গোরা

গোরা হৃদয়ে আঘাত পাইয়া কহিল, “দেখুন, এ আমার নিজের কাজ। আমি নিজের শুচিতার জন্যই এই আয়োজন করছি–এ নিয়ে বৃথা আলোচনা করে আপনি কেন কষ্ট পাচ্ছেন?”

কৃষ্ণদয়াল কহিলেন, “দেখো গোরা, তুমি সকল কথায় কেবল তর্ক করতে যেয়ো না। এ-সমস্ত তর্কের বিষয়ই নয়। এমন ঢের জিনিস আছে যা এখনো তোমার বোঝবার সাধ্যই নেই। আমি তোমাকে ফের বলে যাচ্ছি–হিন্দুধর্মে তুমি প্রবেশ করতে পেরেছ এইটে তুমি মনে করছ, কিন্তু সে তোমার সম্পূর্ণই ভুল। সে তোমার সাধ্যই নেই–তোমার প্রত্যেক রক্তের কণা, তোমার মাথা থেকে পা পর্যন্ত তার প্রতিকূল। হিন্দু হঠাৎ হবার জো নেই, ইচ্ছা করলেও জো নেই। জন্মজন্মান্তরের সুকৃতি চাই।”

গোরার মুখ রক্তবর্ণ হইয়া উঠিল। সে কহিল, “জন্মান্তরের কথা জানি নে, কিন্তু আপনাদের বংশের রক্তধারায় যে অধিকার প্রবাহিত হয়ে আসছে আমি কি তারও দাবি করতে পারব না?”

কৃষ্ণদয়াল কহিলেন, “আবার তর্ক? আমার মুখের উপর প্রতিবাদ করতে তোমার সংকোচ হয় না? এ দিকে বল হিন্দু! বিলাতি ঝাঁজ যাবে কোথায়! আমি যা বলি তাই শোনো। ও-সমস্ত বন্ধ করে দাও।”

গোরা নতশিরে চুপ করিয়া দাঁড়াইয়া রহিল। একটু পরে কহিল, “যদি প্রায়শ্চিত্ত না করি তা হলে কিন্তু শশিমুখীর বিবাহে আমি সকলের সঙ্গে বসে খেতে পারব না।”

কৃষ্ণদয়াল উৎসাহিত হইয়া বলিয়া উঠিলেন, “বেশ তো। তাতেই বা দোষ কী? তোমার জন্যে নাহয় আলাদা আসন করে দেবে।”

গোরা কহিল, “সমাজে তা হলে আমাকে স্বতন্ত্র হয়েই থাকতে হবে।”

কৃষ্ণদয়াল কহিলেন, “সে তো ভালোই।”

তাঁহার এই উৎসাহে গোরাকে বিস্মিত হইতে দেখিয়া কহিলেন, “এই দেখো-না, আমি কারো সঙ্গে খাই নে, নিমন্ত্রণ হলেও না। সমাজের সঙ্গে আমার যোগ কীই বা আছে? তুমি যেরকম সাত্ত্বিকভাবে জীবন কাটাতে চাও তোমারও তো এইরকম পন্থাই অবলম্বন করা শ্রেয়। আমি তো দেখছি এতেই তোমার মঙ্গল।”

মধ্যাহ্নে অবিনাশকে ডাকাইয়া কৃষ্ণদয়াল কহিলেন, “তোমরাই বুঝি সকলে মিলে গোরাকে নাচিয়ে তুলেছ।”

অবিনাশ কহিলেন, “বলেন কী, আপনার গোরাই তো আমাদের সকলকে নাচায়। বরঞ্চ সে নিজেই নাচে কম।”

কৃষ্ণদয়াল কহিলেন, “কিন্তু বাবা, আমি বলছি, তোমাদের ও-সব প্রায়শ্চিত্ত-টিত্ত হবে না। আমার ওতে একেবারেই মত নেই। এখনই সব বন্ধ করে দাও।”

অবিনাশ ভাবিল, বুড়ার এ কী রকম জেদ। ইতিহাসে বড়ো বড়ো লোকের বাপরা নিজের ছেলের মহত্ত্ব বুঝিতে পারে নাই এমন দৃষ্টান্ত ঢের আছে, কৃষ্ণদয়ালও সেই জাতেরই বাপ। কতকগুলা বাজে সন্ন্যাসীর কাছে দিনরাত না থাকিয়া কৃষ্ণদয়াল যদি তাঁহার ছেলের কাছে শিক্ষা গ্রহণ করিতে পারিতেন তাহা হইতে তাঁহার ঢের উপকার হইত।

