গোরা

হরিমোহিনীকে গোরা কহিল, “আপনি একটুখানি অপেক্ষা করুন, আমি এখনই আসছি।”

তাড়াতাড়ি গোরা তাহার পিতার মহলের দিকে গেল। তাহার মনে হইল, কৃষ্ণদয়াল এখনই তাহাকে নিষ্কৃতি দিতে পারেন এমন একটা কথা তাঁহার জানা আছে।

সাধনাশ্রমের দ্বার বদ্ধ। দুই-এক বার ধাক্কা দিল, খুলিল না–কেহ সাড়াও দিল না। ভিতর হইতে ধূপধুনার গন্ধ আসিতেছে। কৃষ্ণদয়াল আজ সন্ন্যাসীকে লইয়া অত্যন্ত গূঢ় এবং অত্যন্ত দুরূহ একটি যোগের প্রণালী সমস্ত দ্বার রুদ্ধ করিয়া অভ্যাস করিতেছেন–আজ সমস্ত রাত্রি সে দিকে কাহারো প্রবেশ করিবার অধিকার নাই।

৭৪

গোরা কহিল–“না। প্রায়শ্চিত্ত কাল না। আজই আমার প্রায়শ্চিত্ত আরম্ভ হয়েছে। কালকের চেয়ে ঢের বড়ো আগুন আজ জ্বলেছে। আমার নবজীবনের আরম্ভে খুব একটা বড়ো আহুতি আমাকে দিতে হবে বলেই বিধাতা আমার মনে এতবড়ো একটা প্রবল বাসনাকে জাগিয়ে তুলেছেন। নইলে এমন অদ্ভুত ঘটনা ঘটল কেন? আমি ছিলুম কোন্‌ ক্ষেত্রে! এদের সঙ্গে আমার মেলবার কোনো লৌকিক সম্ভাবনা ছিল না। আর এমন বিরুদ্ধভাবের মিলনও পৃথিবীতে সচরাচর ঘটে না। আবার সেই মিলনে আমার মতো উদাসীন লোকের চিত্তেও যে এতবড়ো দুর্জয় একটা বাসনা জাগতে পারে সে কথা কেউ কল্পনাও করতে পারত না। ঠিক আজই আমার এই বাসনার প্রয়োজন ছিল। আজ পর্যন্ত আমি দেশকে যা দিয়ে এসেছি তা অতি সহজেই দিয়েছি, এমন দান কিছু করতে হয় নি যাতে আমাকে কষ্টবোধ করতে হয়েছে। আমি ভেবেই পেতুম না, লোকে দেশের জন্যে কোনো জিনিস ত্যাগ করতে কিছুমাত্র কৃপণতা বোধ করে কেন। কিন্তু বড়ো যজ্ঞ এমন সহজ দান চায় না। দুঃখই চাই। নাড়ী ছেদন করে তবে আমার নবজীবন জন্মগ্রহণ করবে। কাল প্রাতে জনসমাজের কাছে আমার লৌকিক প্রায়শ্চিত্ত হবে। ঠিক তার পূর্বরাত্রেই আমার জীবনবিধাতা এসে আমার দ্বারে আঘাত করেছেন। অন্তরের মধ্যে আমার অন্তরতম প্রায়শ্চিত্ত না হলে কাল আমি শুদ্ধি গ্রহণ করব কেমন করে! যে দান আমার পক্ষে সকলের চেয়ে কঠিন দান সেই দান আমার দেবতাকে আজ সম্পূর্ণ উৎসর্গ করে দিয়ে তবেই আমি সম্পূর্ণ পবিত্ররূপে নিঃস্ব হতে পারব–তবেই আমি ব্রাহ্মণ হব।’

গোরা হরিমোহিনীর সম্মুখে আসিতেই তিনি বলিয়া উঠিলেন, “বাবা, একবার তুমি আমার সঙ্গে চলো। তুমি গেলে, তুমি মুখের একটি কথা বললেই সব হয়ে যাবে।”

গোরা কহিল, “আমি কেন যাব! তাঁর সঙ্গে আমার কী যোগ! কিছুই না।”

হরিমোহিনী কহিলেন, “সে যে তোমাকে দেবতার মতো ভক্তি করে–তোমাকে গুরু বলে মানে।”

