গোরা

সুচরিতা উনানের উপরে নীরবে তেলের কড়া চাপাইয়া দিল এবং তেল চড়্‌ বড়্‌ শব্দ করিতে লাগিল।

হারান বলিতে লাগিলেন, “তুমিই বিনয়বাবুকে এবং গৌরমোহনবাবুকে তোমাদের ঘরে এনেছ এবং তাদের এতদূর পর্যন্ত প্রশ্রয় দিয়েছ যে, আজ তোমাদের ব্রাহ্মসমাজের সমস্ত মান্য বন্ধুদের চেয়ে এরা দুজনেই তোমাদের কাছে বড়ো হয়ে উঠেছে। তার ফল কী হয়েছে দেখতে পাচ্ছ? আমি কি প্রথম থেকেই বার বার সাবধান করে দিই নি? আজ কী হল? আজ ললিতাকে কে নিবৃত্ত করবে? তুমি ভাবছ ললিতার উপর দিয়েই বিপদের অবসান হয়ে গেল। তা নয়। আমি আজ তোমাকে সাবধান করে দিতে এসেছি। এবার তোমার পালা। আাজ ললিতার দুর্ঘটনায় তুমি নিশ্চয়ই মনে মনে অনুতাপ করছ, কিন্তু এমন দিন অনতিদূরে এসেছে যেদিন নিজের অধঃপতনে তুমি অনুতাপমাত্রও করবে না। কিন্তু, সুচরিতা, এখনো ফেরবার সময় আছে। একবার ভেবে দেখো, একদিন কতবড়ো মহৎ আশার মধ্যে আমরা দুজনে মিলেছিলুম–আমাদের সামনে জীবনের কর্তব্য কী উজ্জ্বল ছিল, ব্রাহ্মসমাজের ভবিষ্যৎ কী উদারভাবেই প্রসারিত হয়েছিল—আমাদের কত সংকল্প ছিল এবং কত পাথেয় আমরা প্রতিদিন সংগ্রহ করেছি! সে-সমস্তই কি নষ্ট হয়েছে মনে কর? কখনোই না। আমাদের সেই আশার ক্ষেত্র আজও তেমনি প্রস্তুত হয়ে আছে। একবার মুখ ফিরিয়ে কেবল চাও। একবার ফিরে এসো।”

তখন ফুটন্ত তেলের মধ্যে অনেকখানি শাক-তরকারি ছ্যাঁক্‌ ছ্যাঁক্‌ করিতেছিল এবং খোন্তা দিয়া সুচরিতা তাহাকে বিধিমতে নাড়া দিতেছিল; যখন হারানবাবু তাঁহার আহ্বানের ফল জানিবার জন্য চুপ করিলেন তখন সুচরিতা আগুনের উপর হইতে কড়া নীচে নামাইয়া মুখ ফিরাইল এবং দৃঢ়স্বরে কহিল, “আমি হিন্দু।”

হারানবাবু একেবারে হতবুদ্ধি হইয়া কহিলেন, “তুমি হিন্দু।”

সুচরিতা কহিল, “হাঁ, আমি হিন্দু।”

বলিয়া কড়া আবার উনানে চড়াইয়া সবেগে খোন্তা-চালনায় প্রবৃত্ত হইল।

হারানবাবু ক্ষণকাল ধাক্কা সামলাইয়া লইয়া তীব্রস্বরে কহিলেন, “গৌরমোহনবাবু তাই বুঝি সকাল নেই, সন্ধ্যা নেই, তোমাকে দীক্ষা দিচ্ছিলেন?”

সুচরিতা মুখ না ফিরাইয়াই কহিল, “হাঁ, আমি তাঁর কাছ থেকেই দীক্ষা নিয়েছি, তিনি আমার গুরু।”

হারানবাবু এক কালে নিজেকেই সুচরিতার গুরু বলিয়া জানিতেন। আজ যদি সুচরিতার কাছে তিনি শুনিতেন যে, সে গোরাকে ভালোবাসে তাহাতে তাঁহার তেমন কষ্ট হইত না, কিন্তু তাঁহার গুরুর অধিকার আজ গোরা কাড়িয়া লইয়াছে সুচরতার মুখে তাঁহাকে এ কথা শেলের মতো বাজিল।

তিনি কহিলেন, “তোমার গুরু যতবড়ো লোকই হোন-না কেন, তুমি কি মনে কর হিন্দুসমাজ তোমাকে গ্রহণ করবে?”

সুচরিতা কহিল, “সে কথা আমি বুঝি নে, আমি সমাজও জানি নে, আমি জানি আমি হিন্দু।”

হারানবাবু কহিলেন, “তুমি জান এতদিন তুমি অবিবাহিত রয়েছ কেবলমাত্র এতেই হিন্দুসমাজে তোমার জাত গিয়েছে?”

