গোরা

এই বলিয়া কৈলাস যে কিরূপ আশ্চর্য লেখাপড়া করিয়াছে, সে যে তাহার কলমের এক আঁচড়-মাত্রে তাহার গ্রামের পোস্ট্‌মাস্টারকে কিরূপ বিপন্ন করিয়াছিল–নিকটবর্তী চারি দিকের গ্রামের যে-কাহারোই মামলা-মকদ্দমা করিতে হয়, দরখাস্ত লিখিতে হয়, কৈলাসের পরামর্শ ব্যতীত যে কাহারো এক পা চলিবার জো নাই–ইহা তিনি বিবৃত করিয়া বলিলেন। আর, উহার স্বভাবচরিত্রের কথা বেশি করিয়া বলাই বাহুল্য। ওর স্ত্রী মরার পর ও তো কিছুতেই বিবাহ করিতে চায় নাই; আত্মীয়স্বজন সকলে মিলায় অত্যন্ত বলপ্রয়োগ করাতে ও কেবল গুরুজনের আদেশ পালন করিতে প্রবৃত্ত হইয়াছে। উপস্থিত প্রস্তাবে সম্মত করিতে হরিমোহিনীকেই কি কম কষ্ট পাইতে হইয়াছে! ও কি কর্ণপাত করিতে চায়! ওরা যে মস্ত বংশ। সমাজে ওদের যে ভারি মান।

সুচরিতা এই মান খর্ব করিতে কিছুতেই স্বীকার করিল না। কোনোমতেই না। সে নিজের গৌরব ও স্বার্থের প্রতি দৃক্‌পাতমাত্র করিল না। এমন-কি, হিন্দুসমাজে তাহার স্থান যদি নাও হয় তথাপি সে লেশমাত্র বিচলিত হইবে না, এইরূপ তাহার ভাব দেখা গেল। কৈলাসকে বহু চেষ্টায় বিবাহে রাজি করানোতে সুচরিতার পক্ষে অল্প সম্মানের কারণ হয় নাই এ কথা সে মূঢ় কিছুতেই উপলব্ধি করিতে পারিল না, উলটিয়া সে ইহাকে অপমানের কারণ বলিয়া গণ্য করিয়া বসিল। আধুনিক কালের এই-সমস্ত বিপরীত ব্যাপারে হরিমোহিনী সম্পূর্ণ হতবুদ্ধি হইয়া গেলেন।

তখন তিনি মনের আক্রোশে বার বার গোরার প্রতি ইঙ্গিত করিয়া খোঁচা দিতে লাগিলেন। গোরা যতই নিজেকে হিন্দু বলিয়া বড়াই করুক-না কেন, সমাজের মধ্যে উহার স্থান কী! উহাকে কে মানে! ও যদি লোভে পড়িয়া ব্রাহ্মঘরের কোনো টাকাওয়ালা মেয়েকে বিবাহ করে তবে সমাজের শাসন হইতে ও পরিত্রাণ লাভ করিবে কিসের জোরে! তখন দশের মুখ বন্ধ করিয়া দিবার জন্য টাকা যে সমস্ত ফুঁকিয়া দিতে হইবে। ইত্যাদি।

সুচরিতা কহিল, “মাসি, এ-সব কথা তুমি কেন বলছ? তুমি জান এ-সব কথার কোনো মূল্য নেই।”

হরিমোহিনী তখন বলিলেন, তাঁহার যে বয়স হইয়াছে সে বয়সে কথা দিয়া তাঁহাকে ভোলানো কাহারো পক্ষে সাধ্য নহে। তিনি চোখ-কান খুলিয়াই আছেন; দেখেন শোনেন বুঝেন সমস্তই, কেবল নিঃশব্দে অবাক হইয়া রহিয়াছেন। গোরা যে তাহার মাতার সঙ্গে পরামর্শ করিয়া সুচরিতাকে বিবাহ করিবার চেষ্টা করিতেছে, সে বিবাহের গূঢ় উদ্দেশ্যও যে মহৎ নহে, এবং রায়গোষ্ঠীর সহযোগে যদি তিনি সুচরিতাকে রক্ষা করিতে না পারেন তবে কালে যে তাহাই ঘটিবে, সে সম্বন্ধে তিনি তাঁহার নিঃসংশয় বিশ্বাস প্রকাশ করিলেন।

