গোরা

কিছুক্ষণ পরে সুচরিতা ঘরে প্রবেশ করিয়া বলিল, “বাবা, মা তোমাদের উপরের বারান্দায় আসতে বললেন।”

উপরে গাড়িবারান্দায় একটা টেবিলে শুভ্র কাপড় পাতা, টেবিল ঘেরিয়া চৌকি সাজানো। রেলিঙের বাহিরে কার্নিসের উপরে ছোটো ছোটো টবে পাতাবাহার এবং ফুলের গাছ। বারান্দার উপর হইতে রাস্তার ধারের শিরীষ ও কৃষ্ণচূড়া গাছের বর্ষা-জলধৌত পল্লবিত চিক্কণতা দেখা যাইতেছে।

সূর্য তখনো অস্ত যায় নাই; পশ্চিম আকাশ হইতে ম্লান রৌদ্র সোজা হইয়া বারান্দার এক প্রান্তে আসিয়া পড়িয়াছে।

ছাতে তখন কেহ ছিল না। একটু পরেই সতীশ সাদাকালো-রোঁয়াওয়ালা এক ছোটো কুকুর সঙ্গে লইয়া আসিয়া উপস্থিত হইল। তাহার নাম খুদে। এই কুকুরের যতরকম বিদ্যা ছিল সতীশ তাহা বিনয়কে দেখাইয়া দিল। সে এক পা তুলিয়া সেলাম করিল, মাথা মাটিতে ঠেকাইয়া প্রণাম করিল, একখণ্ড বিস্কুট দেখাইতেই লেজের উপর বসিয়া দুই পা জড়ো করিয়া ভিক্ষা চাহিল। এইরূপে খুদে যে খ্যাতি অর্জন করিল সতীশই তাহা আত্মসাৎ করিয়া গর্ব অনুভব করিল– এই যশোলাভে খুদের লেশমাত্র উৎসাহ ছিল না, বস্তুত যশের চেয়ে বিস্কুটটাকে সে ঢের বেশি সত্য বলিয়া গণ্য করিয়াছিল।

কোনো একটা ঘর হইতে মাঝে মাঝে মেয়েদের গলার খিল্‌খিল্‌ হাসি ও কৌতুকের কণ্ঠস্বর এবং তাহার সঙ্গে একজন পুরুষের গলাও শুনা যাইতেছিল। এই অপর্যাপ্ত হাস্যকৌতুকের শব্দে বিনয়ের মনের মধ্যে একটা অপূর্ব মিষ্টতার সঙ্গে সঙ্গে একটা যেন ঈর্ষার বেদনা বহন করিয়া আনিল। ঘরের ভিতরে মেয়েদের গলার এই আনন্দের কলধ্বনি বয়স হওয়া অবধি সে এমন করিয়া কখনো শুনে নাই। এই আনন্দের মাধুর্য তাহার এত কাছে উচ্ছ্বসিত হইতেছে অথচ সে ইহা হইতে এত দূরে। সতীশ তাহার কানের কাছে কী বলিতেছিল, বিনয় তাহা মন দিয়া শুনিতেই পারিল না।

পরেশবাবুর স্ত্রী তাঁহার তিন মেয়েকে সঙ্গে করিয়া ছাতে আসিলেন– সঙ্গে একজন যুবক আসিল, সে তাঁহাদের দূর আত্মীয়।

