গোরা

পরেশ সুচরিতার এই প্রশ্নের মধ্যে বেদনার আভাস পাইয়া কহিলেন, “তাতে আমার তো কোনো কষ্ট নেই রাধে!”

সুচরিতা কহিল, “না বাবা, আমি তোমার সঙ্গে যাব।”

পরেশ সুচরিতার মুখের দিকে চাহিয়া ছিলেন। সুচরিতা কহিল, “বাবা, আমি তোমাকে কিছু বিরক্ত করব না।”

পরেশ কহিলেন, “সে কথা কেন বলছ? আমাকে তুমি কবে বিরক্ত করেছ মা?”

সুচরিতা কহিল, “তোমার কাছে না থাকলে আমার ভালো হবে না বাবা। আমি অনেক কথাই বুঝতে পারি নে। তুমি আমাকে বুঝিয়ে না দিলে আমি কিনারা পাব না। বাবা, তুমি যে আমাকে আমার নিজের বুদ্ধির উপরে নির্ভর করতে বল–আমার সে বুদ্ধি নেই, আমি মনের মধ্যে সে জোরও পাচ্ছি নে। তুমি আমাকে তোমার সঙ্গে নিয়ে চলো বাবা!”

এই বলিয়া সে পরেশের দিকে পিঠ করিয়া অত্যন্ত নতশিরে তোরঙ্গের কাপড় লইয়া পড়িল। তাহার চোখ দিয়া টপ্‌ টপ্‌ করিয়া জল পড়িতে লাগিল।

৭৫

গোরা লিখনটি লিখিয়া যখন হরিমোহিনীর হাতে দিল তখন তাহার মনে হইল সুচরিতা সম্বন্ধে সে যেন ত্যাগপত্র লিখিয়া দিল। কিন্তু দলিল লিখিয়া দিলেই তো তখনই কাজ শেষ হয় না। তাহার হৃদয় যে সে দলিলকে একেবারে অগ্রাহ্য করিয়া দিল। সে দলিলে কেবল গোরার ইচ্ছাশক্তি জোর কলমে নামসই করিয়া দিয়াছিল বটে, কিন্তু তাহার হৃদয়ের স্বাক্ষর তো তাহাতে ছিল না–হৃদয় তাই অবাধ্য হইয়াই রহিল। এমনি ঘোরতর অবাধ্যতা যে, সেই রাত্রেই গোরাকে একবার সুচরিতার বাড়ির দিকে দৌড় করাইয়াছিল আর-কি! কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তেই গির্জার ঘড়িতে দশটা বাজিল এবং গোরার চৈতন্য হইল এখন কাহারো বাড়িতে গিয়া দেখা করিবার সময় নয়। তাহার পরে গির্জার প্রায় সকল ঘড়িই গোরা শুনিয়াছে। কারণ বালির বাগানে সে রাত্রে তাহার যাওয়া ঘটিল না। পরদিন প্রত্যুষে যাইবে বলিয়া সংবাদ পাঠাইয়াছে।

প্রত্যুষেই বাগানে গেল। কিন্তু যে প্রকার নির্মল ও বলশালী মন লইয়া সে প্রায়শ্চিত্ত গ্রহণ করিবে স্থির করিয়াছিল সেরকম মনের অবস্থা তাহার কোথায়?

অধ্যাপক-পণ্ডিতেরা অনেকে আসিয়াছেন। আরো অনেকের আসিবার কথা। গোরা সকলের সংবাদ লইয়া সকলকে মিষ্টসম্ভাষণ করিয়া আসিল। তাঁহার গোরার সনাতন ধর্মের প্রতি অচল নিষ্ঠার কথা বলিয়া বার বার সাধুবাদ করিলেন।