সহিষ্ণুস্বভাব সুচরিতার পক্ষে অসহ্য হইয়া উঠিল; সে কহিল, “তুমি যাঁদের কথা বলছ আমি তাঁদের ভক্তি করি, তাঁদের সঙ্গে আমার যে সম্বন্ধ সে যখন তুমি কোনো-মতেই ঠিকভাবে বুঝবে না তখন আমার আর কোনো উপায় নেই, আমি এখনই এখান থেকে চললুম–যখন তুমি শান্ত হবে এবং বাড়িতে তোমার সঙ্গে একলা এসে বাস করতে পারব তখন আমি ফিরে আসব।”

হরিমোহিনী কহিলেন, “গৌরমোহনের প্রতিই যদি তোর মন নেই, যদি তার সঙ্গে তোর বিয়ে হবেই না এমন কথা থাকে, তবে এই পাত্রটি দোষ করেছে কী? তুমি তো আইবুড়ো থাকবে না?”

সুচরিতা কহিল, “কেন থাকব না! আমি বিবাহ করব না।”

হরিমোহিনী চক্ষু বিস্ফারিত করিয়া কহিলেন, “বুড়োবয়স পর্যন্ত এমনি–”

সুচরিতা কহিল, “হাঁ, মৃত্যু পর্যন্ত।”

৭১

এই আঘাতে গোরার মনে একটা পরিবর্তন আসিল। সুচরিতার দ্বারা গোরার মন যে আক্রান্ত হইয়াছে তাহার কারণ সে ভাবিয়া দেখিল–সে ইহাদের সঙ্গে মিশিয়াছে, কখন্‌ নিজের অগোচরে সে ইহাদের সঙ্গে নিজেকে জড়িত করিয়া ফেলিয়াছে। যেখানে নিষেধের সীমা টানা ছিল সেই সীমা গোরা দম্ভভরে লঙ্ঘন করিয়াছে। ইহা আমাদের দেশের পদ্ধতি নহে। প্রত্যেকে নিজের সীমা রক্ষা করিতে না পারিলে সে যে কেবল জানিয়া এবং না জানিয়া নিজেরই অনিষ্ট করিয়া ফেলে তাহা নহে, অন্যেরও হিত করিবার বিশুদ্ধ শক্তি তাহার চলিয়া যায়। সংসর্গের দ্বার নানাপ্রকার হৃদয়বৃত্তি প্রবল হইয়া উঠিয়া জ্ঞানকে নিষ্ঠাকে শক্তিকে আবিল করিয়া তুলিতে থাকে।

কেবল ব্রাহ্মঘরের মেয়েদের সঙ্গে মিশিতে গিয়াই সে এই সত্য আবিষ্কার করিয়াছে তাহা নহে। গোরা জনসাধারণের সঙ্গে যে মিলিতে গিয়াছিল সেখানেও একটা যেন আবর্তের মধ্যে পড়িয়া নিজেকে নিজে হারাইবার উপক্রম করিয়াছিল। কেননা, তাহার পদে পদে দয়া জন্মিতেছিল; এই দয়ার বশে সে কেবলই ভাবিতেছিল এটা মন্দ, এটা অন্যায়, এটাকে দূর করিয়া দেওয়া উচিত। কিন্তু এই দয়াবৃত্তিই কি ভালো-মন্দ-সুবিচারের ক্ষমতাকে বিকৃত করিয়া দেয় না? দয়া করিবার ঝোঁকটা আমাদের যতই বাড়িয়া উঠে নির্বিকারভাবে সত্যকে দেখিবার শক্তি আমাদের ততই চলিয়া যায়–প্রধূমিত করুণার কালিমা মাখাইয়া যাহা নিতান্ত ফিকা তাহাকে অত্যন্ত গাঢ় করিয়া দেখি।

গোরা কহিল–এইজন্যই, যাহার প্রতি সমগ্রের হিতের ভার তাহার নির্লিপ্ত থাকিবার বিধি আমাদের দেশে চলিয়া আসিয়াছে। প্রজার সঙ্গে একেবারে ঘনিষ্ঠভাবে মিশিলে তবেই যে প্রজাপালন করা রাজার পক্ষে সম্ভব হয় এ কথা সম্পূর্ণ অমূলক। প্রজাদের সম্বন্ধে রাজার যেরূপ জ্ঞানের প্রয়োজন সংস্রবের দ্বারা তাহার কলুষিত হয়। এই কারণে, প্রজারা নিজেই ইচ্ছা করিয়া তাহাদের রাজাকে দূরত্বের দ্বারা বেষ্টন করিয়া রাখিয়াছে। রাজা তাহাদের সহচর হইলেই রাজার প্রয়োজন চলিয়া যাইবে।

0 Shares