গোরা

গোরা একেবারে স্তম্ভিত হইয়া বসিয়া রহিল। হরিমোহিনী কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া পুনরায় কহিলেন, ” ভেবে দেখো, ওকে তো বিয়েথাওয়া করতে হবে, বয়স তো যথেষ্ট হয়েছে। তুমি কি বল ও চিরদিন এইরকম আইবুড়ো হয়েই থাকবে? গৃহধর্ম করাটা তো মেয়ে মানুষের দরকার।”

সাধারণভাবে এ সম্বন্ধে গোরার কোনো সংশয় ছিল না–তাহারও এই মত বটে। কিন্তু সুচরিতা সম্বন্ধে নিজের মতকে সে মনে মনেও কখনো প্রয়োগ করিয়া দেখে নাই। সুচরিতা গৃহিণী হইয়া কোনো-এক গৃহস্থ-ঘরের অন্তঃপুরে ঘরকন্নায় নিযুক্ত আছে এ কল্পনা তাহার মনেও ওঠে না। যেন সুচরিতা আজও যেমন আছে বরাবর ঠিক এমনিই থাকিবে।

গোরা জিজ্ঞাসা করিল, “আপনার বোনঝির বিবাহের কথা কিছু ভেবেছেন নাকি?”

হরিমোহিনী কহিলেন, “ভাবতে হয় বৈকি, আমি না হলে আর ভাববে কে?”

গোরা প্রশ্ন করিল, “হিন্দুসমাজে কি ওঁর বিবাহ হতে পারবে?”

হরিমোহিনী কহিলেন, “সে চেষ্টা তো করতে হবে। ও যদি আর গোল না করে,বেশ ঠিকমত চলে, তা হলে ওকে বেশ চালিয়ে দিতে পারব। সে আমি মনে মনে সব ঠিক করে রেখেছি, এতদিন ওর যেরকম গতিক ছিল সাহস করে কিছু করে উঠতে পারি নি। এখন আবার দুদিন থেকে দেখছি ওর মনটা নরম হয়ে আসছে, তাই ভরসা হচ্ছে।”

গোরা ভাবিল, এ সম্বন্ধে আার বেশি কিছু জিজ্ঞাসা করা উচিত নয়, কিন্তু কিছুতেই থাকিতে পারিল না; প্রশ্ন করিল, “পাত্র কি কাউকে মনে মনে ঠিক করেছেন?”

হরিমোহিনী কহিলেন, “তা করেছি। পাত্রটি বেশ ভালোই– কৈলাস, আমার ছোটো দেবর। কিছু্‌দিন হল তার বউটি মারা গেছে, মনের মতো বড়ো মেয়ে পায় নি বলেই এতদিন বসে আছে, নইলে সে ছেলে কি পড়তে পায়? রাধারানীর সঙ্গে ঠিক মানাবে।”

মনের মধ্যে গোরার যতই ছুঁচ ফুটিতে লাগিল ততই সে কৈলাসের সম্বন্ধে প্রশ্ন করিতে লাগিল।

হরিমোহিনীর দেবরদের মধ্যে কৈলাসই নিজের বিশেষ যত্নে কিছুদূর লেখাপড়া করিয়াছিল–কতদূর, তাহা হরিমোহিনী বলিতে পারেন না। পরিবারের মধ্যে তাহারই বিদ্বান্‌ বলিয়া খ্যাতি আছে। গ্রামের পোস্ট্‌-মাস্টারের বিরুদ্ধে সদরে দরখাস্ত করিবার সময় কৈলাসই এমন আশ্চর্য ইংরাজি ভাষায় সমস্তটা লিখিয়া দিয়াছিল যে, পোস্ট্‌-আপিসের কোন্‌-এক বড়োবাবু স্বয়ং আসিয়া তদন্ত করিয়া গিয়াছিলেন। ইহাতে গ্রামবাসী সকলেই কৈলাসের ক্ষমতায় বিস্ময় অনুভব করিয়াছে। এত শিক্ষা সত্ত্বেও আচারে ধর্মে কৈলাসের নিষ্টা কিছুমাত্র হ্রাস হয় নাই।

কৈলাসের ইতিবৃত্ত সমস্ত বলা হইলে গোরা উঠিয়া দাঁড়াইল, হরিমোহিনীকে প্রণাম করিল এবং কোনো কথা না বলিয়া ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল।