অবিনাশ কৌশলী লোক; যেখানে বাদপ্রতিবাদ করিয়া ফল নাই, এমন-কি মরাল এফেক্‌টেরও সম্ভাবনা অল্প, সেখানে সে বৃথা বাক্যব্যয় করিবার লোক নয়। সে কহিল, “বেশ তো মশায়, আপনার যদি মত না থাকে তো হবে না। তবে কিনা উদ্‌যোগ-আয়োজন সমস্তই হয়েছে, নিমন্ত্রণপত্রও বেরিয়ে গেছে–এ দিকে আর বিলম্বও নেই–তা নয় এক কাজ করা যাবে–গোরা থাকুন, সেদিন আমরাই প্রায়শ্চিত্ত করব–দেশের লোকের পাপের তো অভাব নেই।”

অবিনাশের এই আশ্বাসবাক্যে কৃষ্ণদয়াল নিশ্চিন্ত হইলেন।

কৃষ্ণদয়ালের কোনো কথায় কোনোদিন গোরার বিশেষ শ্রদ্ধা ছিল না। আজও সে তাঁহার আদেশ পালন করিবে বলিয়া মনের মধ্যে স্বীকার করিল না। সাংসারিক জীবনের চেয়ে বড়ো যে জীবন, সেখানে গোরা পিতামাতার নিষেধকে মান্য করিতে নিজেকে বাধ্য মনে করে না। কিন্তু তবু আজ সমস্ত দিন তাহার মনের মধ্যে ভারি একটা কষ্ট বোধ হইতে লাগিল। কৃষ্ণদয়ালের সমস্ত কথার মধ্যে যেন কী-একটা সত্য প্রচ্ছন্ন আছে, তাহার মনের ভিতরে এইরকমের একটা অস্পষ্ট ধারণা জন্মিতেছিল। একটা যেন আকারহীন দুঃস্বপ্ন তাহাকে পীড়ন করিতেছিল, তাহাকে কোনোমতেই তাড়াইতে পারিতেছিল না। তাহার কেমন একরকম মনে হইল কে যেন সকল দিক হইতেই তাহাকে ঠেলিয়া সরাইয়া ফেলিবার চেষ্টা করিতেছে। নিজের একাকিত্ব তাহাকে আজ অত্যন্ত একটা বৃহৎ কলেবর ধরিয়া দেখা দিল। তাহার সম্মুখে কর্মক্ষেত্র অতি বিস্তীর্ণ, কাজও অতি প্রকাণ্ড, কিন্তু তাহার পাশে কেহই দাঁড়াইয়া নাই।

৭৩

কাল প্রায়শ্চিত্তসভা বসিবে, আজ রাত্রি হইতেই গোরা বাগানে গিয়া বাস করিবে এইরূপ স্থির আছে। যখন সে যাত্রা করিবার উপক্রম করিতেছে এমন সময় হরিমোহিনী আসিয়া উপস্থিত। তাঁহাকে দেখিয়া গোরা প্রসন্নতা অনুভব করিল না। গোরা কহিল, “আপনি এসেছেন–আমাকে যে এখনই বেরোতে হবে–মাও তো কয়েক দিন বাড়িতে নেই। যদি তাঁর সঙ্গে প্রয়োজন থাকে তা হলে–”

হরিমোহিনী কহিলেন, “না বাবা, আমি তোমার কাছেই এসেছি–একটু তোমাকে বসতেই হবে–বেশিক্ষণ না।”

গোরা বসিল। হরিমোহিনী সুচরিতার কথা পাড়িলেন। কহিলেন, গোরার শিক্ষা-গুণে তাহার বিস্তর উপকার হইয়াছে। এমন-কি, সে আজকাল যার-তার হাতের ছোঁওয়া জল খায় না এবং সকল দিকেই তাহার সুমতি জন্মিয়াছে–“বাবা, ওর জন্যেই কি আমার কম ভাবনা ছিল! ওকে তুমি পথে এনে আমার কী উপকার করেছ সে আমি তোমাকে এক মুখে বলতে পারি নে। ভগবান তোমাকে রাজরাজেশ্বর করুন। তোমার কুলমানের যোগ্য একটি লক্ষ্ণী মেয়ে ভালো ঘর থেকে বিয়ে করে আনো, তোমার ঘর উজ্জ্বল হোক, ধনেপুত্রে লক্ষ্ণীলাভ হোক।’

0 Shares