তখনো না।”

গোরা কহিল, “এ-সমস্ত তুমি রূপক দিয়ে কথা বলছ, বোঝা কঠিন হয়ে উঠছে।”

বিনয় কহিল, “বোঝা তোমার পক্ষে কঠিন নয়, মানাই তোমার পক্ষে কঠিন। মানুষ যেখানে স্বভাবত স্বাধীন, ধর্মত স্বাধীন, আমাদের সমাজ সেখানে তার খাওয়া-শোওয়া-বসাকেও নিতান্ত অর্থহীন বন্ধনে বেঁধেছে এ কথা তুমি আমার চেয়ে কম জান তা নয় ; কিন্তু এই জবরদস্তিকে তুমি জবরদস্তির দ্বারাই মানতে চাও। আমি আজ বলছি, এখানে আমি কারো জোর মানব না। সমাজের দাবিকে আমি ততক্ষণ পর্যন্ত স্বীকার করব যতক্ষণ সে আমার উচিত দাবিকে রক্ষা করবে। সে যদি আমাকে মানুষ বলে গণ্য না করে, আমাকে কলের পুতুল করে বানাতে চায়, আমিও তাকে ফুলচন্দন দিয়ে পূজা করব না–লোহার কল বলেই গণ্য করব।”

গোরা কহিল, “অর্থাৎ, সংক্ষেপে, তুমি ব্রাহ্ম হবে?”

বিনয় কহিল, “না।”

গোরা কহিল, “ললিতাকে তুমি বিয়ে করবে?”

বিনয় কহিল, “হাঁ।”

গোরা জিজ্ঞাসা করিল, “হিন্দুবিবাহ?”

বিনয় কহিল, “হাঁ।”

গোরা। পরেশবাবু তাতে সম্মত আছেন?