পরেশবাবুর স্ত্রীর নাম বরদাসুন্দরী। তাঁহার বয়স অল্প নহে কিন্তু দেখিলেই বোঝা যায় যে বিশেষ যত্ন করিয়া সাজ করিয়া আসিয়াছেন। বড়োবয়স পর্যন্ত পাড়াগেঁয়ে মেয়ের মতো কাটাইয়া হঠাৎ এক সময় হইতে আধুনিক কালের সঙ্গে সমান বেগে চলিবার জন্য ব্যস্ত হইয়া পড়িয়াছেন; সেইজন্যই তাঁহার সিল্কের শাড়ি বেশি খস্‌খস্‌ এবং উঁচু গোড়ালির জুতা বেশি খট্‌খট্‌ শব্দ করে। পৃথিবীতে কোন্‌ জিনিসটা ব্রাহ্ম এবং কোনটা অব্রাহ্ম তাহারই ভেদ লইয়া তিনি সর্বদাই অত্যন্ত সতর্ক হইয়া থাকেন। সেইজন্যই রাধারানীর নাম পরিবর্তন করিয়া তিনি সুচরিতা রাখিয়াছেন। কোনো-এক সম্পর্কে তাঁহার এক শ্বশুর বহুদিন পরে বিদেশের কর্মস্থান হইতে ফিরিয়া আসিয়া তাঁহাদিগকে জামাইষষ্ঠী পাঠাইয়াছিলেন। পরেশবাবু তখন কর্ম উপলক্ষে অনুপস্থিত ছিলেন। বরদাসুন্দরী এই জামাইষষ্ঠীর উপহার সমস্ত ফেরত পাঠাইয়াছিলেন। তিনি এ-সকল ব্যাপারকে কুসংস্কার ও পৌত্তলিকতার অঙ্গ বলিয়া জ্ঞান করেন। মেয়েদের পায়ে মোজা দেওয়াকে এবং টুপি পরিয়া বাহিরে যাওয়াকে তিনি এমনভাবে দেখেন যেন তাহাও ব্রাহ্মসমাজের ধর্মমতের একটা অঙ্গ। কোনো ব্রাহ্ম-পরিবারে মাটিতে আসন পাতিয়া খাইতে দেখিয়া তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করিয়াছিলেন যে, আজকাল ব্রাহ্মসমাজ পৌত্তলিকতার অভিমুখে পিছাইয়া পড়িতেছে।

তাঁহার বড়ো মেয়ের নাম লাবণ্য। সে মোটাসোটা, হাসিখুশি, লোকের সঙ্গ এবং গল্পগুজব ভালোবাসে। মুখটি গোলগাল, চোখ দুটি বড়ো, বর্ণ উজ্জ্বল শ্যাম। বেশভূষার ব্যাপারে সে স্বভাবতই কিছু ঢিলা, কিন্তু এ সম্বন্ধে তাহার মাতার শাসনে তাহাকে চলিতে হয়। উঁচু গোড়ালির জুতা পরিতে সে সুবিধা বোধ করে না, তবু না পরিয়া উপায় নাই। বিকালে সাজ করিবার সময় মা স্বহস্তে তাহার মুখে পাউডার ও দুই গালে রঙ লাগাইয়া দেন। একটু মোটা বলিয়া বরদাসুন্দরী তাহার জামা এমনি আঁট করিয়া তৈরি করিয়াছেন যে, লাবণ্য যখন সাজিয়া বাহির হইয়া আসে তখন মনে হয় যেন তাহাকে পাটের বস্তার মতো কলে চাপ দিয়া আঁটিয়া বাঁধা হইয়াছে।

মেজো মেয়ের নাম ললিতা। সে বড়ো মেয়ের বিপরীত বলিলেই হয়। তাহার দিদির চেয়ে সে মাথায় লম্বা, রোগা, রঙ আর-একটু কালো, কথাবার্তা বেশি কয় না, সে আপনার নিয়মে চলে, ইচ্ছা করিলে কড়া কড়া কথা শুনাইয়া দিতে পারে। বরদাসুন্দরী তাহাকে মনে মনে ভয় করেন, সহজে তাহাকে ক্ষুব্ধ করিয়া তুলিতে সাহস করেন না।

ছোটো লীলা, তাহার বয়স বছর দশেক হইবে। সে দৌড়ধাপ উপদ্রব করিতে মজবুত। সতীশের সঙ্গে তাহার ঠেলাঠেলি মারামারি সর্বদাই চলে। বিশেষত খুদে-নামধারী কুকুরটার স্বত্বাধিকার লইয়া উভয়ের মধ্যে আজ পর্যন্ত কোনো মীমাংসা হয় নাই। কুকুরের নিজের মত লইলে সে বোধ হয় উভয়ের মধ্যে কাহাকেও প্রভুরূপে নির্বাচন করিত না; তবু দুজনের মধ্যে সে বোধ করি সতীশকেই কিঞ্চিৎ পছন্দ করে। কারণ, লীলার আদরের বেগ সম্বরণ করা এই ছোটো জন্তুটার পক্ষে সহজ ছিল না। বালিকার আদরের চেয়ে বালকের শাসন তাহার কাছে অপেক্ষাকৃত সুসহ ছিল।

বরদাসুন্দরী আসিতেই বিনয় উঠিয়া দাঁড়াইয়া অবনত হইয়া তাঁহাকে প্রণাম করিল। পরেশবাবু কহিলেন, “এঁরই বাড়িতে সেদিন আমরা–”

0 Shares