সুচরিতা কহিল, “সে কথা নিয়ে আপনি বৃথা চিন্তা করবেন না, কিন্তু আমি আপনাকে বলছি আমি হিন্দু।”

হারানবাবু কহিলেন, “পরেশবাবুর কাছে যে ধর্মশিক্ষা পেয়েছিলে তাও তোমার নতুন গুরুর পায়ের তলায় বিসর্জন দিলে!”

সুচরিতা কহিল, “আমার ধর্ম আমার অন্তর্যামী জানেন, সে কথা নিয়ে আমি কারো সঙ্গে কোনো আলোচনা করতে চাই নে। কিন্তু আপনি জানবেন আমি হিন্দু।”

হারানবাবু তখন নিতান্ত অসহিষ্ণু হইয়া বলিয়া উঠিলেন, “তুমি যতবড়ো হিন্দুই হও-না কেন–তাতে কোনো ফল পাবে না, এও আমি তোমাকে বলে যাচ্ছি। তোমার গৌরমোহনবাবুকে বিনয়বাবু পাও নি। তুমি নিজেকে হিন্দু হিন্দু বলে গলা ফাটিয়ে ম’লেও গৌরবাবু যে তোমাকে গ্রহণ করবেন এমন আশাও কোরো না। শিষ্যকে নিয়ে গুরুগিরি করা সহজ কিন্তু তাই বলে তোমাকে ঘরে নিয়ে ঘরকন্না করবেন এ কথা স্বপ্নেও মন কোরো না।”

সুচরিতা রান্নাবান্না সমস্ত ভুলিয়া বিদ্যুদ্‌বেগে ফিরিয়া দাঁড়াইয়া কহিল, “এ-সব আপনি কী বলছেন!”

হারানবাবু কহিলেন, “আমি বলছি, গৌরমোহনবাবু কোনোদিন তোমাকে বিবাহ করবেন না।”

সুচরিতা দুই চক্ষু দীপ্ত করিয়া কহিল, “বিবাহ? আমি কি আপনাকে বলি নি তিনি আমার গুরু?”

হারানবাবু কহিলেন, “তা তো বলেছ। কিন্তু যে কথাটা বল নি সেটাও তো আমরা বুঝতে পারি।”

সুচরিতা কহিল, “আপনি যান এখান থেকে। আমাকে অপমান করবেন না। আমি আজ এই আপনাকে বলে রাখছি–আজ থেকে আপনার সামনে আমি আর বার হব না।’

হারানবাবু কহিলেন, “বার হবে কী করে বলো। এখন যে তুমি জেনেনা! হিন্দুরমণী! অসূর্যস্পশ্যরূপা! পরেশবাবুর পাপের ভরা এইবার পূর্ণ হল। এই বুড়োবয়সে তাঁর কৃতকর্মের ফল ভোগ করতে থাকুন, আমরা বিদায় হলুম।”

সুচরিতা সশব্দে রান্নাঘরের দরজা বন্ধ করিয়া মেজের উপর বসিয়া পড়িল এবং মুখের মধ্যে আঁচলের কাপড় গুঁজিয়া উচ্ছ্বসিত ক্রন্দনের শব্দকে প্রাণপণে নিরুদ্ধ করিল। হারানবাবু মুখ কালি করিয়া বাহির হইয়া গেলেন।

হরিমোহিনী উভয়ের কথোপকথন সমস্ত শুনিয়াছিলেন। আজ তিনি সুচরিতার মুখে যাহা শুনিলেন তাহা তাঁহার আশার অতীত। তাঁহার বক্ষ স্ফীত হইয়া উঠিল, তিনি কহিলেন, “হবে না? আমি যে একমনে আমার গোপীবল্লভের পূজা করিয়া আসিলাম সে কি সমস্তই বৃথা যাইবে!”

হরিমোহিনী তৎক্ষণাৎ তাঁহার পূজাগৃহে গিয়া মেজের উপরে সাষ্টাঙ্গে লুটাইয়া তাঁহার ঠাকুরকে প্রণাম করিলেন এবং আজ হইতে ভোগ আরো বাড়াইয়া দিবেন বলিয়া প্রতিশ্রুত হইলেন। এতদিন তাঁহার পূজা শোকের সান্ত্বনারূপে শান্তভাবে ছিল, আজ তাহা স্বার্থের সাধন-রূপ ধরিতেই অত্যন্ত উগ্র উত্তপ্ত ক্ষুধাতুর হইয়া উঠিল।

0 Shares