গোরা

সুচরিতা আরাম পাইয়া কহিল, “হাঁ, ঠিক তাই। কিন্তু আমার অনুভব এমন প্রবল সে আমি তোমাকে কী বলব। আমি ঠিক যেন একটা নূতন জীবন পেয়েছি, সে একটা নূতন চেতনা। আমি এমন দিক থেকে এমন করে নিজেকে কখনো দেখি নি। আমার সঙ্গে এতদিন আমার দেশের অতীত এবং ভবিষ্যৎ কালের কোনো সম্বন্ধই ছিল না; কিন্তু সেই মস্তবড়ো সম্বন্ধটা যে কতবড়ো সত্য জিনিস আজ সেই উপলব্ধি আমার হৃদয়ের মধ্যে এমনি আশ্চর্য করে পেয়েছি যে, সে আর কিছুতে ভুলতে পারছি নে। দেখো বাবা, আমি তোমাকে সত্য বলছি “আমি হিন্দু’ এ কথা আগে কোনোমতে আমার মুখ দিয়ে বের হতে পারত না। কিন্তু এখন আমার মন খুব জোরের সঙ্গে অসংকোচে বলছে, আমি হিন্দু। এতে আমি খুব একটা আনন্দ বোধ করছি।”

পরেশবাবু কহিলেন, “এ কথাটার অঙ্গপ্রত্যঙ্গ অংশ-প্রত্যংশ সমস্তই কি ভেবে দেখেছ?”

সুচরিতা কহিল, “সমস্ত ভেবে দেখবার শক্তি কি আমার নিজের আছে? কিন্তু এই কথা নিয়ে আমি অনেক পড়েছি, অনেক আলোচনাও করেছি। এই জিনিসটাকে যখন আমি এমন বড়ো করে দেখতে শিখি নি তখনই হিন্দু বলতে যা বোঝায় কেবল তার সমস্ত ছোটোখাটো খুঁটিনাটিকেই বড়ো করে দেখেছি–তাতে সমস্তটার প্রতি আমার মনের মধ্যে ভারি একটা ঘৃণা বোধ হত।”

পরেশবাবু তাহার কথা শুনিয়া বিস্ময় অনুভব করিলেন, তিনি স্পষ্টই বুঝিতে পারিলেন সুচরিতার মনের মধ্যে একটা বোধসঞ্চার হইয়াছে, সে একটা-কিছু সত্যবস্তু লাভ করিয়াছে বলিয়া নিঃসংশয়ে অনুভব করিতেছে–সে যে মুগ্ধের মতো কিছুই না বুঝিয়া কেবল একটা অস্পষ্ট আবেগে ভাসিয়া যাইতেছে তাহা নহে।

সুচরিতা কহিল, “বাবা, আমি যে আমার দেশ থেকে, জাত থেকে বিচ্ছিন্ন একজন ক্ষুদ্র মানুষ এমন কথা আমি কেন বলব? আমি কেন বলতে পারব না আমি হিন্দু?”

পরেশ হাসিয়া কহিলেন, “অর্থাৎ, মা, তুমি আমাকেই জিজ্ঞাসা করছ আমি কেন নিজেকে হিন্দু বলি নে? ভেবে দেখতে গেলে তার যে খুব গুরুতর কোনো কারণ আছে তা নয়। একটা কারণ হচ্ছে, হিন্দুরা আমাকে হিন্দু বলে স্বীকার করে না। আর একটা কারণ, যাদের সঙ্গে আমার ধর্মমতে মেলে তারা নিজেকে হিন্দু বলে পরিচয় দেয় না।”

সুচরিতা চুপ করিয়া ভাবিতে লাগিল। পরেশ কহিলেন, “আমি তো তোমাকে বলেইছি এগুলি গুরুতর কারণ নয়, এগুলি বাহ্য কারণ মাত্র। এ বাধাগুলোকে না মানলেও চলে। কিন্তু ভিতরের একটা গভীর কারণ আছে। হিন্দুসমাজে প্রবেশের কোনো পথ নেই। অন্তত সদর রাস্তা নেই, খিড়কির দরজা থাকতেও পারে। এ সমাজ সমস্ত মানুষের সমাজ নয়–দৈববশে যারা হিন্দু হয়ে জন্মাবে এ সমাজ কেবলমাত্র তাদের।”

সুচরিতা কহিল, “সব সমাজই তো তাই।”

