গোরা

গোরার প্রতি লক্ষ করিয়া যখন হরিমোহিনী কথা কহিলেন তখন সুচরিতা মুখ নত করিয়া নীরবে ঘর হইতে উঠিয়া চলিয়া গেল।

আনন্দময়ী কহিলেন, “তোমার ভয় নেই বোন! আমি তো আগে জানতুম না। তা, আর ওকে পীড়াপীড়ি করব না। তুমিও ওকে আর কিছু বোলো না। ও আগে একরকম করে মানুষ হয়েছে, হঠাৎ ওকে যদি বেশি চাপ দাও সে আবার সইবে না।”

হরিমোহিনী কহিলেন, “সে কি আমি বুঝি নে, আমার এত বয়স হল! তোমার মুখের সামনেই বলুক-না, আমি কি ওকে কোনোদিন কিছু কষ্ট দিয়েছি। ওর যা খুশি তাই তো করছে, আমি কখনো একটি কথা কই নে–বলি, ভগবান ওকে বাঁচিয়ে রাখুন সেই আমার ঢের–যে আমার কপাল, কোন্‌দিন কী ঘটে সেই ভয়ে ঘুম হয় না।”

আনন্দময়ী যাইবার সময় সুচরিতা তাহার ঘর হইতে বাহির হইয়া তাঁহাকে প্রণাম করিল। আনন্দময়ী সকরুণ স্নেহে তাহাকে স্পর্শ করিয়া কহিলেন, “আমি আসব, মা, তোমাকে সব খবর দিয়ে যাব–কোনো বিঘ্ন হবে না–ঈশ্বরের আশীর্বাদে শুভকর্ম সম্পন্ন হয়ে যাবে।”

সুচরিতা কোনো কথা কহিল না।

পরদিন প্রাতে আনন্দময়ী লছমিয়াকে লইয়া যখন সেই বাসাবাড়ির বহুদিনসঞ্চিত ধূলি ক্ষয় করিবার জন্য একেবারে জলপ্লাবন বাধাইয়া দিয়াছেন এমন সময় সুচরিতা আসিয়া উপস্থিত হইল। আনন্দময়ী তাড়াতাড়ি ঝাঁটা ফেলিয়া দিয়া তাহাকে বুকে টানিয়া লইলেন।

তার পরে ধোওয়ামোছা জিনিসপত্র-নাড়াচাড়া ও সাজানোর ধুম পড়িয়া গেল। পরেশবাবু খরচের জন্য সুচরিতার হাতে উপযুক্ত পরিমাণ টাকা দিয়াছিলেন; সেই তহবিল লইয়া উভয়ে মিলিয়া বার বার করিয়া কত ফর্দ তৈরি এবং তাহার সংশোধনে প্রবৃত্ত হইলেন।

অনতিকাল পরে পরেশ স্বয়ং ললিতাকে লইয়া সেখানে উপস্থিত হইলেন। ললিতার পক্ষে তাহার বাড়ি অসহ্য হইয়াছিল। কেহ তাহাকে কোনো কথা বলিতে সাহস করিত না, কিন্তু তাহাদের নীরবতা পদে পদে তাহাকে আঘাত করিতে লাগিল। অবশেষে বরদাসুন্দরীর প্রতি সমবেদনা প্রকাশ করিবার জন্য যখন তাঁহার বন্ধুবান্ধবগণ দলে দলে বাড়ি আসিতে লাগিল তখন পরেশ ললিতাকে এ বাড়ি হইতে লইয়া যাওয়াই শ্রেয় জ্ঞান করিলেন। ললিতা বিদায় হইবার সময় বরদাসুন্দরীকে প্রণাম করিতে গেল; তিনি মুখ ফিরাইয়া বসিয়া রহিলেন এবং সে চলিয়া গেলে অশ্রুপাত করিতে লাগিলেন। ললিতার বিবাহ-ব্যাপারে লাবণ্য ও লীলার মনে মনে যথেষ্ট ঔৎসুক্য ছিল; কোনো উপায়ে যদি তাহারা ছুটি পাইত তবে বিবাহ-আসরে ছুটিয়া যাইতে এক মুহূর্ত বিলম্ব করিত না। কিন্তু ললিতা যখন বিদায় হইয়া গেল তখন ব্রাহ্মপরিবারের কঠোর কর্তব্য স্মরণ করিয়া তাহারা মুখ অত্যন্ত গম্ভীর করিয়া রহিল। দরজার কাছে সুধীরের সঙ্গে চকিতের মতো ললিতার দেখা হইল; কিন্তু সুধীরের পশ্চাতেই তাহাদের সমাজের আরো কয়েক জন প্রবীণ ব্যক্তি ছিলেন, এই কারণে তাহার সঙ্গে কোনো কথা হইতেই পারিল না। গাড়িতে উঠিয়া ললিতা দেখিল আসনের এক কোণে কাগজে মোড়া কী-একটা রহিয়াছে। খুলিয়া দেখিল, জর্মান-রৌপ্যের একটি ফুলদানি, তাহার গায়ে ইংরাজি ভাষায় খোদা রহিয়াছে, “আনন্দিত দম্পতিকে ঈশ্বর আশীর্বাদ করুন’ এবং একটি কার্ডে ইংরাজিতে সুধীরের কেবল নামের আদ্যক্ষরটি ছিল। ললিতা আজ হৃদয়কে কঠিন করিয়া পণ করিয়াছিল সে চোখের জল ফেলিবে না, কিন্তু পিতৃগৃহ হইতে বিদায়মুহূর্তে তাহাদের বাল্যবন্ধুর এই একটিমাত্র স্নেহোপহার হাতে লইয়া তাহার দুই চক্ষু দিয়া ঝর্‌ ঝর্‌ করিয়া জল ঝরিয়া পড়িতে লাগিল। পরেশবাবু চক্ষু মুদ্রিত করিয়া স্থির হইয়া বসিয়া রহিলেন।

