গোরা

৬৩

সুচরিতার সম্মুখে গোরা যেমন করিয়া কথা কহিয়াছে এমন আর কাহারো কাছে কহে নাই। এতদিন সে তাহার শ্রোতাদের কাছে নিজের মধ্য হইতে কেবল বাক্যকে, মতকে, উপদেশকে বাহির করিয়া আসিয়াছে–আজ সুচরিতার সম্মুখে সে নিজের মধ্য হইতে নিজেকেই বাহির করিল। এই আত্মপ্রকাশের আনন্দে, শুধু শক্তিতে নহে, একটা রসে তাহার সমস্ত মত ও সংকল্প পরিপূর্ণ হইয়া উঠল। একটি সৌন্দর্যশ্রী তাহার জীবনকে বেষ্টন করিয়া ধরিল। তাহার তপস্যার উপর যেন সহসা দেবতারা অমৃত বর্ষণ করিলেন।

এই আনন্দের আবেগেই গোরা কিছুই না ভাবিয়া কয়দিন প্রত্যহই সুচরিতার কাছে আসিয়াছে, কিন্তু আজ হরিমোহিনীর কথা শুনিয়া হঠাৎ তাহার মনে পড়িয়া গেল অনুরূপ মুগ্ধতায় বিনয়কে সে একদিন যথেষ্ট তিরস্কার ও পরিহাস করিয়াছে। আজ যেন নিজের অজ্ঞাতসারে নিজেকে সেই অবস্থার মধ্যে দাঁড়াইতে দেখিয়া সে চমকিয়া উঠিল। অস্থানে অসম্‌বৃত নিদ্রিত ব্যক্তি ধাক্কা খাইলে যেমন ধড়্‌ ফড়্‌ করিয়া উঠিয়া পড়ে গোরা সেইরূপ নিজের সমস্ত শক্তিতে নিজেকে সচেতন করিয়া তুলিল। গোরা বরাবর এই কথা প্রচার করিয়া আসিয়াছে যে, পৃথিবীতে অনেক প্রবল জাতির একেবারে ধ্বংস হইয়াছে ; ভারত কেবলমাত্র সংযমেই, কেবল দৃঢ়ভাবে নিয়ম পালন করিয়াই, এত শতাব্দীর প্রতিকূল সংঘাতেও আজ পর্যন্ত আপনাকে বাঁচাইয়া আসিয়াছে। সেই নিয়মে কুত্রাপি গোরা শৈথিল্য স্বীকার করিতে চায় না। গোরা বলে, ভারতবর্ষের আর-সমস্তই লুটপাট হইয়া যাইতেছে, কিন্তু তাহার যে প্রাণপুরুষকে সে এই-সমস্ত কঠিন নিয়মসংযমের মধ্যে প্রচ্ছন্ন করিয়া রাখিয়াছেন তাহার গায়ে কোনো অত্যাচারী রাজপুরুষের হস্তক্ষেপ করিবার সাধ্যই নাই। যতদিন আমরা পরজাতির অধীন হইয়া আছি ততদিন নিজেদের নিয়মকে দৃঢ় করিয়া মানিতে হইবে। এখন ভালোমন্দ-বিচারের সময় নয়। যে ব্যক্তি স্রোতের টানে পড়িয়া মৃত্যুর মুখে ভাসিয়া যাইতেছে সে যাহার দ্বারাই নিজেকে ধরিয়া রাখিতে পারে তাহাকেই আঁকড়াইয়া থাকে, সে জিনিসটা সুন্দর কি কুশ্রী বিচার করে না। গোরা বরাবর এই কথা বলিয়া আসিয়াছে, আজও ইহাই তাহার বলিবার কথা। হরিমোহিনী সেই গোরার যখন আচরণের নিন্দা করিলেন তখন গজরাজকে অঙ্কুশে বিদ্ধ করিল।

গোরা যখন বাড়ি আসিয়া পৌঁছিল তখন দ্বারের সম্মুখে রাস্তার উপর বেঞ্চি পাতিয়া খোলা গায়ে মহিম তামাক খাইতেছিলেন। আজ তাঁহার আপিসের ছুটি। গোরাকে ভিতরে ঢুকিতে দেখিয়া তিনিও তাহার পশ্চাতে গিয়া তাহাকে ডাকিয়া কহিলেন, “গোরা, শুনে যাও, একটি কথা আছে।”

গোরাকে নিজের ঘরে লইয়া গিয়া মহিম কহিলেন, “রাগ কোরো না, ভাই, আগে জিজ্ঞাসা করছি, তোমাকেও বিনয়ের ছোঁয়াচ লেগেছে নাকি? ও অঞ্চলে যে বড়ো ঘন ঘন যাওয়া-আসা চলছে!”

