গোরা

সুচরিতা কহিল, “বাবা রাজি হবেন।”

আনন্দময়ী কহিলেন, “তার পরে, তোমাকেও, মা, সেখান যেতে হচ্ছে। এই তো সোমবারে বিয়ে! এই ক’দিন সেখানে থেকে আমাদের তো সমস্ত গুছিয়ে-গাছিয়ে নিতে হবে। সময় তো বেশি নেই। আমি একলাই সমস্ত করে নিতে পারি, কিন্তু তুমি এতে না থাকলে বিনয়ের ভারি কষ্ট হবে। সে মুখ ফুটে তোমাকে অনুরোধ করতে পারছে না–এমন-কি, আমার কাছেও সে তোমার নাম করে নি, তাতেই আমি বুঝতে পারছি ওখানে তার খুব একটা ব্যথা আছে। তুমি কিন্তু সরে থাকলে চলবে না মা! ললিতাকেও সে বড়ো বাজবে।”

সুচরিতা একটু বিস্মিত হইয়া কহিল, “মা, তুমি এই বিয়েতে যোগ দিতে পারবে?”

আনন্দময়ী কহিলেন, “বল কী সুচরিতা! যোগ দেওয়া কী বলছ! আমি কি বাইরের লোক যে শুধু যোগ দেব! এ যে বিনয়ের বিয়ে। এ তো আমাকেই সমস্ত করতে হবে। আমি কিন্তু বিনয়কে বলে রেখেছি, “এ বিয়েতে আমি তোমার কেউ নয়, আমি কন্যাপক্ষে’–আমার ঘরে সে ললিতাকে বিয়ে করতে আসছে।”

মা থাকিতেও শুভকর্মে ললিতাকে তাহার মা পরিত্যাগ করিয়াছেন, সে করুণায় আনন্দময়ীর হৃদয় পূর্ণ হইয়া রহিয়াছে। সেই কারণেই এই বিবাহে যাহাতে কোনো অনাদর-অশ্রদ্ধার লক্ষণ না থাকে সেইজন্য তিনি একান্তমনে চেষ্টা করিতেছেন। তিনি ললিতার মায়ের স্থান লইয়া নিজের হাতে ললিতাকে সাজাইয়া দিবেন, বরকে বরণ করিয়া লইবার ব্যবস্থা করিবেন–যদি নিমন্ত্রিত দুই-চারি জন আসে তাহাদের আদর-অভ্যর্থনার লেশমাত্র ত্রুটি না হয় তাহা দেখিবেন, এবং এই নূতন বাসাবাড়িকে এমন করিয়া সাজাইয়া তুলিবেন যাহাতে ললিতা ইহাকে একটা বাসস্থান বলিয়া অনুভব করিতে পারে, ইহাই তাঁহার সংকল্প।

সুচরিতা কহিল, “এতে তোমাকে নিয়ে কোনো গোলমাল হবে না?”

বাড়িতে মহিম যে তোলপাড় বাধাইয়াছে তাহা স্মরণ করিয়া আনন্দময়ী কহিলেন, “তা হতে পারে, তাতে কী হবে! গোলমাল কিছু হয়েই থাকে; চুপ করে সয়ে থাকলে আবার কিছুদিন পরে সমস্ত কেটেও যায়।”

সুচরিতা জানিত এই বিবাহে গোরা যোগ দেয় নাই। আনন্দময়ীকে বাধা দিবার জন্য গোরার কোনো চেষ্টা ছিল কি না ইহাই জানিবার জন্য সুচরিতার ঔৎসুক্য ছিল। সে কথা সে স্পষ্ট করিয়া পাড়িতে পারিল না, এবং আনন্দময়ী গোরার নামমাত্রও উচ্চারণ করিলেন না।

হরিমোহিনী খবর পাইয়াছিলেন। ধীরে সুস্থে হাতের কাজ সারিয়া তিনি ঘরের মধ্যে আসিলেন এবং কহিলেন, “দিদি, ভালো আছ তো? দেখাই নেই, খবরই নাও না।”

আনন্দময়ী সেই অভিযোগের উত্তর না করিয়া কহিলেন, “তোমার বোনঝিকে নিতে এসেছি।”

এই বলিয়া তাঁহার উদ্দেশ্য ব্যক্ত করিয়া বলিলেন। হরিমোহিনী অপ্রসন্ন মুখে কিছুক্ষণ চুপ করিয়া রহিলেন; পরে কহিলেন, “আমি তো এর মধ্যে যেতে পারব না।”

আনন্দময়ী কহিলেন, “না বোন, তোমাকে আমি যেতে বলি নে। সুচরিতার জন্যে তুমি ভেবো না, আমি তো ওর সঙ্গেই থাকব।”