আনন্দময়ী “এসো এসো, মা এসো” বলিয়া ললিতার দুই হাত ধরিয়া তাহাকে ঘরে লইয়া আসিলেন, যেন এখনই তাহার জন্য তিনি প্রতীক্ষা করিয়া ছিলেন।

পরেশবাবু সুচরিতাকে ডাকাইয়া আনিয়া কহিলেন, “ললিতা আমার ঘর থেকে একেবারে বিদায় নিয়ে এসেছে।”

পরেশের কণ্ঠস্বর কম্পিত হইয়া গেল।

সুচরিতা পরেশের হাত ধরিয়া কহিল, “এখানে ওর স্নেহযত্নের কোনো অভাব হবে না বাবা!”

পরেশ যখন চলিয়া যাইতে উদ্যত হইয়াছেন এমন সময়ে আনন্দময়ী মাথার উপর কাপড় টানিয়া তাঁহার সম্মুখে আসিয়া তাঁহাকে নমস্কার করিলেন। পরেশ ব্যস্ত হইয়া তাঁহাকে প্রতিনমস্কার করিলেন। আনন্দময়ী কহিলেন, “ললিতার জন্যে আপনি কোনো চিন্তা মনে রাখবেন না। আপনি যার হাতে ওকে সমর্পণ করছেন তার দ্বারা ও কখনো কোনো দুঃখ পাবে না–আর ভগবান এতকাল পরে আমার এই একটি অভাব দূর করে দিলেন, আমার মেয়ে ছিল না, আমি মেয়ে পেলুম। বিনয়ের বউটিকে নিয়ে আমার কন্যার দুঃখ ঘুচবে অনেক দিন ধরে এই আশাপথ চেয়ে বসে ছিলুম; তা অনেক দেরিতে যেমন ঈশ্বর আমার কামনা পূরণ করে দিলেন, তেমনি এমন মেয়ে দিলেন আর এমন আশ্চর্য রকম করে দিলেন যে, আমি আমার এমন ভাগ্য কখনো মনে চিন্তাও করতে পারতুম না।”

ললিতার বিবাহের আন্দোলন আরম্ভ হওয়ার পর হইতে এই প্রথম পরেশবাবুর চিত্ত সংসারের মধ্যে এক জায়গায় একটা কূল দেখিতে পাইল এবং যথার্থ সান্ত্বনা লাভ করিল।

৬৭

কারাগার হইতে বাহির হওয়ার পর হইতে গোরার কাছে সমস্ত দিন এত লোক-সমাগম হইতে লাগিল যে তাহাদের স্তবস্তুতি ও আলাপ-আলোচনার নিশ্বাসরোধকর অজস্র বাক্যরাশির মধ্যে বাড়িতে বাস করা তাহার পক্ষে অসাধ্য হইয়া উঠিল।

0 Shares