গোরার মুখ রক্তবর্ণ হইয়া উঠিল। সে কহিল, “ভয় নেই।”

মহিম কহিলেন, “যেরকম গতিক দেখছি কিছু তো বলা যায় না। তুমি ভাবছ ওটা একটা খাদ্যদ্রব্য, দিব্যি গিলে ফেলে তার পরে আবার ঘরে ফিরে আসবে। কিন্তু বঁড়শিটি ভিতরে আছে, সে তোমার বন্ধুর দশা দেখলেই বুঝতে পারবে। আরে, যাও কোথায়! আসল কথাটাই এখনো হয় নি। ও-দিকে ব্রাহ্ম মেয়ের সঙ্গে বিনয়ের বিয়ে তো একেবারে পাকা হয়ে গেছে শুনতে পাচ্ছি। তার পর কিন্তু ওর সঙ্গে আমাদের কোনোরকম ব্যবহার চলবে না সে আমি তোমাকে আগে থাকতেই বলে রাখছি।”

গোরা কহিল, ” সে তো চলবেই না।”

মহিম কহিলেন, “কিন্তু মা যদি গোলমাল করেন তা হলে সুবিধা হবে না। আমরা গৃহস্থ মানুষ, অমনিতেই মেয়েছেলের বিয়ে দিতে জিব বেরিয়ে পড়ে, তার পরে যদি ঘরের মধ্যে ব্রাহ্মসমাজ বসাও তা হলে আমাকে কিন্তু এখান থেকে বাস ওঠাতে হবে।”

গোরা কহিল, “না, সে কিছুতেই হবে না।”

মহিম কহিলেন, “শশীর বিবাহের প্রস্তাবটা ঘনিয়ে আসছে। আমাদের বেহাই যতটুকু পরিমাণ মেয়ে ঘরে নেবেন সোনা তার চেয়ে বেশি না নিয়ে ছাড়বেন না; কারণ, তিনি জানেন মানুষ নশ্বর পদার্থ, সোনা তার চেয়ে বেশি দিন টেঁকে। ওষুধের চেয়ে অনুপানটার দিকেই তাঁর ঝোঁক বেশি। বেহাই বললে তাঁকে খাটো করা হয়, একেবারে বেহায়া। কিন্তু খরচ হবে বটে, কিন্তু লোকটার কাছে আমার অনেক শিক্ষা হল, ছেলের বিয়ের সময় কাজে লাগবে। ভারি লোভ হচ্ছিল আর-এক বার এ কালে জন্মগ্রহণ করে বাবাকে মাঝখানে বসিয়ে রেখে নিজের বিয়েটা একবার বিধিমত পাকিয়ে তুলি–পুরুষজন্ম যে গ্রহণ করেছি সেটাকে একেবারে ষোলো-আনা সার্থক করে নিই। একেই তো বলে পৌরুষ। মেয়ের বাপকে একেবারে ধরাশায়ী করে দেওয়া। কম কথা! যাই বল, তোমার সঙ্গে যোগ দিয়ে যে নিশিদিন হিন্দুসমাজের জয়ধ্বনি করব কিছুতেই তাতে জোর পাচ্ছি নে ভাই, গলা উঠতে চায় না, একেবারে কাহিল করে ফেলেছে। আমার তিনকড়েটার বয়স এখন সবে চৌদ্দ মাস–গোড়ায় কন্যা জন্ম দিয়ে শেষে তার ভ্রম সংশোধন করতে সহধর্মিণী দীর্ঘকাল সময় নিয়েছেন। যা হোক, ওরই বিবাহের সময়টা পর্যন্ত, গোরা, তোমরা সকলে মিলে হিন্দুসমাজটাকে তাজা রেখো–তারপর দেশের লোক মুসলমান হোক, খৃস্টান হোক, আমি কোনো কথা কব না।”

গোরা উঠিয়া দাঁড়াতেই মহিম কহিলেন, “তাই আমি বলছিলুম, শশীর বিবাহের সভায় তোমাদের বিনয়কে নিমন্ত্রণ করা চলবে না। তখন যে এই কথা নিয়ে আবার একটা কাণ্ড বাধিয়ে তুলবে সে হবে না। মাকে তুমি এখন থেকে সাবধান করে রেখে দিয়ো।”

0 Shares