বাগান ক্রমেই কোলাহলে পূর্ণ হইয়া উঠিল। গোরা চারি দিক তত্ত্বাবধান করিয়া বেড়াইতে লাগিল। কিন্তু সমস্ত কোলাহল এবং কাজের ব্যস্ততার মধ্যে গোরার হৃদয়ের নিগূঢ়তলে একটা কথা কেবলই বাজিতেছিল, কে যেন বলিতেছিল–“অন্যায় করেছ, অন্যায় করেছ!’ অন্যায়টা কোন্‌খানে তাহা তখন স্পষ্ট করিয়া চিন্তা করিয়া দেখিবার সময় ছিল না, কিন্তু কিছুতেই সে তাহার গভীর হৃদয়ের মুখ বন্ধ করিতে পারিল না। প্রায়শ্চিত্ত-অনুষ্ঠানের বিপুল আয়োজনের মাঝখানে তাহার হৃদয়বাসী কোন্‌ গৃহশত্রু তাহার বিরুদ্ধে আজ সাক্ষ্য দিতেছিল, বলিতেছিল–“অন্যায় রহিয়া গেল!’ এ অন্যায় নিয়মের ত্রুটি নহে, মন্ত্রের ভ্রম নহে, শাস্ত্রের বিরুদ্ধতা নহে, এ অন্যায় প্রকৃতির ভিতরে ঘটিয়াছে; এইজন্য গোরার সমস্ত অন্তঃকরণ এই অনুষ্ঠানের উদ্‌যোগ হইতে মুখ ফিরাইয়া ছিল।

সময় নিকটবর্তী হইল, বাহিরে বাঁশের ঘের দিয়া পাল টাঙাইয়া সভাস্থান প্রস্তুত হইয়াছে। গোরা গঙ্গায় স্নান করিয়া উঠিয়া কাপড় ছাড়িতেছে, এমন সময় জনতার মধ্যে একটা চঞ্চলতা অনুভব করিল। একটা যেন উদ্‌বেগ ক্রমশ চারি দিকে ছড়াইয়া পড়িয়াছে। অবশেষে অবিনাশ মুখ বিমর্ষ করিয়া কহিল, “আপনার বাড়ি থেকে খবর এসেছে। কৃষ্ণদয়ালবাবুর মুখ দিয়ে রক্ত উঠছে। তিনি সত্বর আপনাকে আনবার জন্যে গাড়িতে করে লোক পাঠিয়েছেন।”

গোরা তাড়াতাড়ি চলিয়া গেল। অবিনাশ তাহার সঙ্গে যাইতে উদ্যত হইল। গোরা কহিল, “না, তুমি সকলের অভ্যর্থনায় থাকো–তুমি গেলে চলবে না।”

গোরা কৃষ্ণদয়ালের ঘরে প্রবেশ করিয়া দেখিল, তিনি বিছানায় শুইয়া আছেন এবং আনন্দময়ী তাঁহার পায়ের কাছে বসিয়া ধীরে ধীরে তাঁহার পায়ে হাত বুলাইয়া দিতেছেন। গোরা উদ্‌বিগ্ন হইয়া উভয়ের মুখের দিকে চাহিল। কৃষ্ণদয়াল ইঙ্গিত করিয়া পার্শ্ববর্তী চৌকিতে তাহাকে বসিতে বলিলেন। গোরা বসিল।

গোরা মাকে জিজ্ঞাসা করিল, “এখন কেমন আছেন?”

আনন্দময়ী কহিলেন, “এখন একটু ভালোই আছেন। সাহেব-ডাক্তার ডাকতে গেছে।”

ঘরে শশিমুখী এবং একজন চাকর ছিল। কৃষ্ণদয়াল হাত নাড়িয়া তাহাদিগকে বিদায় করিয়া দিলেন।

যখন দেখিলেন সকলে চলিয়া গেল তখন তিনি নীরবে আনন্দময়ীর মুখের দিকে চাহিলেন, এবং গোরাকে মৃদুকণ্ঠে কহিলেন, “আমার সময় হয়ে এসেছে। এতদিন তোমার কাছে যা গোপন ছিল আজ তোমাকে তা না বলে গেলে আমার মুক্তি হবে না।”

গোরার মুখ বিবর্ণ হইয়া গেল। সে স্থির হইয়া বসিয়া রহিল, অনেকক্ষণ কেহ কোনো কথা কহিল না।

কৃষ্ণদয়াল কহিলেন, “গোরা, তখন আমি কিছু মানতুম না–সেইজন্যই এতবড়ো ভুল করেছি, তার পরে আর ভ্রমসংশোধনের পথ ছিল না।”

এই বলিয়া আবার চুপ করিলেন। গোরাও কোনো প্রশ্ন না করিয়া নিশ্চল হইয়া বসিয়া রহিল।

কৃষ্ণদয়াল কহিলেন, “মনে করেছিলুম, কোনোদিনই তোমাকে বলবার আবশ্যক হবে না, যেমন চলছে এমনিই চলে যাবে। কিন্তু এখন দেখছি, সে হবার জো নেই। আমার মৃত্যুর পরে তুমি আমার শ্রাদ্ধ করবে কী করে!”

0 Shares