গোরা

গোরা কহিল, “ভালো খবর। ডাক্তার এসেছিল। বললে কোনো ভয় নেই।”

মহিম অত্যন্ত আরাম পাইয়া কহিলেন, “বাঁচালে। পরশু একটা দিন আছে–শশিমুখীর বিয়ে আমি সেইদিনই দিয়ে দেব। গোরা, তোমাকে কিন্তু একটু উদ্‌যোগী হতে হবে। আর দেখো, বিনয়কে কিন্তু আগে থাকতে সাবধান করে দিয়ো–সে যেন সেদিন না এসে পড়ে। অবিনাশ ভারি হিঁদু–সে বিশেষ করে বলে দিয়েছে তার বিয়েতে যেন ওরকম লোক না আসতে পায়। আর-একটি কথা তোমাকে বলে রাখি ভাই, সেদিন আমার আপিসের বড়ো সাহেবদের নিমন্ত্রণ করে আনব, তুমি যেন তাদের তেড়ে মারতে যেয়ো না। আর কিছু নয়, কেবল একটুখানি ঘাড়টা নেড়ে “গুড ইভনিং স্যর’ বললে তোমাদের হিঁদু শাস্ত্র অসিদ্ধ হয়ে যাবে না–বরঞ্চ পণ্ডিতদের কাছে বিধান নিয়ো। বুঝেছ ভাই, ওরা রাজার জাত, ওখানে তোমার অহংকার একটু খাটো করলে তাতে অপমান হবে না।”

মহিমের কথার কোনো উত্তর না করিয়া গোরা চলিয়া গেল।

৭৬

সুচরিতা যখন চোখের জল লুকাইবার জন্য তোরঙ্গের ‘পরে ঝুঁকিয়া পড়িয়া কাপড় সাজাইতে ব্যস্ত ছিল এমন সময় খবর আসিল, গৌরমোহনবাবু আসিয়াছেন।

সুচরিতা তাড়াতাড়ি চোখ মুছিয়া তাহার কাজ ফেলিয়া উঠিয়া পড়িল। এবং তখনই গোরা ঘরের মধ্যে আসিয়া প্রবেশ করিল।

গোরার কপালে তিলক তখনো রহিয়া গেছে, সে সম্বন্ধে তাহার খেয়ালই ছিল না। গায়েও তাহার তেমনি পট্টবস্ত্র পরা। এমন বেশে সচরাচর কেহ কাহারো বাড়িতে দেখা করিতে আসে না। সেই প্রথম গোরার সঙ্গে যেদিন দেখা হইয়াছিল সেই দিনের কথা সুচরিতার মনে পড়িয়া গেল। সুচরিতা জানিত, সেদিন গোরা বিশেষ করিয়া যুদ্ধের বেশে আসিয়াছিল–আজও কি এই যুদ্ধের সাজ!

গোরা আসিয়াই একেবারে মাটিতে মাথা ঠেকাইয়া পরেশকে প্রণাম করিল এবং তাঁহার পায়ের ধুলা লইল। পরেশ ব্যস্ত হইয়া তাহাকে তুলিয়া ধরিয়া কহিলেন, “এসো, এসো বাবা, বোসো।”

গোরা বলিয়া উঠিল, “পরেশবাবু, আমার কোনো বন্ধন নেই।”

পরেশবাবু আশ্চর্য হইয়া কহিলেন, “কিসের বন্ধন?”

গোরা কহিল, “আমি হিন্দু নই।”

পরেশবাবু কহিলেন, “হিন্দু নও!”

গোরা কহিল, “না, আমি হিন্দু নই। আজ খবর পেয়েছি আমি মিউটিনির সময়কার কুড়োনো ছেলে, আমার বাপ আইরিশ্‌ম্যান। ভারতবর্ষের উত্তর থেকে দক্ষিণ পর্যন্ত সমস্ত দেবমন্দিরের দ্বার আজ আমার কাছে রুদ্ধ হয়ে গেছে, আজ সমস্ত দেশের মধ্যে কোনো পঙ্‌ক্তিতে কোনো জায়গায় আমার আহারের আসন নেই।”

পরেশ ও সুচরিতা স্তম্ভিত হইয়া বসিয়া রহিলেন। পরেশ তাহাকে কী বলিবেন ভাবিয়া পাইলেন না।

গোরা কহিল, “আমি আজ মুক্ত পরেশবাবু! আমি যে পতিত হব, ব্রাত্য হব, সে ভয় আর আমার নেই–আমাকে আর পদে পদে মাটির দিকে চেয়ে শুচিতা বাঁচিয়ে চলতে হবে না।”

