গোরা

বিনয় কহিল, “আমি যে তোমাদের বাড়ি থেকে এখনই আসছি।”

সতীশ। বা, আমরা যে ছিলুম না, আবার চলুন।

সতীশের পীড়াপীড়ি বিনয় অগ্রাহ্য করিতে পারিল না। বন্দীকে লইয়া বাড়িতে প্রবেশ করিয়াই সতীশ উচ্চস্বরে কহিল, “বাবা, বিনয়বাবুকে এনেছি।”

বৃদ্ধ ঘর হইতে বাহির হইয়া ঈষৎ হাসিয়া কহিলেন, “শক্ত হাতে ধরা পড়েছেন, শীঘ্র ছাড়া পাবেন না। সতীশ, তোর দিদিকে ডেকে দে।”

বিনয় ঘরে আসিয়া বসিল, তাহার হৃৎপিণ্ড বেগে উঠিতে পড়িতে লাগিল। পরেশ কহিলেন, “হাঁপিয়ে পড়েছেন বুঝি! সতীশ ভারি দুরন্ত ছেলে।”

ঘরে যখন সতীশ তাহার দিদিকে লইয়া প্রবেশ করিল তখন বিনয় প্রথমে একটি মৃদু সুগন্ধ অনুভব করিল– তাহার পরে শুনিল পরেশবাবু বলিতেছেন, “রাধে, বিনয়বাবু এসেছেন। এঁকে তো তুমি জানই।”

বিনয় চকিতের মতো মুখ তুলিয়া দেখিল, সুচরিতা তাহাকে নমস্কার করিয়া সামনের চৌকিতে বসিল– এবার বিনয় প্রতিনমস্কার করিতে ভুলিল না।

সুচরিতা কহিল, “উনি রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলেন। ওঁকে দেখবামাত্র সতীশকে আর ধরে রাখা গেল না, সে গাড়ি থেকে নেমেই ওঁকে টেনে নিয়ে এল। আপনি হয়তো কোনো কাজে যাচ্ছিলেন– আপনার তো কোনো অসুবিধে হয় নি?”

সুচরিতা বিনয়কে সম্বোধন করিয়া কোনো কথা কহিবে বিনয় তাহা প্রত্যাশাই করে নাই। সে কুণ্ঠিত হইয়া ব্যস্ত হইয়া বলিয়া উঠিল, “না, আমার কোনো কাজ ছিল না, অসুবিধে কিছুই হয় নি।”

সতীশ সুচরিতার কাপড় ধরিয়া টানিয়া কহিল, “দিদি, চাবিটা দাও-না। আমাদের সেই আর্গিনটা এনে বিনয়বাবুকে দেখাই।”

সুচরিতা হাসিয়া কহিল, “এই বুঝি শুরু হল! যার সঙ্গে বক্তিয়ারের ভাব হবে তার আর রক্ষে নেই– আর্গিন তো তাকে শুনতেই হবে, আরো অনেক দুঃখ তার কপালে আছে। বিনয়বাবু, আপনার এই বন্ধুটি ছোটো, কিন্তু এর বন্ধুত্বের দায় বড়ো বেশি– সহ্য করতে পারবেন কি না জানি নে।”

বিনয় সুচরিতার এইরূপ অকুণ্ঠিত আলাপে কেমন করিয়া বেশ সহজে যোগ দিবে কোনোমতেই ভাবিয়া পাইল না। লজ্জা করিবে না দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করিয়াও কোনো প্রকারে ভাঙাচোরা করিয়া একটা জবাব দিল, “না, কিছুই না– আপনি সে– আমি– আমার ও বেশ ভালোই লাগে।”

সতীশ তাহার দিদির কাছ হইতে চাবি আদায় করিয়া আর্গিন আনিয়া উপস্থিত করিল। একটা চৌকা কাচের আবরণের মধ্যে তরঙ্গিত সমুদ্রের অনুকরণে নীল-রঙ-করা কাপড়ের উপর একটা খেলার জাহাজ রহিয়াছে। সতীশ চাবি দিয়া দম লাগাইতে আর্গিনের সুরে-তালে জাহাজটা দুলিতে লাগিল এবং সতীশ একবার জাহাজের দিকে ও একবার বিনয়ের মুখের দিকে চাহিয়া মনের অস্থিরতা সম্বরণ করিতে পারিল না।

এমনি করিয়া সতীশ মাঝখানে থাকাতে অল্প অল্প করিয়া বিনয়ের সংকোচ ভাঙিয়া গেল, এবং ক্রমে সুচরিতার সঙ্গে মাঝে মাঝে মুখ তুলিয়া কথা কহাও তাহার পক্ষে অসম্ভব হইল না।

সতীশ অপ্রাসঙ্গিক হঠাৎ এক সময় বলিয়া উঠিল, “আপনার বন্ধুকে একদিন আমাদের এখানে আনবেন না?”