গোরার হৃৎপিণ্ডের এক দিক হইতে আর-এক দিকে বিদ্যুৎতপ্ত বজ্রসূচী বিঁধিয়া গেল। গোরা কহিল, “আমার যাবার প্রয়োজন দেখি নে। তাঁর সঙ্গে আমার দেখা হবার আর-কোনো সম্ভাবনা নেই।”

হরিমোহিনী খুশি হইয়া কহিলেন, “সে তো বটেই। অতবড়ো মেয়ের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ হওয়াটা তো ভালো নয়। কিন্তু, বাবা, আজকের আমার এই কাজটি না করে দিয়ে তো তুমি ছাড়া পাবে না। তার পরে আর কখনো যদি তোমাকে ডাকি তখন বোলো।”

গোরা বার বার করিয়া মাথা নাড়িল। আর না, কিছুতে না। শেষ হইয়া গেছে। তাহার বিধাতাকে নিবেদন করা হইয়া গেছে। তাহার শুচিতায় এখন সে আর কোনো চিহ্ন ফেলিতে পারিবে না। সে দেখা করিতে যাইবে না।

হরিমোহিনী যখন গোরার ভাবে বুঝিলেন তাহাকে টলানো সম্ভব হইবে না তখন তিনি কহিলেন, “নিতান্তই যদি না যেতে পার তবে এক কাজ করো বাবা, একটা চিঠি তাকে লিখে দাও।”

গোরা মাথা নাড়িল। সে হইতেই পারে না। চিঠিপত্র নয়।

হরিমোহিনী কহিলেন, “আচ্ছা, তুমি আমাকেই দু-লাইন লিখে দাও। তুমি সব শাস্ত্রই জান, আমি তোমার কাছে বিধান নিতে এসেছি।”

গোরা জিজ্ঞাসা করিল, “কিসের বিধান?”

হরিমোহিনী কহিলেন, “হিন্দুঘরের মেয়ের উপযুক্ত বয়সে বিবাহ করে গৃহধর্ম পালন করাই সকলের চেয়ে বড়ো ধর্ম কি না।”

গোরা কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া কহিল, “দেখুন, আপনি এ-সমস্ত ব্যাপারে আমাকে জড়াবেন না। বিধান দেবার পণ্ডিত আমি নই।”

হরিমোহিনী তখন একটু তীব্রভাবে কহিলেন, “তোমার মনে ভিতরকার ইচ্ছাটা তা হলে খুলেই বলো-না। গোড়াতে ফাঁস জড়িয়েছ তুমিই, এখন খোলবার বেলায় বল “আমাকে জড়াবেন না’। এর মানেটা কী? আসল কথা, ইচ্ছেটা তোমার নয় যে ওর মন পরিষ্কার হয়ে যায়।”

অন্য কোনো সময় হইলে গোরা আগুন হইয়া উঠিত। এমনতরো সত্য অপবাদও সে সহ্য করিতে পারিত না। কিন্তু আজ তাহার প্রায়শ্চিত্ত আরম্ভ হইয়াছে; সে রাগ করিল না। সে মনের মধ্যে তলাইয়া দেখিল হরিমোহিনী সত্য কথাই বলিতেছেন। সে সুচরিতার সঙ্গে বড়ো বাঁধনটা কাটিয়া ফেলিবার জন্য নির্মম হইয়া উঠিয়াছে; কিন্তু একটি সূক্ষ্ণ সূত্র, যেন দেখিতে পায় নাই এমনি ছল করিয়া সে রাখিতে চায়। সে সুচরিতার সহিত সম্বন্ধকে একেবারে সম্পূর্ণরূপে ত্যাগ করিয়া দিতে এখনো পারে নাই।

কিন্তু কৃপণতা ঘুচাইতে হইবে। এক হাত দিয়া দান করিয়া আর-এক হাত দিয়া ধরিয়া রাখিলে চলবে না।

সে তখন কাগজ বাহির করিয়া বেশ জোরের সঙ্গে বড়ো অক্ষরে লিখিল–

“বিবাহই নারীর জীবনে সাধনার পথ, গৃহধর্মই তাহার প্রধান ধর্ম। এই বিবাহ ইচ্ছাপূরণের জন্য নহে, কল্যাণসাধনের জন্য। সংসার সুখেরই হউক আর দুঃখেরই হউক, একমনে সেই সংসারকেই বরণ করিয়া, সতী সাধ্বী পবিত্র হইয়া, ধর্মকেই রমণী গৃহের মধ্যে মূর্তিমান করিয়া রাখিবেন এই তাঁহাদের ব্রত।’

0 Shares