সুচরিতা গোরার প্রদীপ্ত মুখের দিকে একদৃষ্টিতে চাহিয়া রহিল।

গোরা কহিল, “পরেশবাবু, এতদিন আমি ভারতবর্ষকে পাবার জন্যে সমস্ত প্রাণ দিয়ে সাধনা করেছি–একটা-না-একটা জায়গায় বেধেছে–সেই-সব বাধার সঙ্গে আমার শ্রদ্ধার মিল করবার জন্য আমি সমস্ত জীবন দিন-রাত কেবলই চেষ্টা করে এসেছি–এই শ্রদ্ধার ভিত্তিকেই খুব পাকা করে তোলবার চেষ্টায় আমি আর-কোনো কাজই করতে পারি নি–সেই আমার একটিমাত্র সাধনা ছিল। সেইজন্যেই বাস্তব ভারতবর্ষের প্রতি সত্যদৃষ্টি মেলে তার সেবা করতে গিয়ে আমি বার বার ভয়ে ফিরে এসেছি–আমি একটি নিষ্কণ্টক নির্বিকার ভাবের ভারতবর্ষ গড়ে তুলে সেই অভেদ্য দুর্গের মধ্যে আমার ভক্তিকে সম্পূর্ণ নিরাপদে রক্ষা করবার জন্যে এতদিন আমার চারি দিকের সঙ্গে কী লড়াই না করেছি! আজ এক মুহূর্তেই আমার সেই ভাবের দুর্গ স্বপ্নের মতো উড়ে গেছে। আমি একেবারে ছাড়া পেয়ে হঠাৎ একটা বৃহৎ সত্যের মধ্যে এসে পড়েছি। সমস্ত ভারতবর্ষের ভালোমন্দ সুখদুঃখ জ্ঞান-অজ্ঞান একেবারেই আমার বুকের কাছে এসে পৌঁচেছে–আজ আমি সত্যকার সেবার অধিকারী হয়েছি–সত্যকার কর্মক্ষেত্র আমার সামনে এসে পড়েছে–সে আমার মনের ভিতরকার ক্ষেত্র নয়–সে এই বাইরের পঞ্চবিংশতি কোটি লোকের যথার্থ কল্যাণক্ষেত্র।”

গোরার এই নবলব্ধ অনুভূতির প্রবল উৎসাহের বেগ পরেশকেও যেন আন্দোলিত করিতে লাগিল, তিনি আর বসিয়া থাকিতে পারিলেন না–চৌকি ছাড়িয়া উঠিয়া দাঁড়াইলেন।

গোরা কহিল, “আমার কথা কি আপনি ঠিক বুঝতে পারছেন? আমি যা দিন-রাত্রি হতে চাচ্ছিলুম অথচ হতে পারছিলুম না, আজ আমি তাই হয়েছি। আমি আজ ভারতবর্ষীয়। আমার মধ্যে হিন্দু মুসলমান খৃস্টান কোনো সমাজের কোনো বিরোধ নেই। আজ এই ভারতবর্ষের সকলের জাতই আমার জাত, সকলের অন্নই আমার অন্ন। দেখুন, আমি বাংলার অনেক জেলায় ভ্রমণ করেছি, খুব নীচ পল্লীতেও আতিথ্য নিয়েছি–আমি কেবল শহরের সভায় বক্তৃতা করেছি তা মনে করবেন না–কিন্তু কোনোমতেই সকল লোকের পাশে গিয়ে বসতে পারি নি–এতদিন আমি আমার সঙ্গে সঙ্গে একটা অদৃশ্য ব্যবধান নিয়ে ঘুরেছি–কিছুতেই সেটাকে পেরোতে পারি নি। সেজন্যে আমার মনের ভিতরে খুব একটা শূন্যতা ছিল। এই শূন্যতাকে নানা উপায়ে কেবলই অস্বীকার করতে চেষ্টা করেছি–এই শূন্যতার উপরে নানাপ্রকার কারুকার্য দিয়ে তাকেই আরো বিশেষরূপ সুন্দর করে তুলতে চেষ্টা করেছি! কেননা, ভারতবর্ষকে আমি যে প্রাণের চেয়ে ভালোবাসি–আমি তাকে যে অংশটিতে দেখতে পেতুম সে অংশের কোথাও যে আমি কিছুমাত্র অভিযোগের অবকাশ একেবারে সহ্য করতে পারতুম না। আজ সেই-সমস্ত কারুকার্য বানাবার বৃথা চেষ্টা থেকে নিষ্কৃতি পেয়ে আমি বেঁচে গেছি পরেশবাবু!”

0 Shares