সিঁড়ি দিয়া গোরা যখন প্রাঙ্গণে নামিয়া আসিতেছে তখন প্রাঙ্গণের অপর প্রান্তে পাকশালায় সুচরিতা কর্মে ব্যাপৃত ছিল। গোরার পদশব্দ শুনিয়া সে দ্বারের কাছে আসিয়া দাঁড়াইল। গোরা কোনো দিকে দৃষ্টিপাত না করিয়া বাহিরে চলিয়া গেল। সুচরিতা একটি দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া পুনরায় পাকশালার কাজে আসিয়া নিযুক্ত হইল।

গোরা গলির মোড়ের কাছে আসিতেই হারানবাবুর সঙ্গে তাহার দেখা হইল। হারানবাবু একটু হাসিয়া কহিলেন, “আজ সকালেই যে!”

গোরা তাহার কোনো উত্তর করিল না। হারানবাবু পুনরায় একটু হাসিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “ওখানে গিয়েছিলেন বুঝি? সুচরিতা বাড়ি আছে তো?”

গোরা কহিল, “হাঁ।” বলিয়াই সে হন্‌ হন্‌ করিয়া চলিয়া গেল।

হারানবাবু একেবারেই সুচরিতার বাড়িতে ঢুকিয়া রান্নাঘরের মুক্তদ্বার দিয়া তাহাকে দেখিতে পাইলেন; সুচরিতার পালাইবার পথ ছিল না, মাসিও নিকটে ছিলেন না।

হারানবাবু জিজ্ঞাসা করিলেন, “গৌরমোহনবাবুর সঙ্গে এই মাত্র দেখা হল। তিনি এখানেই এতক্ষণ ছিলেন বুঝি?”

সুচরিতা তাহার কোনো জবাব না করিয়া হঠাৎ হাঁড়িকুঁড়ি লইয়া অত্যন্ত ব্যস্ত হইয়া উঠিল, যেন এখন তাহার নিশ্বাস ফেলিবার অবকাশ নাই এরকম ভাবটা জানাইল। কিন্তু হারানবাবু তাহাতে নিরস্ত হইলেন না। তিনি ঘরের বাহিরে সেই প্রাঙ্গণে দাঁড়াইয়া কথাবার্তা আরম্ভ করিয়া দিলেন। হরিমোহিনী সিঁড়ির কাছে আসিয়া দুই-তিন বার কাশিলেন, তাহাতেও কিছুমাত্র ফল হইল না। হরিমোহিনী হারানবাবুর সম্মুখেই আসিতে পারিতেন, কিন্তু তিনি নিশ্চয় বুঝিয়াছিলেন, একবার যদি তিনি হারানবাবুর সম্মুখে বাহির হন তবে এ বাড়িতে এই উদ্যমশীল যুবকের অদম্য উৎসাহ হইতে তিনি এবং সুচরিতা কোথাও আত্মরক্ষা করিতে পারিবেন না। এইজন্য হারানবাবুর ছায়া দেখিলেও তিনি এতটা পরিমাণে ঘোমটা টানিয়া দেন যে তাহা তাঁহার বধূবয়সেও তাঁহার পক্ষে অতিরিক্ত বলিয়া গণ্য হইতে পারিত।

হারানবাবু কহিলেন, “সুচরিতা, তোমরা কোন্‌ দিকে চলেছে বলো দেখি। কোথায় গিয়ে পৌঁছাবে? বোধ হয় শুনেছ ললিতার সঙ্গে বিনয়বাবুর হিন্দুমতে বিয়ে হবে? তুমি জান এজন্যে কে দায়ী?”

সুচরিতার নিকট কোনো উত্তর না পাইয়া হারানবাবু স্বর নত করিয়া গম্ভীরভাবে কহিলেন, “দায়ী তুমি।”

হারানবাবু মনে করেছিলেন, এতবড়ো একটা সাংঘাতিক অভিযোগের আঘাত সুচরিতা সহ্য করিতে পারিবে না। কিন্তু সে বিনা বাক্যব্যয়ে কাজ করিতে লাগিল দেখিয়া তিনি স্বর আরো গম্ভীর করিয়া সুচরিতার প্রতি তাঁহার তর্জনী প্রসারিত ও কম্পিত করিয়া কহিলেন, “সুচরিতা, আমি আবার বলছি, দায়ী তুমি। বুকের উপরে ডান হাত রেখে কি বলতে পার যে, এজন্যে ব্রাহ্মসমাজের কাছে তোমাকে অপরাধী হতে হবে না?”

0 Shares