পরেশ কহিলেন, “না, কোনো বড়ো সমাজই তা নয়। মুসলমান সমাজের সিংহদ্বার সমস্ত মানুষের জন্যে উদ্‌ঘাটিত, খৃস্টান সমাজও সকলকেই আহ্বান করছে। যে-সকল সমাজ খৃস্টান সমাজের অঙ্গ তাদের মধ্যেও সেই বিধি। যদি আমি ইংরেজ হতে চাই তবে সে একেবারে অসম্ভব নয়; ইংলণ্ডে বাস করে আমি নিয়ম পালন করে চললে ইংরেজ-সমাজ-ভুক্ত হতে পারি, এমন-কি, সেজন্যে আমার খৃস্টান হবারও দরকার নেই। অভিমন্যু ব্যূহের মধ্যে প্রবেশ করতে জানত, বেরোতে জানত না; হিন্দু ঠিক তার উল্‌টো। তার সমাজে প্রবেশ করবার পথ একেবারে বন্ধ, বেরোবার পথ শতসহস্র।”

সুচরিতা কহিল, “তবু তো বাবা, এত দিনেও হিন্দুর ক্ষয় নি, সে তো টিঁকে আছে।”

পরেশ কহিলেন, “সমাজের ক্ষয় বুঝতে সময় লাগে। ইতিপূর্বে হিন্দুসমাজের খিড়কির দরজা খোলা ছিল। তখন এ দেশের অনার্য জাতি হিন্দুসমাজের মধ্যে প্রবেশ করে একটা গৌরব বোধ করত। এ দিকে মুসলমানের আমলে দেশের প্রায় সর্বত্রই হিন্দু রাজা ও জমিদারের প্রভাব যথেষ্ট ছিল, এইজন্যে সমাজ থেকে কারো সহজে বেরিয়ে যাবার বিরুদ্ধে শাসন ও বাধার সীমা ছিল না। এখন ইংরেজ-অধিকারে সকলকেই আইনের দ্বারা রক্ষা করছে। সেরকম কৃত্রিম উপায়ে সমাজের দ্বার আগলে থাকবার জো এখন আর তেমন নেই। সেইজন্য কিছুকাল থেকে কেবলই দেখা যাচ্ছে, ভারতবর্ষে হিন্দু কমছে আর মুসলমান বাড়ছে। এরকমভাবে চললে ক্রমে এ দেশ মুসলমান-প্রধান হয়ে উঠবে, তখন একে হিন্দুস্থান বলাই অন্যায় হবে।”

সুচরিতা ব্যথিত হইয়া উঠিয়া কহিল, “বাবা, এটা কি নিবারণ করাই আমাদের সকলের উচিত হবে না? আমরাও কি হিন্দুকে পরিত্যাগ করে তার ক্ষয়কে বাড়িয়ে তুলব? এখনই তো তাকে প্রাণপণ শক্তিতে আঁকড়ে থাকবার সময়।”

পরেশবাবু সস্নেহে সুচরিতার পিঠে হাত বুলাইয়া কহিলেন, “আমরা ইচ্ছা করলেই কি কাউকে আঁকড়ে ধরে বাঁচিয়ে রাখতে পারি? রক্ষা পাবার জন্য একটা জাগতিক নিয়ম আছে–সেই স্বভাবের নিয়মকে যে পরিত্যাগ করে সকলেই তাকে স্বভাবতই পরিত্যাগ করে। হিন্দুসমাজ মানুষকে অপমান করে, বর্জন করে, এইজন্যে এখনকার দিনে আত্মরক্ষা করা তার পক্ষে প্রত্যহই কঠিন হয়ে উঠছে। কেননা, এখন তো আর সে আড়ালে বসে থাকতে পারবে না–এখন পৃথিবীর চার দিকের রাস্তা খুলে গেছে, চার দিক থেকে মানুষ তার উপরে এসে পড়ছে; এখন শাস্ত্র-সংহিতা দিয়ে বাঁধ বেঁধে প্রাচীর তুলে সে আপনাকে সকলের সংস্রব থেকে কোনোমতে ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না। হিন্দুসমাজ এখনো যদি নিজের মধ্যে সংস্রহ করবার শক্তি না জাগায়, ক্ষয়রোগকেই প্রশ্রয় দেয়, তা হলে বাহিরের মানুষের এই অবাধ সংস্রব তার পক্ষে একটা সাংঘাতিক আঘাত হয়ে দাঁড়াবে।”

0 Shares