বিনয়। এই তাঁর চিঠি।

গোরা পরেশের চিঠি দুইবার করিয়া পড়িল। তাহার শেষ অংশে ছিল–

“আমার ভালো মন্দ লাগার কোনো কথা তুলিব না, তোমাদের সুবিধা-অসুবিধার কোনো কথাও পাড়িতে চাই না। আমার মত-বিশ্বাস কী, আমার সমাজ কী, সে তোমরা জান, ললিতা ছেলেবেলা হইতে কী শিক্ষা পাইয়াছে এবং কী সংস্কারের মধ্যে মানুষ হইয়াছে তাও তোমাদের অবিদিত নাই। এ-সমস্তই জানিয়া শুনিয়া তোমাদের পথ তোমরা নির্বাচন করিয়া লইয়াছ। আমার আর কিছুই বলিবার নাই। মনে করিয়ো না, আমি কিছুই না ভাবিয়া অথবা ভাবিয়া না পাইয়া হাল ছাড়িয়া দিয়াছি। আমার যতদূর শক্তি আমি চিন্তা করিয়াছি। ইহা বুঝিয়াছি তোমাদের মিলনকে বাধা দিবার কোনো ধর্মসংগত কারণ নাই, কেননা, তোমার প্রতি আমার সম্পূর্ণ শ্রদ্ধা আছে। এ স্থলে সমাজে যদি কোনো বাধা থাকে তবে তাহাকে স্বীকার করিতে তোমরা বাধ্য নও। আমার কেবল এইটুকুমাত্র বলিবার আছে, সমাজকে যদি তোমরা লঙ্ঘন করিতে চাও তবে সমাজের চেয়ে তোমাদিগকে বড়ো হইতে হইবে। তোমাদের প্রেম, তোমাদের সম্মিলিত জীবন, কেবল যেন প্রলয়শক্তির সূচনা না করে, তাহাতে সৃষ্টি ও স্থিতির তত্ত্ব থাকে যেন। কেবল এই একটা কাজের মধ্যে হঠাৎ একটা দুঃসাহসিকতা প্রকাশ করিলে চলিবে না, ইহার পরে তোমাদের জীবনের সমস্ত কাজকে বীরত্বের সূত্রে গাঁথিয়া তুলিতে হইবে–নহিলে তোমরা অত্যন্ত নামিয়া পড়িবে। কেননা, বাহির হইতে সমাজ তোমাদিগতে সর্বসাধারণের সমান ক্ষেত্রে আর বহন করিয়া রাখিবে না, তোমরা নিজের শক্তিতে এই সাধারণের চেয়ে বড়ো যদি না হও তবে সাধারণের চেয়ে তোমাদিগকে নামিয়া যাইতে হইবে। তোমাদের ভবিষ্যৎ শুভাশুভের জন্য আমার মনে যথেষ্ট আশঙ্কা রহিল। কিন্তু এই আশঙ্কার দ্বারা তোমাদিগতে বাধা দিবার কোনো অধিকার আমার নাই- কারণ, পৃথিবীতে যাহারা সাহস করিয়া নিজের জীবনের দ্বারা নব নব সমস্যার মীমাংসা করিতে প্রস্তুত হয় তাহারাই সমাজকে বড়ো করিয়া তুলে। যাহারা কেবলই বিধি মানিয়া চলে তাহারা সমাজকে বহন করে মাত্র, তাহাকে অগ্রসর করে না। অতএব আমার ভীরুতা আমার দুশ্চিন্তা লইয়া তোমাদের পথ আমি রোধ করিব না। তোমরা যাহা ভালো বুঝিয়াছ সমস্ত প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে তাহা পালন করো, ঈশ্বর তোমাদের সহায় হউন। ঈশ্বর কোনো-এক অবস্থার মধ্যে তাঁহার সৃষ্টিকে শিকল দিয়া বাঁধিয়া রাখেন না, তাহাকে নব নব পরিণতির মধ্যে চির নবীন করিয়া জাগাইয়া তুলিতেছেন; তোমরা তাঁহার সেই উদ্‌বোধনের দূতরূপে নিজের জীবনকে মশালের মতো জ্বালাইয়া দুর্গম পথে অগ্রসর হইতে চলিয়াছ, যিনি বিশ্বের পথচালক তিনিই তোমাদিগকে পথ দেখান–আমার পথেই তোমাদিগকে চিরদিন চলিতে হইবে এমন অনুশাসন আমি প্রয়োগ করিতে পারিব না। তোমাদের বয়সে আমরাও একদিন ঘাট হইতে রশি খুলিয়া ঝড়ের মুখে নৌকা ভাসাইয়াছিলাম, কাহারো নিষেধ শুনি নাই। আজও তাহার জন্য অনুতাপ করি না। যদিই অনুতাপ করিবার কারণ ঘটিত তাহাতেই বা কী? মানুষ ভুল করিবে, ব্যর্থও হইবে, দুঃখও পাইবে, কিন্তু বসিয়া থাকিবে না; যাহা উচিত বলিয়া জানিবে তাহার জন্য আত্মসমর্পণ করিবে; এমনি করিয়াই পবিত্রসলিলা সংসারনদীর স্রোত চিরদিন প্রবহমান হইয়া বিশুদ্ধ থাকিবে। ইহাতে মাঝে মাঝে ক্ষণকালের জন্য তীর ভাঙিয়া ক্ষতি করিতে পারে এই আশঙ্কা করিয়া চিরদিনের জন্য স্রোত বাঁধিয়া দিলে মারীকে আহ্বান করিয়া আনা হইবে–ইহা আমি নিশ্চয় জানি। অতএব, যে শক্তি তোমাদিগকে দুর্নিবার বেগে সুখ স্বচ্ছন্দতা ও সমাজবিধির বাহিরে আকর্ষণ করিয়া লইয়া চলিয়াছেন তাঁহাকেই ভক্তির সহিত প্রণাম করিয়া তাঁহারই হস্তে তোমাদের দুইজনকে সমর্পণ করিলাম, তিনিই তোমাদের জীবনে সমস্ত নিন্দাগ্লানি ও আত্মীয়বিচ্ছেদকে সার্থক করিয়া তুলুন। তিনিই তোমাদিগকে দুর্গম পথে আহ্বান করিয়াছেন, তিনিই তোমাদিগকে গম্যস্থানে লইয়া যাইবেন।’

0 Shares