হরিমোহিনী কহিলেন, “তবে বলি। রাধারানী তো লোকের কাছে বলছেন উনি হিন্দু। এখন ওঁর মতিগতি হিঁদুয়ানির দিকে ফিরেছে। তা, উনি যদি হিন্দুসমাজে চলতে চান তা হলে ওঁকে সাবধান হতে হবে। অমনিতেই তো ঢের কথা উঠবে, তা সে আমি কাটিয়ে দিতে পারব, কিন্তু এখন থেকে কিছুদিন ওঁকে সামলে চলা চাই। লোকে তো প্রথমেই জিজ্ঞাসা করে, এত বয়স হল ওঁর বিয়েথাওয়া হল না কেন। সে একরকম করে চাপাচুপি দিয়ে রাখা চলে, ভালো পাত্রও যে চেষ্টা করলে জোটে না তা নয়, কিন্তু উনি যদি আবার ওঁর সাবেক চাল ধরেন তা হলে আমি কত দিকে সামলাব বলো। তুমি তো হিঁদুঘরের মেয়ে, তুমি তো সব বোঝ, তুমিই বা এমন কথা বল কোন্‌ মুখে? তোমার নিজের মেয়ে যদি থাকত তাকে কি এই বিয়েতে পাঠাতে পারতে? তোমাকে তো ভাবতে হত মেয়ের বিয়ে দেবে কেমন করে।”

আনন্দময়ী বিস্মিত হইয়া সুচরিতার মুখের দিকে চাহিলেন; তাহার মুখ রক্তবর্ণ হইয়া ঝাঁ ঝাঁ করিতে লাগিল। আনন্দময়ী কহিলেন, “আমি কোনো জোর করতে চাই নে। সুচরিতা যদি আপত্তি করেন তবে আমি–”

হরিমোহিনী বলিয়া উঠিলেন, “আমি তো তোমাদের ভাব কিছুই বুঝে উঠতে পারি নে। তোমারই তো ছেলে ওঁকে হিন্দুমতে লইয়েছেন, তুমি হঠাৎ আকাশ থেকে পড়লে চলবে কেন?”

পরেশবাবুর বাড়িতে সর্বদাই অপরাধভীরুর মতো যে হরিমোহিনী ছিলেন, যিনি কোনো মানুষকে ঈষৎমাত্র অনুকূল বোধ করিলেই একান্ত আগ্রহের সহিত অবলম্বন করিয়া ধরিতেন, সে হরিমোহিনী কোথায়? নিজের অধিকার রক্ষা করিবার জন্য ইনি আজ বাঘিনীর মতো দাঁড়াইয়াছেন; তাঁহার সুচরিতাকে তাঁহার কাছ হইতে ভাঙাইয়া লইবার জন্য চারি দিকে নানা বিরুদ্ধ শক্তি কাজ করিতেছে এই সন্দেহে তিনি সর্বদাই কণ্টকিত হইয়া আছেন। কে স্বপক্ষ কে বিপক্ষ তাহা বুঝিতেই পারিতেছেন না, এইজন্য তাঁহার মনে আজ আর স্বচ্ছন্দতা নাই। পূর্বে সমস্ত সংসারকে শূন্য দেখিয়া যে দেবতাকে ব্যাকুলচিত্তে আশ্রয় করিয়াছিলেন সেই দেবপূজাতেও তাঁহার চিত্ত স্থির হইতেছে না। একদিন তিনি ঘোরতর সংসারী ছিলেন–নিদারুণ শোকে যখন তাঁহার বিষয়ে বৈরাগ্য জন্মিয়াছিল তখন তিনি মনেও করিতে পারেন নাই যে আবার কোনোদিন তাঁহার টাকাকড়ি ঘরবাড়ি আত্মীয়পরিজনের প্রতি কিছুমাত্র আসক্তি ফিরিয়া আসিবে; কিন্তু আজ হৃদয়ক্ষতের একটু আরোগ্য হইতেই সংসার পুনরায় তাঁহার সম্মুখে আসিয়া তাঁহার মনকে টানাটানি করিতে আরম্ভ করিয়াছে, আবার সমস্ত আশা-আকাঙক্ষা তাহার অনেক দিনের ক্ষুধা লইয়া পূর্বের মতোই জাগিয়া উঠিতেছে, যাহা ত্যাগ করিয়া আসিয়াছিলেন সেই দিকে পুনর্বার ফিরিবার বেগ এমনি উগ্র হইয়া উঠিয়াছে যে সংসারে যখন ছিলেন তখনো তাঁহাকে এত চঞ্চল করিতে পারে নাই। অল্প কয় দিনেই হরিমোহিনীর মুখে চক্ষে, ভাবে ভঙ্গীতে, কথায় ব্যবহারে এই অভাবনীয় পরিবর্তনের লক্ষণ দেখিয়া আনন্দময়ী একেবারে আশ্চর্য হইয়া গেলেন এবং সুচরিতার জন্য তাঁহার স্নেহকোমল হৃদয়ে অত্যন্ত ব্যথা বোধ করিতে লাগিলেন। এমন যে একটা সংকট প্রচ্ছন্ন হইয়া আছে তাহা জানিলে তিনি কখনোই সুচরিতাকে ডাকিতে আসিতেন না। এখন কী করিলে সুচরিতাকে আঘাত হইতে বাঁচাইতে পারিবেন সে তাহার পক্ষে একটা সমস্যার বিষয় হইয়া উঠিল।

0 Shares