ইহা হইতে বিনয়ের বন্ধু সম্বন্ধে প্রশ্ন উঠিয়া পড়িল। পরেশবাবুরা নূতন কলিকাতায় আসিয়াছেন, তাঁহারা গোরা সম্বন্ধে কিছুই জানিতেন না। বিনয় তাহার বন্ধুর কথা আলোচনা করিতে করিতে উৎসাহিত হইয়া উঠিল। গোরার যে কিরূপ অসামান্য প্রতিভা, তাহার হৃদয় যে কিরূপ প্রশস্ত, তাহার শক্তি যে কিরূপ অটল, তাহা বলিতে গিয়া বিনয় যেন কথা শেষ করিতে পারিল না। গোরা যে একদিন সমস্ত ভারতবর্ষের মাথার উপরে মধ্যাহ্নসূর্যের মতো প্রদীপ্ত হইয়া উঠিবে, বিনয় কহিল, “এ বিষয়ে আমার সন্দেহমাত্র নাই।”

বলিতে বলিতে বিনয়ের মুখে যেন একটা জ্যোতি দেখা দিল, তাহার সমস্ত সংকোচ একেবারে কাটিয়া গেল। এমন-কি, গোরার মত সম্বন্ধে পরেশবাবুর সঙ্গে দুই-একটা বাদপ্রতিবাদও হইল। বিনয় বলিল, “গোরা যে হিন্দুসমাজের সমস্তই অসংকোচে গ্রহণ করতে পারছে তার কারণ সে খুব একটা বড়ো জায়গা থেকে ভারতবর্ষকে দেখছে। তার কাছে ভারতবর্ষের ছোটোবড়ো সমস্তই একটা মহৎ ঐক্যের মধ্যে একটা বৃহৎ সংগীতের মধ্যে মিলে সম্পূর্ণ হয়ে দেখা দিচ্ছে। সেরকম করে দেখা আমাদের সকলের পক্ষে সম্ভব নয় বলে ভারতবর্ষকে টুকরো টুকরো করে বিদেশী আদর্শের সঙ্গে মিলিয়ে তার প্রতি কেবলই অবিচার করি।”

সুচরিতা কহিল, “আপনি কি বলেন জাতিভেদটা ভালো?”

এমনভাবে কহিল যেন ও-সম্বন্ধে কোনো তর্কই চলিতে পারে না।

বিনয় কহিল, “জাতিভেদটা ভালোও নয়, মন্দও নয়। অর্থাৎ কোথাও ভালো, কোথাও মন্দ। যদি জিজ্ঞাসা করেন, হাত জিনিসটা কি ভালো, আমি বলব সমস্ত শরীরের সঙ্গে মিলিয়ে দেখলে ভালো। যদি বলেন, ওড়বার পক্ষে কি ভালো? আমি বলব, না। তেমনি ডানা জিনিসটাও ধরবার পক্ষে ভালো নয়।”

সুচরিতা উত্তেজিত হইয়া কহিল, “আমি ও-সমস্ত কথা বুঝতে পারি নে। আমি জিজ্ঞাসা করছি আপনি কি জাতিভেদ মানেন?”

আর কারো সঙ্গে তর্ক উঠিলে বিনয় জোর করিয়াই বলিত, “হাঁ, মানি।” আজ তাহার তেমন জোর করিয়া বলিতে বাধিল; ইহা কি তাহার ভীরুতা, অথবা জাতিভেদ মানি বলিলে কথাটা যতদূর পৌঁছে আজ তাহার মন ততদূর পর্যন্ত যাইতে স্বীকার করিল না, তাহা নিশ্চয় বলা যায় না। পরেশ পাছে তর্কটা বেশিদূর যায় বলিয়া এইখানেই বাধা দিয়া কহিলেন, “রাধে, তোমার মাকে এবং সকলকে ডেকে আনো– এঁর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিই।”

সুচরিতা ঘর হইতে বাহির হইয়া যাইতেই সতীশ তাহার সঙ্গে বকিতে বকিতে লাফাইতে লাফাইতে চলিয়া গেল।

0 Shares